সহসা ব্রিগেড ডেকে বিরোধীদের প্রবল চাপে ফেলে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার ব্রিগেড ভরিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতে চান মানুষ তাঁর সঙ্গেই। ওই সভায় তিনি কী বলবেন ‘৪২-এ ৪২’? অবশ্যই বলবেন। কিন্তু যে কথা বলবেন না, বরং দেখাবেন, তা হল, জনসমর্থন। জনজোয়ার। জনআবেগ। জনপ্রতিবাদ। সেই সূত্রে এবার ব্রিগেডের নামকরণ, ‘জনগর্জন’। লিখলেন কিংশুক প্রামাণিক।
তিন দশক আগে ১৯৯২ সালের ২৫ নভেম্বর ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড ভরিয়ে বামফ্রন্টের চোখে চোখ রেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন সিপিএম নেতৃত্ব অবাক হয়ে দেখেছিল, যে প্রান্তরে তাদের একচেটিয়া সাফল্য, শুধু এসএফআইয়ের ছেলেরাই যে মাঠ ভরিয়ে দিতে পারে, সেখানে এক বিরোধী নেত্রী জনজোয়ারে দঁাড়িয়ে বামফ্রন্টের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজাচ্ছেন। যিনি উত্তাল জনতাকে সাক্ষী রেখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে পারেন। যিনি তাবড় কংগ্রেস নেতাদের চমকে দিয়ে বলতে পারেন, ‘চাই না পদ। আমি জনতার প্রতিনিধি হয়েই থাকতে চাই।’
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিককে হারানো মেয়েটির সমর্থন তাহলে শুধু যাদবপুর অথবা দক্ষিণ কলকাতায় সীমাবদ্ধ নেই, গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিনই কী জ্যোতিবাবুরা বুঝে গিয়েছিলেন, ‘মমতা (Mamata Banerjee) আসছেন!’ শুধু আলিমুদ্দিনই নয়, প্রদেশের জমিদারি ভোগ করে আরাম-বিলাশে থাকা বাঘা বাঘা কংগ্রেস নেতারাও মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন। একরত্তি মেয়েটার সাহস কি! ব্রিগেড তো দূরের কথা, কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার ভয়ে যখন কলকাতায় বড় মিছিল করতে তঁারা তিনবার ভাবতেন, তখন একাই এত বড় সমাবেশ যুব কংগ্রেস নেত্রীর। সেদিন অবশ্য দিল্লিতে মমতার বিরুদ্ধে নালিশ করেও লাভ হয়নি। ব্রিগেড (Brigade) ভরিয়ে বাংলা শুধু নয়, হাইকমান্ডের কাছে নিজের ওজন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ। ফলত, মমতা বনাম সিপিএম তো বটেই মমতা বনাম প্রদেশ নেতাদের বিরোধও সপ্তমে উঠতে শুরু করল। যার জেরেই একদিন বহিষ্কার। মুক্ত বিহঙ্গ মমতা ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম দেন তৃণমূল কংগ্রেসের।
সেই ব্রিগেডের দুই সাক্ষী প্রাজ্ঞ নির্বেদ রায় ও তীব্র স্মৃতিশক্তির অধিকারী সমীর চক্রবর্তীর দিনগুলি মনে আছে। মমতার বহু পুরনো দুই সঙ্গী জানালেন, একটি মঞ্চ তো ভিড়ের চাপে ভেঙেই গিয়েছিল। নড়বড়ে হয়ে পড়া মূল মঞ্চেরও যাতে একই দশা না হয়, তার জন্য বার বার ঘোষণা করা হচ্ছিল, ‘সবাই নেমে যান। মঞ্চ দুলছে।’ সেদিন কলকাতার রাস্তার চেহারা দেখে মত পরিবর্তন করে সভায় এসেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। একসময় সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন মমতা। কিন্তু সন্তোষ মোহন দেব আসছেন খবর পেতেই আবার মাইক হাতে নিয়ে সভা চালু করেন। জনতাও ঘুরে দঁাড়ায়।
সেই নাটকীয় সভায় বামেদের ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ ঘোষিত হলেও বাংলায় পরিবর্তন আসতে অনেক সময় লেগে যায়। যদিও মমতা যে ধাক্কাটা সেদিন কংগ্রেসের ভিতর দিয়েছিলেন, তাতে স্পষ্ট হয়, সিপিএমের বিরুদ্ধে আগামীর নেত্রী তিনিই। তারপর থেকে বারে বারে সন্ধিক্ষণে তিনি ব্রিগেডে গিয়েই জনসমর্থন যাচাই করেছেন। একবার নয়, একাধিক বার তিনি রাজনৈতিক পথ খুঁজে নিয়েছেন। বাৎসরিক ২১ জুলাইয়ের সভার মতো ব্রিগেড কখনও ফেরায়নি তঁাকে।
সেই প্রেক্ষিতে ১০ মার্চ, ২০২৪ আবার তিনি ফিরছেন ব্রিগেডে। মাত্র ১৫ দিন হাতে নিয়ে গত রবিবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হল কর্মসূচি। দলনেত্রীর সিদ্ধান্ত তুলে ধরে সবাইকে চমকে দিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দে্যাপাধ্যায়।
ব্রিগেডে সভা করা খুব সহজ কাজ নয়। কয়েক লক্ষ মানুষ না আনতে পারলে ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা। তাদের শহরে আনা আবার ফেরত নিয়ে যাওয়া, এই দায়িত্ব দলের বুথস্তর পর্যন্ত পরিকাঠামো না থাকলে সম্ভব নয়। ফলে ব্রিগেড মানেই সার্বিক প্রচারাভিযান। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি। জেলায়-জেলায় নিরবচ্ছিন্ন মিছিল-মিটিং। মানুষ যাতে জানতে পারে কেন ব্রিগেড, কবে ব্রিগেড, কার ব্রিগেড। প্রচারের মাত্রা যত বৃদ্ধি পায়, তত উপস্থিতির তাগিদ তৈরি হয়। সিপিএম বরাবর অনেকটা সময় নিয়ে ব্রিগেড ডাকে। প্রতিদিন প্রচার চলে। কংগ্রেস নেতারা ব্রিগেডের ঝুঁকি নিতেন না। বিজেপিও এই রাজে্য ব্রিগেড ডেকে তেমন সফল হয়নি। কিন্তু তারাও যখন ডেকেছে প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছে।
অতীতে মমতাও সময় হাতে নিয়ে ব্রিগেড করেছেন। এবার ছবি ভিন্ন। দেখা গেল খানিকটা আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করেই মাত্র ১৫ দিন হাতে নিয়ে ব্রিগেড ডেকে দিলেন। সংগঠন তথা নেত্রীর সমর্থনের উপর ভর করেই শক্ত কাজটা সাহসের সঙ্গে করে নিল তৃণমূল। একদিকে হাজার হাজার জনপ্রতিনিধি অন্যদিকে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-সহ একগুচ্ছ সামাজিক প্রকল্পের সাফল্যকে সামনে রেখেই ব্রিগেড থেকে গোটা দেশকে আসলে দেখানো ‘জনগর্জন’ কাকে বলে।
এক সিদ্ধান্তে দলের মধ্যেও এমন ঝঁাকুনি মমতা দিলেন যে, ভোটের আগে তৃণমূল চাঙ্গা। কর্মীদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে গেল। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল সবাই। সন্দেশখালি নিয়ে যখন একতরফা প্রচারে শাসক দলকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এনে বারাসতে সভা করার ঘোষণা, তখন মমতার প্রত্যাঘাত ব্রিগেডে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে সাহসী পদক্ষেপ আর কিছু ছিল না। খুব তাৎপর্যপূর্ণ এক আবহ। কখন ব্রিগেড ডাকা হল?
যখন, ১) পক্ষকালের মধে্য লোকসভা ভোটের তারিখ ঘোষণা হবে।
২) রামমন্দির তৈরি করে মেরুকরণের আবেগ দেশজুড়ে ছড়াতে তৎপর
কেন্দ্রের শাসক দল।
৩) বাংলায় ৩৫ লোকসভা আসন জয়ের স্বপ্ন ফেরি করে আবার সব এজেন্সিকে সঙ্গে নিয়ে ঝঁাপিয়ে পড়তে চাইছেন দিল্লির বিজেপি নেতারা।
৪) ১০০ দিনের কাজ করা ৫০ লক্ষ শ্রমিকের বেতন এবং ১১ লক্ষ গরিব মানুষের বাড়ির টাকা কেন্দ্র দেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মানবিক মুখ নিয়ে নিজেই সেই টাকা দিতে শুরু করেছেন।
৫) কংগ্রেসের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ নেত্রী। ৪২ আসনে একাই লড়ার ঘোষণা।
৬) লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে দ্বিগুণ প্রাপ্তির আফটার-শক ঠেকাতে সন্দেশখালি-কাণ্ড জিইয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় বিজেপি। নন্দীগ্রামের কায়দায় গাছের গুঁড়ি এনে রাস্তা বন্ধ করছে তারা।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে সহসা ব্রিগেড ডেকে বিরোধীদের প্রবল চাপে ফেলে দিলেন মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়। এবার ব্রিগেড ভরিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতে চান মানুষ তঁার সঙ্গেই। ওই সভায় তিনি কী বলবেন ‘৪২-এ ৪২’? অবশ্যই বলবেন। কিন্তু যে কথা বলবেন না, বরং দেখাবেন, তা হল, জনসমর্থন। জনজোয়ার। জনআবেগ। জনপ্রতিবাদ। সেই সূত্রে এবার ব্রিগেডের নামকরণ, ‘জনগর্জন’।
পঁাচ বছর আগেও লোকসভা ভোটের আগে ব্রিগেড ডেকেছিলেন মমতা। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেখেছিল, মমতার পাশে দঁাড়াতে আসমুদ্র হিমাচলের বিরোধী নেতারা কলকাতায় হাজির। সেদিন ব্রিগেড থেকে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’-র ডাক ছিল বিরোধী ভোটকে একজোট করতে। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা কাণ্ডের জেরে যে জাতিয়তাবাদের আবেগ উঠেছিল, তার সুযোগ দেশজুড়ে নিয়েছিল বিজেপি। ফলত, ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডের সুফল ঘরে তুলতে পারেননি মমতা। পুলওয়ামা হাওয়ার খানিক প্রভাব ছিল বাংলাতেও। বিজেপি ১৮টি আসন জিতে নেয়। তবে অন্য সব রাজ্যে বিরোধী দুর্গ ভেঙে গেরুয়া শিবির লিড নিলেও বাংলায় ২২টি আসন পেয়েছিল তৃণমূল।
লোকসভা ভোটের আগে ১৯৯৬ সালে আর একবার ব্রিগেড ডেকেছিলেন মমতা। তখন তিনি যুব কংগ্রেস সভানেত্রী। লোকসভার সঙ্গে বিধানসভা ভোটও ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও ব্রিগেড করার দায়িত্ব মমতাকে দিয়েছিলেন। প্রণববাবু, প্রিয়বাবু, সোমেনবাবু, বরকত সাহেব, অজিত পঁাজা– কারও উপর তিনি ভরসা করেননি। মমতা সফল হয়েছিলেন।
আবার সেই ব্রিগেডের ডাক। ঠিক লোকসভা ভোটের আগেই। এই সমাবেশে কাদের আমন্ত্রণ করা হবে সেই সিদ্ধান্ত তৃণমূলনেত্রী এখনও ঘোষণা করেননি। তবে তঁার আচমকা সিদ্ধান্তে দিল্লির রাজনীতিতে শোরগোল। বিজেপি চিন্তায়, ‘ইন্ডিয়া’ জোটে চাঞ্চল্য। আপাতত এই সভায় মমতার বক্তব্যে একটাই থিম, ‘দেশকে পথ দেখাবে বাংলা।’ বাকিটা তিনি বলবেন ‘জনগর্জন’-এ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.