Advertisement
Advertisement
Mamata Banerjee

প্রকাশ্যে ঘরকে শাসন করার হিম্মত

নতুন নজির সৃষ্টি করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Mamata Banerjee once again proved that she is responsible only to the people
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 26, 2024 1:22 pm
  • Updated:June 26, 2024 1:22 pm  

একটা নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের সব রাজনৈতিক দল যদি অন্যের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এমন খড়্গহস্ত হতে পারত, তাহলে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির সংজ্ঞাটাই বদলে যেত। মমতার ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নকল করছে অনেক রাজ্য। এবার না হয় নকল করা হোক সরকারি কাজে গাফিলতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকেও। লিখছেন কিংশুক প্রামানিক

সোমবার পুর এলাকায় কাজের পর্যালোচনা করতে চেয়ারম্যান, মন্ত্রী, অফিসারদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সরকারি’ বৈঠক দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছিল, দেশের ২৮টি অঙ্গরাজ্যের একজন মুখ্যমন্ত্রীরও কি এমন ক্ষমতা আছে মিডিয়া ডেকে একটি বৈঠক ‘লাইভ টেলিকাস্ট’ করা, যেখানে নিজের প্রশাসনের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কামান দাগছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী?

Advertisement

পুর পরিষেবার ‘এ টু জেড’ সমস্ত বিষয় তুলে ধরে রীতিমতো তথ্য হাতে নিয়ে কৈফিয়ত চাইলেন। কোন রাস্তায় ঝঁাট পড়ে না, কোন ওয়ার্ডের কোন বহুতল বেঅাইনি, কোন ফুটপাতে অাচমকা হকার বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোন পুরসভার পানীয় জলের মান খারাপ, কোথায় সরকারি জমি জবরদখল হয়ে গিয়েছে, কোথায় চেয়ারম্যানের অকর্মণ্যতায় কাজ ডকে উঠেছে, কারা ‘টাকা’ কামাচ্ছে– তা স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন জনতার সামনেই। তোপের তালিকায় বাদ নেই মন্ত্রী, ডিএম থেকে অাইসি স্তরের অফিসার কেউই। মুখ্যমন্ত্রী শুধু এক-এক করে বলে যাচ্ছেন। টুঁ শব্দটি করার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই কারও। যা বলছেন, তা তথ্য দিয়ে বলছেন। প্রশাসনে এমন সীমাহীন কর্তৃত্ব অাগে কোনও মুখ্যমন্ত্রী দেখাতে পেরেছেন কি?

[আরও পড়ুন: ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের ছক! নিট কাণ্ডে প্রকাশ্যে অভিযুক্তের গোপন ভিডিও]

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেকে ‘ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন প্রচারে। ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বড়াই করেন সবসময়। দল নয়, জোট নয়, নিজের নামে ভোট চান। তিনিও কি পারবেন নিজের প্রশাসনের ভুলত্রুটিগুলি এভাবে দেশের মানুষের সামনে সরাসরি তুলে ধরতে? পারবেন কি এমন একটি মিটিং লাইভ টেলিকাস্ট করে তঁার দলের যঁারা অনিয়ম-অবহেলা করেছেন, তঁাদের তুলোধোনা করতে? প্রকাশ্যে ঘরকে শাসন করার হিম্মত অাছে এদেশে অার কার?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে-ই হিম্মত দেখালেন। অাবারও বোঝালেন– একমাত্র জনগণের প্রতিই তিনি দায়বদ্ধ। তাই নিজের দলের লোককেও অাড়াল করার কোনও দায় তঁার নেই। বরং যঁারা গাফিলতি করেছেন, অনিয়ম করেছেন, টাকা কামাচ্ছেন, তঁাদের কারও রেহাই নেই। অার কিছুই তিনি বরদাস্ত করবেন না। যদি চেয়ারম্যানরা সংশোধন না করেন, যদি টাকা তোলার মাস্টাররা ‘জনসেবক’ হতে না পারেন, তাহলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। মিলবে না ভোটের টিকিটও। এমন লোকেদের দলে চাই না।

একটা নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করলেন মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়। দেশের সব রাজনৈতিক দল যদি অনে্যর দিকে না তাকিয়ে নিজেদের জনপ্রতিনিধিদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এমন খড়গহস্ত হতে পারত, তাহলে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির সংজ্ঞাটাই বদলে যেত। মমতার ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ নকল করছে অনেক রাজ্যই। এবার না হয় নকল করা হোক সরকারি কাজে গাফিলতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তঁার লড়াইটিকেও।

[আরও পড়ুন: দলের সিদ্ধান্তে সায়, লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হচ্ছেন রাহুল গান্ধীই]

এই বৈঠকের পর বিরোধী দলগুলির হতাশা অারও বাড়িয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ভাল এবং খারাপ, সাফল্য এবং ব্যর্থতা, সবের দায়িত্বই যখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে বহন করে সমাধানের পথ বাতলে দিচ্ছেন, তখন বিরোধীদের কথা জনতা শুনবে কেন! মানুষের কাছে মমতার বিকল্প মমতাই। বাংলায় তাই একতরফা ভোট। একতরফা জয়।

যদিও এমন বৈঠক রাজে্য প্রথম হল এমন নয়। এই ধারা অাগেই চালু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দলের সব বড় সিদ্ধান্ত তিনি যেমন মানুষের সামনে নিতে ভালবাসেন, তেমন সরকার পরিচলানার ক্ষেত্রেও জনস্বার্থই শেষকথা। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পর কলকাতা থেকে প্রশাসনকে জেলায় নিয়ে যেতে শুরু করেন। সমস্ত প্রশাসনিক বৈঠকের লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থা হয়। যা দেখে মানুষ জানতে পারে, তাদের কথাগুলি নিয়ে কী অালোচনা হচ্ছে, কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

[আরও পড়ুন: দলের সিদ্ধান্তে সায়, লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হচ্ছেন রাহুল গান্ধীই]

অাগে মহাকরণে কখন কীভাবে প্রশাসনিক বৈঠক হত জানাই যেত না। জে্যাতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা জেলায় গিয়ে বৈঠক করতেন না, এমন নয়। কিন্তু নিয়মিত হত না। এবং এখনকার মতো ব্যাপকতা সেদিন ছিল না। কখনও ‘লাইভ টেলিকাস্ট’-ও হত না। ফলে কী নিয়ে বৈঠক হল তা মানুষ জানতে পারত না। ক্ষমতায় অাসার পর মমতার সব ‘ওপেন’ করে দেন। ৩০-৩৫ জন প্রধান সচিবকে কলকাতা থেকে জেলায় নিয়ে দিনের পর দিন তৃণমূল স্তরের সমস্যার সমাধান করা চাট্টিখানি কথা নয়। গ্রামের মানুষ প্রথম দেখল মুখ্যসচিব, ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশকে। এই প্রশাসনিক বৈঠকের সাফলে্যর উপর দঁাড়িয়েই মমতা গ্রাম-মফস্‌সলে একটা বিশাল সমর্থনের ভিত তৈরি করে ফেলেছেন। এত সামাজিক প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া কম বড় কাজ নয়। বিরাট কর্মযজ্ঞ। মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত জেলায় যাওয়ার ফলে, কৈফিয়ত চাওয়ার ফলে কাজটা মানুষ দেখতে পায়। কর্তারা তটস্থ থাকেন।

এবারের লোকসভা ভোটে গ্রামাঞ্চলে প্রায় নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে তৃণমূল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শহরে ফল তুলনামূলকভাবে খারাপ। ১২১টি পুরসভা এলাকার মধ্যে অর্ধেকের বেশিতে তারা হেরেছে। কলকাতার মতো সবুজ দুর্গে ১৪৪টির মধ্যে বেশ কিছু ওয়ার্ডে এগিয়ে বিরোধীরা। এই ফল শুধুই লোকসভা ভোটের ‘ট্রেন্ড’ বলে এড়িয়ে গেলে ভুল হবে। পুরসভাগুলির কাজে গাফিলতি, কাউন্সিলরদের একাংশের টাকা তোলার ঝোঁক, কাজের বিনিময়ে কাটমানি, মানুষকে পরিষেবা না দেওয়ার জেরেই যে পাড়ায় পাড়ায় ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে এ খবর মুখ্যমন্ত্রীর কানে অনেক দিন ধরেই আসছিল।

এবার তিনি ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেন। তিনি উদয়াস্ত পরিশ্রম করবেন, মানুষের দুয়ারে পরিষেবা পৌঁছে দেবেন, নির্বাচন এলে তঁার ছবি দেখিয়ে ভোট ভিক্ষা চলবে, অথচ জেতার পর মানুষ বঞ্চিত হবে, সরকারি কাজে অবহেলা হবে– এই খেলা আর বরদাস্ত করা হবে না। সোমবারের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী শেষ হুঁশিয়ারি দিলেন। তৃণমূল দলটি নিজের হাতে তৈরি করেছেন মমতা। এর জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে তঁাকে। দেশের বড় বড় রাজনৈতিক শক্তি বিরোধিতা করেছে। নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। নাশকতার শিকার হয়েছেন। বিশ্বাসঘাতকতা সামনে থেকে দেখেছেন। তঁার দলকে শেষ করার চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু একা লড়ে সব অাক্রমণ প্রতিহত করেছেন। এবং শেষ অবধি জিতেছেন। তঁাকে হারানোর ক্ষমতা বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম কারও এখন অার নেই।

ফলে, তৃণমূলের ভালো-মন্দ সবকিছুই মমতাকে জড়িয়ে। মানুষ তৃণমূল প্রার্থীদের ভোট দেয় মমতার প্রতীক দেখে। তাহলে কেন অন্যের পাপের দায় মুখ্যমন্ত্রীকে বইতে হবে? তঁার সাফ কথা, ‘যে জনসেবক হতে পারবে না, টাকা তুলতে দলকে ব্যবহার করবে, তাকে ছুড়ে ফেলে দেব।’ ঠিকই বলেছেন। এখন সময় এসেছে অাগাছাগুলিকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার। এদের কোনও মূ্‌ল্য নেই। মানুষ এদের চায় না। যারা মনে করছে দিদি রেগে গিয়ে এসব বলেছেন, আমি আমার মতো চলব, তাদের ভাবনা ভুল। দিদি এবার কঠিন, কঠোর। এই ভোটে আবারও তিনি দেখেছেন মানুষের জোর কাকে বলে। শেষকথা বলে মানুষ। তারা পাশে আছে বলেই এত বড় জয়। তাই মানুষের স্বার্থ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও স্বার্থ তঁার নেই।

বহু ভালো মানুষ, দক্ষ কর্মী নেতৃত্ব তৃণমূলে অাছেন। তাঁদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এ-কথাও সত্যি দল বড় হলে কিছু বেনোজল ঢোকে। অনেকের গায়ে মেদ জমে। ক্ষমতা দীর্ঘ হলে মধু খেতে ভিড় বাড়ে। সময়ে তাদের চিহ্নিত করে বাদ দিতে পারলে বাধা দূর হয়। দক্ষ প্রশাসকের মতো সেই কাজ কড়াভাবে শুরু করলেন মমতা। একটু নয়, বেশ কড়া দাওয়াই দিয়েই। অাগামী দিনে সাধু সাবধান।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement