Advertisement
Advertisement

Breaking News

‘আমৃত্যু গীতাই ছিল গান্ধীজির প্রিয়তম বই’

গীতার মাধ্যমেই হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তাঁর সংযোগ গড়ে ওঠে।

Mahatma Gandhi's favourite book is 'Gita'
Published by: Tanujit Das
  • Posted:October 2, 2018 3:52 pm
  • Updated:October 2, 2018 3:52 pm  

ভাস্কর লেট: ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ-র পরিচয় সবিস্তার জানানো বাহুল্য। তাঁর আগ্রহ বহুমুখী বিষয়ে ধাবিত। কিন্তু পরিবেশ নিয়েই লিখুন বা ক্রিকেট–সমাজবিদ্যার নিবিষ্ট প্রতিফলনে ওঁর সব লেখাই বিচ্ছুরিত সোনা। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে নিয়েও বিরতিহীনভাবে লিখে চলেছেন তিনি। ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’ (২০০৭), ‘ইন্ডিয়া বিফোর গান্ধী’-র (২০১৩) পর এই বছর প্রকাশ পেয়েছে রামচন্দ্র গুহর নতুন বই– ‘গান্ধী: দ্য ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯১৪—১৯৪৮’। প্রকাশক ‘পেঙ্গুইন’।

‘পাবলিক গান্ধী’ এই বইয়ের অন্যতম চর্চিত বিষয়। বাংলায় বললে ‘জনসাধারণের গান্ধী’। কেমন সেই রূপ? রামচন্দ্র গুহ সূত্রাকারে বলতে বলতে গিয়েছেন এইভাবে–মহাত্মা গান্ধী সেই অটুট মনোবলের সমাজ সংস্কারক যিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করেছেন। গান্ধী হলেন সেই স্থিতপ্রজ্ঞ সমাজ সংস্কারক যিনি ভারতের দু’টি জনগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালবাসার সেতু নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। গ্রামের দারিদ্র‌ ও বেকারি দূর করতে চরকা চালানোর ডাক দিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল, মানুষ আর্থিকভাবে স্বয়ংসিদ্ধ হোক। কংগ্রেসের প্রতিও ছিলেন সমান দায়বদ্ধ। সবরমতী আশ্রমের নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে হাজিরা দেওয়ার সময় বের করতে কখনও অসুবিধায় পড়েননি। দলের সভাপতি নির্বাচনের হাই প্রোফাইল বৈঠকেও পালন করতেন সক্রিয় ভূমিকা। আবার এই মানুষটিই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিরসনে সংগঠিত করেছিলেন সর্বাত্মক গণ-আন্দোলন, যেখানে পরাধীন দেশের জনতা জাত, শ্রেণি ও ধর্মের বিভাজন উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল। তাঁর রণকৌশলে প্রাধান্য পেয়েছিল দু’টি বীজমন্ত্র–অহিংস অসহযোগিতা এবং সত্যের সাধনা।

Advertisement

[সখী পরকীয়া কারে কয়?]

গান্ধীর চরিত্রের এই দিকগুলি স্বল্পালোচিত তো নয়ই, বরং নিবিড় গবেষণায় ঋদ্ধ। আলোচ্য বইয়ের ‘দ্য মরালিস্ট’ অধ্যায়ে রামচন্দ্র গুহ অবশ্য আগ্রহী হয়েছেন অন্তর্মুখী অভিযাত্রায়। গান্ধীজির ব্যক্তিগত বিশ্বাসভূমি সন্ধানে। ১৯২০-র দশকে তাঁর বহুধাবিস্তৃত কর্মকাণ্ডে এবং লেখায় এবং বাচনে যে ‘ব্যক্তিগত নৈতিকতা’-র (‘পার্সোনাল মর‌্যালিটি’) রশ্মি বিদ্ধ হয়েছিল– রামচন্দ্র গুহ গভীর অধ্যয়নে সেই নৈতিক চেতনার সঙ্গে পাঠকের আলাপ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। গান্ধীজয়ন্তীতে তারই অংশত অনুবাদ।

গান্ধীজি’র মা ছিলেন ‘প্রণমী’ সম্প্রদায়ের অনুগামিনী। প্রণমীদের মন্দিরে একই সঙ্গে গীতা ও কোরানের বাণী উদ্ধৃত থাকে। তিনি মায়ের সঙ্গে মন্দিরে যেতেন। খেয়াল করতেন উপাসনা পদ্ধতি। আবার, বাড়িতে মা যখন উপবাস রাখতেন, সেটাও মন দিয়ে লক্ষ করতে ভুলতেন না। বইয়ের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তাঁর সংযোগ (‘টেক্সচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং’) গড়ে উঠেছিল লন্ডনে থাকার সময় থেকে। ‘ভগবদ্গীতা’ তখন প্রথম পড়েন। এবং তারপর থেকে আমৃত্যু ‘গীতা’-ই ছিল তাঁর প্রিয়তম বই। ১৯২৬ সালের গ্রীষ্মে, পাবলিক লাইফ থেকে সাময়িক অব্যাহতি নিয়ে যখন সবরমতী আশ্রমে একান্ত ঘনিষ্ঠদের সংস্পর্শে বৃতিবদ্ধ জীবন কাটাচ্ছেন, তখন ‘গীতা’-র মর্ম-আশ্রয়ী কিছু ডিসকোর্স কথাচ্ছলে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ‘গীতা’ এমন একটি মহাগ্রন্থ যা ইতিহাসের কষ্ঠিপাথরে ঘষামাজা করে পড়তে গেলেই বিপদ! বইটি পড়তে হবে রূপকার্থের চাকটিকে না ভেঙেই। গান্ধীজির মতে, যে বাহ্য পরিবেশ গীতার পরিপ্রেক্ষিত ও আবহ রচনা করেছে, তা মানুষিক প্রবণতার দ্বান্দ্বিক সমাহার বোঝানোর জন্যই ব্যবহৃত। এর অতিরিক্ত কোনও ভূমিকা নেই সেই পারিবেশিক বাস্তবতার। গান্ধীজি এও মনে করতেন যে, ‘গীতা’-য় যে যে নাম পাওয়া যায়, সেগুলি মানুষের নাম নয়। অর্থাৎ নামভূমিকায় কোনও রক্তমাংসের মানুষের অস্তিত্ব খুঁজতে গেলে ঠকতে হবে। ওই নামগুলি প্রকৃতপ্রস্তাবে গুণান্বিত মানবময়তার কিছু চরিত্রলক্ষণ তুলে ধরে।

[রাফালে ইস্যু: বদলা না কি বদল?]

গীতা-য় কৃষ্ণ উপদেশাত্মক অভিপ্রায়ে অর্জুনকে বলেছিলেন, কোনও সম্পদই আপন-জ্ঞানে অধিকার করা, ভোগ করা ও রক্ষা করার মানসিকতা পরিত্যাগ করো। চেষ্টা করো নিরাসক্ত হতে। এই দৃষ্টান্তের ছায়ায় গান্ধীজি আশ্রমজীবনের উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিরূপণ করতে চেয়েছিলেন সহ-আশ্রমিকদের কাছে। তাঁর মতে, আশ্রমে যা কিছু আছে ভেবে নিও তা আমাদের যতটা, ততটাই অন্যের। তাই সম্পদের আরোহণ, সংগ্রহ ও সঞ্চয়ে অবিচল থাকতে শেখো। এটাই নিরাসক্তির সাধনা। এই সাধনার ভিতর দিয়েই ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ হওয়া সম্ভব। ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ কে? না, যে যাবতীয় আসক্তি এবং বিতৃষ্ণা জয় করতে পেরেছে! ‘গীতা’-কে উপজীব্য করে দেওয়া বক্তৃতামালায় গান্ধীজি বারবার জোর দিয়েছিলেন ‘গীতা’-কথিত পরিণামের কথা বিস্মৃত হয়ে একাগ্র অধ্যবসায়ে নিষ্কাম কর্ম করে চলার উপর। ‘কর্ম’ কী? যা আমরা নিজের ইচ্ছা ও খুশিতে সম্পাদন করি, তা-ই কি ‘কর্ম’? না। গান্ধীজি মনে করতেন, ‘কর্ম’ হল তা-ই, যা পরিস্থিতি আমাদের উপায়হীন হয়ে সম্পাদন করতে প্রবুদ্ধ করে। কিন্তু গীতা-র ‘কর্ম’ বাধ্যবাধকতায় করা কাজ নয়। জ্ঞান ও আত্মবিবেচনায় তাড়িত হয়ে মানুষ যা করে সেটাই গীতার ভাষ্যে প্রকৃষ্ট কর্ম।

‘বহুত্ববাদ’ ও অহিংসা। এই দু’টি স্তম্ভের উপর নির্ভর করে গান্ধীর সমাজ-রাজনৈতিক দর্শন গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে, ব্রহ্মচর্যর উপর ভর করে গঠিত হয়েছিল তাঁর নৈতিক চেতনার বিশ্বাসভূমি। যুবা সময়ে গান্ধীজি আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও পারেননি ব্রহ্মচর্যময় জীবনযাপনে নিজেকে সঁপে দিতে। ১৯০৬ সালে তিনি পাকাপাকি শপথ নেন সেক্স-বর্জিত ব্রহ্মচর্যের অনুশাসনে জীবন বাহিত করার।ব্রহ্মচর্য পালন ছিল আশ্রমের অবশ্যপালনীয় কৃত্য। প্রতিটি আশ্রমিকের জন্যই এই নিয়ম ধার্য করেছিলেন তিনি। তাঁর মতে, ব্রহ্মচর্য পালন এক ধরনের আত্মোৎসর্গ। নৈতিক শুদ্ধতা বজায় রাখার মাধ্যম। সরলাদেবী চৌধুরানির সঙ্গে গান্ধীজির সম্পর্কে প্যাশনের বাষ্পটুকু ছিল না, তা বললে অন্যায় হবে। কিন্তু ব্রহ্মচর্য রক্ষার ব্রত থেকে এরপরেও গান্ধীজি সরে আসেননি। আশ্রমের স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রী উভয়ই ছিল। এইভাবে ছাত্র ও ছাত্রীদের একযোগে শিক্ষাদানে প্রবুদ্ধ করার মধ্যে গান্ধীজি খুঁজে পেয়েছিলেন ‘সংবেদনশীলতা’-র আস্বাদ। একইসঙ্গে এটা ছিল তাঁর কাছে চমকে দেওয়ার মতো ‘মহৎ নিরীক্ষা’।

[রামধনু ক্ষণস্থায়ী, ধারণে মনের আকাশ তৈরি তো!]

গুজরাতি সমাজ বরাবরই ভীষণ রক্ষণশীল। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দিষ্ট কয়েকটি ‘আশ্রমিক বিধি’ মেনে চলতে বলেই দিয়েছিলেন। সেই আশ্রম-বিধি মোতাবেক, ছাত্ররা আলাদা পঙ্‌ক্তিতে বসবে। ছাত্রীরা বসবে অন্য সারিতে। তারা না পারবে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে, না পারবে খোলামনে মেলামেশা করতে। পরস্পরকে স্পর্শ করা তো প্রায় অচিন্ত্যনীয়। গান্ধীজি’র কড়া অনুশাসন ছিল– দৈহিক সংস্পর্শে ব্রহ্মচর্য ব্যাহত হয়। ১৯২০-র গোড়ার দিকে আশ্রমের স্কুলে গান্ধীজি ব্রহ্মচর্য রক্ষা করে চলার সপক্ষে বলেছিলেন– যত দিন যাচ্ছে এ কথার সত্যতা আমি ততই জলের মতো স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে কেউ যদি দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চায়, তাহলে তাকে দেহরসের সংরক্ষণে অগ্রণী হতে হবে। সুতরাং তোমরা (মূলত পুরুষদের উদ্দেশে বলা) দেহরসের সংরক্ষণে যত্নবান হও। তাহলেই সতেজ ও সবল শরীর গঠন করতে পারবে। এই ৫১ বছর বয়সেও আমাকে যে তোমরা তেজোদীপ্ত দেখতে পাচ্ছ তার কারণ আমি সংযমের অভ্যাস করেছি, ব্রহ্মচর্য পালন করেছি। এই কাজটা যদি আমি যৌবনের শুরুতে করতাম, তাহলে আজ যে আমি কোন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হতাম!

(অনুবাদ সংক্ষেপিত, নির্বাচিত)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement