দেবীপক্ষর সূচনা রবিবার। অথচ বাঙালির ঘরদুয়ারে পুজোর শুরু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠেই। এ এক অনবদ্য জাদু। ধরণীর বহিরাকাশে মেঘমালার মতো কোথায় যেন অন্তর্হিত হয় হেডফোন, আর বাঙালি জেগে বেতার-বিলাসে। লিখলেন, সরোজ দরবার।
পুরনো সম্পর্কের মতোই বাঙালির জীবন থেকে ছেড়ে গিয়েছে বেতারের কাঁটা। কানে কানে হেডফোনের জমানায় টাচ স্ক্রিনে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করে বটে, তবে প্রাণে সেই রেডিওর বেজে ওঠা কই! একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনকালে যেমন ফুলপিসি, ন’কাকার মতো সম্পর্করা স্রেফ নস্ট্যালজিয়া হয়ে গেল, স্কোয়্যার ফুটের মাপা ফ্ল্যাটের আবাসনে যেমন ব্রাত্য হয়ে গেল চিলেকোঠা, তেমনই একদা পারিবারিক সদস্য হয়ে থাকা বেতারও যেন হারিয়ে গেল বাঙালি জীবন থেকে। তবু যে ‘ভদ্র’লোকের কাছে বাঙালির অতিবড় মহানায়কের মোহিনীকণ্ঠও হার মেনে নিয়েছিল, তিনিই মেলান। প্রতিবারই। পুরনো অ্যালবামের পাতা ওল্টানোর মতো করে সম্পর্ককে ছুঁয়ে থাকার মতো করেই বাঙালিকে তিনি বসিয়ে দেন রেডিওর সামনে। কাঁটায় মিলে যায় কাঁটা। এই অন্তত একটা দিন বাঙালির জেগে উঠতে কোনও অ্যালার্ম লাগে না। আশ্বিনের শারদপ্রাতে আলোর বেণু বেজে ওঠা কোনও বিজ্ঞাপনের পরোয়া করে না। এ এমন এক অনুষ্ঠান যে অতি বড় কর্পোরেট বাণিজ্যব্যবস্থাও যেখানে বিরতির অছিলায় মাথা গলানোর সাহস পায় না। বছরভরের বিরতি পেরিয়ে বাঙালি এই একটা দিন মিলিত ঠিক হবেই বেতারে।
বস্তুত তিথি মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজো তথা দেবীপক্ষর দূরত্ব একদিনের। এটি তো পিতৃপক্ষের অবসান, পক্ষকাল ধরে চলা পিতৃপক্ষর শেষ দিন। পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণের দিন। ঠিক এর পরের দিন থেকে শুরু হচ্ছে দেবীপক্ষ। অথচ মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এমনই যে, বাঙালির কাছে যেন এই ভোর থেকেই পুজো শুরু। ইতিহাস বলে, একেবারে গোড়ার দিকে দুর্গা পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর দিনও সম্প্রচারিত হত এই অনুষ্ঠান। কিন্তু পরিবেশকরা বুঝেছিলেন, ততক্ষণে দুর্গাপুজো বাঙালির জীবনে জাঁকিয়ে বসে। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব তাতে খানিকটা যেন ক্ষুণ্ণই হচ্ছিল। সুপরিকল্পিতভাবেই তাই অনুষ্ঠানকে এগিয়ে আনা হয় দেবীপক্ষর একটা দিন আগে। সে সিদ্ধান্ত যে কতখানি বাস্তবসম্মত তা তো আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা তিথির গুরুত্ব একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে এমন অণ্বিত হয়ে পড়ার নজির খুব কমই আছে।
এই অনুষ্ঠানের দৌলতেই পিতৃপক্ষর শেষ দিনটার মধ্যে আনন্দ-বিষাদের আলোছায়া খেলে যায়। পিতৃপুরুষের তর্পণের দিন সাধারণত বিষণ্ণতার। কেন পক্ষকাল পরে এই তর্পণ? এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দাতা কর্ণের এক কাহিনি। মৃত্যুর পর দানশীল রাজা সোজা পৌঁছে গিয়েছেন স্বর্গে। দানধ্যান তো তিনি কম করেননি। পুণ্যের জোরে তাই স্বর্গলাভ তাঁর নিশ্চিত। কিন্তু গোলমাল বাধাল, যখন তাঁর খিদে পেল। তাঁর খিদে বুঝে ইন্দ্র তাঁকে থালা ভরা সোনা-দানা খেতে দিলেন। কর্ণ প্রশ্ন করলেন, এ কীরকম ব্যাপার? খাবার বলতে সোনা-দানা কেন? ইন্দ্র বললেন, কর্ণ তো আজীবন সোনা-দানাই দান করেছেন। কখনওই পিতৃপুরুষকে পিণ্ড দেননি। তাই খাবার হিসেবে সোনাই পেয়েছেন। কর্ণ জবাব দিয়ে বললেন, তাঁর কানীন মা তো তাঁকে পিতৃপরিচয় জানাননি। তাহলে পিণ্ডটা তিনি দেবেনই বা কাকে! ইন্দ্র বললেন, এতদিনে তো কর্ণ জেনে গিয়েছেন তাঁর বাবা কে, তিনি বরং পক্ষকাল ঘুরে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ডদান করে আসুন। সেইমতো কথিত আছে, পিতৃপক্ষর এই শেষ দিনটায় ব্রহ্মার নির্দেশে মর্ত্যধামের কাছে চলে আসেন চলে যাওয়া মানুষরা। আর ইহলৌকিক জগত থেকে উত্তরপুরুষরা তাঁদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেন।
মহালয়া তাই মহান আলয়। এ আলয় এক বৃহত্তর অর্থের সামনে, সম্পর্কের সম্প্রসারিত ভুবনের সামনে আমাদের হাজির করায়। শুধু ব্যক্তিগত প্রিয়জন নয়, এই তর্পণ পারিবারিক এবং পারিবার ছাপিয়েও সকলের জন্য। যিনি অপুত্রক, যাঁর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে তাঁদেরও আত্মার শান্তি কামনা করা হয় তর্পণে। অন্য অর্থে এক একান্নবর্তী পরিবারের যোগ যেন এই তিথিতে। দ্বিতীয়ত, আত্মার যে অবিনশ্বরতা বৈদিক ধর্মের ভিত্তি, সেই অনুভবেও আরও একবার মিলিয়ে দেয় এই তিথি। শরীর নগণ্য মাত্র। তুমি আগেও ছিল, পরেও আছ। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলেও সে পূর্ণই থাকে। উপনিষদের এই পূর্ণতাবোধে পৌঁছে দেয় এই মহালয়া, সেই অর্থেই মহান এই আলয়। এই বিশ্বসংসার।
তবে এই সূত্রে একটা প্রশ্ন ওঠে, এ তর্পণ কি শুধু পিতৃপুরুষের? এও কি তবে পিতৃতান্ত্রিকতার জোর! মাতৃগণ কি এখানে বিবেচ্য নন? অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর এক লেখায় এ ধন্দ কাটিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, এখানে পিতৃপুরুষের মধ্যে মাতৃগণও বিবেচিত। কেননা হরগৌরী, শিব-শিবানীকে যুগপৎ প্রণামই আমাদের রীতি। ‘পিতরৌ’ শব্দের প্রয়োগ সেকারণেই। সুতরাং পিতৃতান্ত্রিকতার প্রশ্ন এখানে আসে না। এই তর্পণ তাই সকলের উদ্দেশ্যেই।
এই যে তিথির ভিতরকার বিষয়বস্তু এ তো এখনও একইরকম আছে। কিন্তু তিথির মুডটা যেন পালটে দিয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান। যত বিজ্ঞাপন হোক, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যতই কাউন্টডাউন চলতে থাকুক, যতই সাজ সাজ রব হোক, এই অনুষ্ঠান ছাড়া খাতায়-কলমে শরৎ এলেও বাঙালির পুজো আসে না। আসলে কিংবদন্তি রচনা হওয়ার নেপথ্যে থাকে সময়ের প্রণোদনা। নক্ষত্রজন্ম তো সময়েরই প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে। বাঙালির বিনোদন, রুচি, সাংস্কৃতিক পরিসর অপেক্ষমান ছিল এমন এক অনুষ্ঠানেরই। এবং এই শিল্পীরা সেটিকে এমন এক উচ্চতা দিয়েছে যা ভালো লাগা থেকে আবশ্যিকতার চৌকাঠ পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে ঐতিহ্যে। ফলত এ অনুষ্ঠানের কোনও বিকল্প হতে পারে না, চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। অথচ শোনা যায়, একদা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ নিয়েই আপত্তি উঠেছিল। তবে ভাগ্যিস সে সব ধোপে টেকেনি। তাই এই ঘোর ডলবি-ডিজিটাল যুগেও এখনও ধুলো ঝাড়া হয় পুরনো রেডিওটার। কিনে আনা হয় ব্যাটারি। হ্যাঁ, মোবাইলেও শোনা যায় বটে। লাউডস্পিকারে দিলে সাউন্ডটাও বেশ গমগমে হয়। তবু রেডিওটা না বাজলে যেন হয় না। রাত থাকতেই বাঙালির ঘরদুয়ারে গোছানো থাকে সব। আর ভোর চারটে বাজলেই কী এক অদৃশ্য জাদুবলে জেগে ওঠে কয়েকটা প্রজন্ম। সব আবেগের কাঁটাগুলো এক কম্পাঙ্কে মিলে গেলেই, সেই অবিস্মরণীয় কণ্ঠ গমগমিয়ে বেজে ওঠে… আশ্বিনের শারদপ্রাতে, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা…
হ্যাঁ শাস্ত্রমতে দেবীপক্ষ আসতে একদিন বাকি বটে। তবে কে না জানে বাঙালির দেবীপক্ষর সূচনা বীরেন ভদ্রর চণ্ডীপাঠেই, একদিন আগেই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.