বামপন্থী ভোটারদের মধ্যে একটা বড় অংশ কিন্তু ম্যাক্রোঁ-র বিরুদ্ধে এবং ল্য পেঁ-র সমর্থনে ভোট দিয়েছেন। তার মানে, বামপন্থী ভোটারদের একটা অংশের কাছে এমনকী অতি দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব বা সরকারও কাঙ্ক্ষিত, মধ্যপন্থীরা সরকার চালানোর চেয়ে। লিখছেন সুমন ভট্টাচার্য
‘রুশাজ্ম’। অর্থাৎ যে-ফ্যাসিজ্ম রাশিয়ার থেকে শুরু হয়। মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের পরে ইউক্রেনের সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই শব্দটি ব্যবহার শুরু করেছেন। আপাতত, সেই ‘রুশাজ্ম’ বা রাশিয়ার তৈরি ফ্যাসিজ্ম থেকে হয়তো রেহাই পেল ফ্রান্স।
ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসাবে পরিচিত ফ্রান্সের অতি দক্ষিণপন্থী নেত্রী মারিন ল্য পেঁ। তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় আপাতত স্বস্তির শ্বাস ইউরোপে। হয়তো আমেরিকাতেও। কিন্তু এটা যদি সুখের খবর হয়, তাহলে যেটা চিন্তার খবর সেটা হচ্ছে- ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যতজন ভোট দিয়েছেন, তার মধ্যে প্রতি ১০ জনের ৪ জনই ফ্যাসিবাদের সমর্থক, প্রায় নাৎসিদের মতোই বর্ণবৈষম্য এবং ঘৃণার রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখা নেত্রী মারিন ল্য পেঁ-কে ভোট দিয়েছিলেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ-র জয় হয়তো আপাতত ফ্রান্স-সহ ইউরোপের জন্যই উদারনৈতিক সমাজ, বহুত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার জয় নিশ্চিত করল। তবে এই যে ভোটারদের মধ্যে এত বড় একটি অংশ অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে সমর্থন করছে, সেটাও ইউরোপের গণতন্ত্র এবং সমাজব্যবস্থার জন্য গভীর উদ্বেগের। ফ্রান্সের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোট ছিল, সেটা অবশ্য পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যখন ইউরোপের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান প্রকাশ্যে চিঠি লিখে এই নির্বাচনে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ-কে ভোট দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোল্স, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সাঞ্চেজ আর পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও কোস্তা-র খোলা চিঠি ইউরোপের রাজনীতিতে যতটা ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিন রাষ্ট্রপ্রধান ততটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন ফরাসি দক্ষিণপন্থী নেত্রীর রাজনৈতিক আদর্শকে লোকের সামনে তুলে ধরতে। তাঁরা পরিষ্কার বলেছিলেন, ল্য পেঁ সেসবেরই পক্ষে, যা ইউরোপের গণতন্ত্র, মূল্যবোধ, বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক আদর্শকে ধ্বংস করতে চায়। এঁরা মনে করছিলেন, অতি দক্ষিণপন্থী নেত্রী মারিন ল্য পেঁ প্রেসিডেন্ট ভোটে জিতলে ফ্রান্স যে শুধু রাশিয়ার উপগ্রহ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যাবে, তা-ই নয়, ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নও দুর্বল হয়ে যাবে। অতি দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় বসলে ফ্রান্স যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো-র জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, সেটা তো আগে থেকেই পরিষ্কার ছিল, একই সঙ্গে ম্যাক্রোঁ যেভাবে ইউরোপের নেতা হিসাবে ভ্লাদিমির পুতিনের একনায়কতন্ত্রের মুখোমুখি হচ্ছিলেন, তা-ও বন্ধ হয়ে যেত। সেজন্যই হয়তো ইউরোপের অন্য নেতারা এইভাবে প্রকাশ্যে ফরাসি নির্বাচনে কে তাঁদের পছন্দের প্রার্থী, তা জোর গলায় বলেছিলেন। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সাঞ্চেজ সম্প্রতি সেই দেশের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতেছেন। ইউরোপের রাজনীতিতে তাঁকে সমাজতন্ত্রী রাজনীতিক বলেই মনে করা হয়।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তাহলে আমাদের কী শিখিয়ে দিয়ে গেল? তাহলে কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও এইরকম কোনও দেশে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকের জেতার সম্ভাবনা দেখা দিলে সমাজতন্ত্রী বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যবর্তী ভাবধারায় বিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে চিঠি লিখে সেই রাজনীতিককে হারানোর ডাক দেবেন? অর্থাৎ জার্মানি, পর্তুগাল এবং স্পেনের মতো করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনও তিনটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক কি অন্য কোনও দেশে যাতে অতি দক্ষিণপন্থীরা নির্বাচনে না জেতেন, সেজন্য আবেদন করবেন? বলা মুশকিল। কিন্তু যে-ফ্রান্স, বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, সাম্যবাদ এবং সমানাধিকারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই দেশে যেভাবে শেষ পর্যন্ত অতি দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতা-দখল ঠেকানো গেল, তা অবশ্যই ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য রুলবুক হয়ে থাকবে।
সেই রুলবুকে কী লেখা থাকবে? লেখা থাকবে যে, বামপন্থী ভোটারদের মধ্যে একটা বড় অংশ কিন্তু ম্যাক্রোঁর বিরুদ্ধে এবং লো পেনের সমর্থনে ভোট দিয়েছে। তার মানে, বামপন্থী ভোটারদের একটা অংশের কাছে, এমনকী অতি দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব বা সরকারও কাঙ্ক্ষিত, মধ্যপন্থীরা সরকার চালানোর চেয়ে। ফ্রান্সের বামপন্থী ভোটারদের একটা অংশের অতি দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেঁ-কে সমর্থনের এই প্রবণতার মধ্যে কেউ যদি পশ্চিমবঙ্গের বাম ভোটারদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঠেকাতে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পান, তাহলে অবাক হবেন না। প্রথম দফায় ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে শেষ করা বামপন্থী প্রার্থী জাঁ লুক মেলঁশঁ অতি দক্ষিণপন্থী প্রার্থীকে একটি ভোট না-দেওয়ার জন্য আবেদন জানালেও তা হয়তো পুরোপুরি কাজ করেনি। সেই কারণে এবার হেরে গেলেও মারিন লো পেন কিন্তু অতি দক্ষিণপন্থী প্রার্থী হিসাবে সবোর্চ্চ রেকর্ড করে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। কেননা, আর-একজন অতি দক্ষিণপন্থী এবং ঘৃণার রাজনীতির জন্য ফ্রান্সে সুপরিচিত এরিক জেমু কিন্তু তাঁর সমর্থকদের পুরো অংশটাকেই মারিন ল্য পেঁর দিকে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন।
ব্যক্তি-জীবনে এবং রাজনীতিতে প্রথা-ভাঙা ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, রবিবার রাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার পর আবেগঘন বক্তৃতায় একটি জিনিস বারবার বলেছেন। তিনি জানেন, যাঁরা অতি দক্ষিণপন্থী প্রার্থী মারিন ল্য পেঁ-কে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের হতাশা ও রাগের কারণগুলি কী কী। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসে তিনি সেই রাগ এবং হতাশার কারণগুলোকে দূর করার চেষ্টা করবেন। মনে করে নেওয়া হচ্ছে, ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ-র ইঙ্গিত সেই বামপন্থী ভোটারদের দিকে, যাঁরা রবিবারের ভোটে অতি দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেঁ-কে ভোট দিতে দ্বিধা করেননি। এঁদের ক্ষোভ, জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ, প্রতিদিনের জীবনধারণের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাওয়া, তা যে রাজনৈতিক দিক থেকে মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গিয়েছে, সে নিয়ে কোনও সংশয় থাকা উচিত নয়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ম্যাক্রোঁর প্রথম কাজ হবে ফরাসি সমাজের এই প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষের, যারা সরকারের উপর হতাশ, তাদের কাছে টানার চেষ্টা করা। একজন সফল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার হিসাবে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সবসময় পরিসংখ্যানে, স্লাইড প্রেজেন্টেশনে অনেক এগিয়ে। সেই পরিসংখ্যানের দিক থেকে তিনি ফ্রান্সের অর্থনীতি গত পাঁচ বছরে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, দেশ সংস্কারের পথে হেঁটেছে। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানের বাইরে ফরাসি আমজনতার রোজকার জীবনের বারোমাস্যা যে তাদের সরকার-বিরোধী করে তুলছে, সেটা বোধহয় এবার টের পেলেন। প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন বামেদের দিকে থাকলেও, যদি বামপন্থীরা সরকারকে চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ জানানোর জায়গায় না-থাকে, তাহলে সেই প্রান্তিক শ্রমজীবীর একটা অংশ যে অতি দক্ষিণপন্থীদেরও ভোট দিয়ে দিতে পারে, সেটা এই ভোট দেখিয়ে দিয়ে গেল।
ফরাসিরা এমনিতে প্রেসিডেন্টকে বিশেষ পছন্দ করে না। ফ্রান্সের গত ৫০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ফ্রান্সের জনগণ বরাবরই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়, মানে প্রেসিডেন্টের বিরোধিতায় বিশ্বাস করে। এর আগে গত শতকে ফ্রাঁসোয়া মিঁতেরো, আর পরে জাঁক শিরাক প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতেছিলেন বটে, কিন্তু সেই সময় এই দু’জন প্রেসিডেন্টই ফ্রান্সের সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই এঁদের জয় কখনওই সরকারের জয় ছিল না। তুলনায় ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর জয় সরকারের জয় এবং সেই কারণেই ‘ঐতিহাসিক’।
তবে এটা তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জের শুরু মাত্র, কারণ জুন মাসেই ফ্রান্সে সংসদীয় নির্বাচন। সেই ভোটে যাতে দক্ষিণপন্থীরা কোনওভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, সেটা উদার গণতন্ত্রের ‘আইকন’ রূপে মাকরোঁকেই সুনিশ্চিত করতে হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.