যে সসাগরা পৃথিবীর মাটিতে সিধো আপন রক্ত ফেলে গিয়েছেন, সেই ইতিহাস আত্মবলিদানের ইতিহাস। ‘শহিদ দিবস’-টি উৎসবের মেজাজে পালিত হয় বটে, কিন্তু আমাদের কাছে কেউ কখনও শুনতেই চাননি– দিনটিকে আমরা আসলে কেমন করে পালন করতে চাই। ‘হুল দিবস’ নিয়ে লিখলেন অভিমন্যু মাহাত।
এসেছে আষাঢ়। সঙ্গে নিয়ে এসেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, কোপন (ক্ষোভ)। আধুনিকতার সাবান ছাড়াই চকচকে হয়ে থাকা হাড় বের করা বুকের মধ্যে জমে ওঠে নানা কথা। কথার উপরে কথা, অযোধ্যা পাহাড়, ছোটনাগপুরের অচেনা পাহাড় আকাশ ফেঁড়ে মাথা তুলতে চায়, বলতে চায়– আজ ‘হুল দিবস’ (Hul Diwas)। ‘হুল’ কথার অর্থ ‘বিদ্রোহ’। বিদ্রোহে স্মরণীয় সিধো-কানহু, ভৈরব-চানকুরা। যে সসাগরা পৃথিবীর মাটিতে সিধো আপন রক্ত ফেলে গিয়েছেন, সেই ইতিহাস আত্মবলিদানের ইতিহাস। ‘শহিদ দিবস’-টি উৎসবের মেজাজে পালিত হয় বটে, কিন্তু আমাদের কাছে কেউ কখনও শুনতেই চাননি– দিনটিকে আমরা আসলে কেমন করে পালন করতে চাই।
নির্বাচন ‘আসন্ন’ হলে ‘হুল’-এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড! মন্ত্রীদের আনাগোনা বাড়ে। প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আদিবাসী মহল্লা। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর তেমনই একটি ‘জলসা’ হয়েছিল। বঁাকুড়ার পুয়াবাগানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি মূর্তি উদ্বোধন করেছিলেন। সেটিকে ‘বিরসা মুন্ডা’-র মূর্তি বলে প্রচার করা হয়েছিল। যা আসলে একজন ব্যাধপুরুষের মূর্তি। শিকারি মূর্তি উন্মোচন করে বিরসাকে অপমান করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী– অভিযোগ উঠেছিল। সরব হয়েছিল আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু ভুল স্বীকার বা ক্ষমাপ্রার্থনার ধারও ধারেনি দিল্লি। কয়েক দিন আগে বঁাকুড়ার পুয়াবাগান মোড় দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, কেমন নিরঙ্কুশ অবহেলায় একা দঁাড়িয়ে সেই আদিবাসী শিকারি। রোদ-ঝড়ে রং ফিকে। শরীরে বিভিন্ন অংশে ক্ষত। যেন অশ্লীল উপেক্ষা এত দিনে শরীর ফেটে বেরিয়েছে। তার দিকে ফিরে তাকান না আর কোনও মন্ত্রী বা নেতা।
গত বছর থেকেই খবরের কেন্দ্রে আছে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’। এক দেশ এক আইন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ‘ইউসিসি’ লাগু করতে চায় কেন্দ্রের সরকার। কিন্তু প্রতিবাদ আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা বিরোধিতায় নামেন। এই ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ আদিবাসীদের ধর্মীয়, বাস্তবিক সংস্কৃতিতে বড় আঘাত আনতে পারে। আদিবাসী সংস্কৃতি বিপন্ন হতে পারে। আদিবাসীদের বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও বলপূর্বক অন্য নিয়ম ও বিধি চাপিয়ে দেওয়া সংবিধানের পরিপন্থী। দেশে মোট জনসখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ আদিবাসী। ৭০৫টি স্বীকৃত জনজাতির বাইরেও বহু জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে আদিবাসী। তাদের সমাজজীবনেও স্বকীয় নিয়ম, বিধি রয়েছে। প্রথাগতভাবে তারা নিজেদের সংস্কৃতি-নির্মিত আচার-আচরণ, অনুশাসন মেনে চলে। দেশের সংবিধানও জনজাতিদের নিজস্ব নিয়ম, বিধিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী– আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় স্বশাসিত প্রশাসন চলতে পারে, এমন কথার উল্লেখ রয়েছে। সেসব সাংবিধানিক স্বীকৃতি তুলে দিতেই কি এমন সুচারু পরিকল্পনা?
স্বাধীনতার ৭৭ বছর অতিক্রান্ত। আদিবাসীরা এই স্বাধীন ভারতভূমি থেকে কী পেয়েছে? অনেকে হয়তো বলবেন– কেন, দেশের সর্বোচ্চ সংবিধানিক পদ রাষ্ট্রপতির আসনে উন্নীত হয়েছেন একজন আদিবাসী মহিলা– দ্রৌপদী মুর্মু। কিন্তু প্রশ্নটি রাষ্ট্রপতি পদের গরিমা নিয়ে নয়, একজন আদিবাসী নারীর এমপাওয়ারমেন্টের নয়, প্রশ্নটি জাতিসত্তার সার্বভৌমত্বের। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৭৭ বছরে উন্নয়নের নামে ২২ লক্ষ একর বনভূমি নেওয়া হয়েছে। সেসব বনভূমি আদিবাসীরাই দেখভাল করত, চাষাবাদ করত। ২ কোটির বেশি আদিবাসীকে ভিক্ষের ঝুলি হাতে নাগরিক সভ্যতার দ্বারস্থ হতে হয়েছে ওই বিপুল পরিমাণ বনভূমি বিভিন্ন শিল্পসংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পরিণামে। উন্নয়নের দাবানলে ভস্মীভূত হয়েছে জনজাতি মহল্লা, তাদের সমাজ, এমনকী স্বীকৃতিও। ২০০৬ সালের ‘অরণ্য অধিকার আইন’ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। এই আইনে বলা রয়েছে, বিধি অনুযায়ী ৭৫ বছর অর্থাৎ তিন পুরুষ বনভূমিতে বসবাস করতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আইনি প্রয়োগে নানা জটিলতা আছে। পশ্চিমবঙ্গে এই আইন মোতাবেক জমি পেতে আবেদন জমা পড়ে ৯৫,৯৫৮টি। বাতিল হয়েছে ৫০,২৮৮টি। যার শতাংশের হার ৫২। কেন? মূলত কাগজপত্র না-থাকা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার নিতান্তই কম। ১৯৬১ সালে শিক্ষার হার ছিল ৮.৫ শতাংশ (পুরুষ ১৩.৮ শতাংশ, মহিলা ৩.২ শতাংশ)। ২০০০ সালে তা এসে দঁাড়ায় ৪০ শতাংশে (পুরুষ ৫৯ শতাংশ, মহিলা ৩৭ শতাংশ)। শিক্ষার হারে পিছিয়ে থাকার কারণে নিজেদের জমির দলিলপত্রাদি তারা গচ্ছিত রাখেনি। সবচেয়ে বড় কথা, আদিবাসী মনের খেঁাজ নাগরিক সভ্যতার তল্পিবাহকরা রাখেন কি?
বনজ-ভাবনা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নাগরিক সভ্যতার পরিচয় তো কেবল উপন্যাস আর রাজনৈতিক পরিকল্পনায়। সেখানে মনোবৃত্তি, মান ও সম্মানের জায়গা কোথায়? মূলভূমিতে অন্ন হারিয়ে কাজের খোঁজে দেশের একপ্রান্তে থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে আদিবাসী মানুষরা। ভবঘুরের মতো। পশ্চিমবঙ্গের বহু আদিবাসী অসমের চা-বাগানে কাজের খেঁাজে পাড়ি দিয়েছে। তাদের কাছে কি জমির দলিল পরচা থাকবে? আদিবাসীরা কখনও ভাবেনি, যে-জমি তারা বংশ পরম্পরায় চষেছে, যে-জমিতে গাছ লাগিয়েছে, সেই জমির জন্য ভূমি দপ্তর থেকে কাগজপত্র নিতে হবে। সেই হুঁশ ছিল না বলেই না একদিন সরকার এসে বাড়ির দুয়ারে দঁাড়িয়ে বলল– ওই জমি তো তোমার নয়। কাগজ কই? এ এই বন তোমার নয়, সরকারের। ভূমিহীন? এই নাও পাট্টা। এই নাও কাগজ। আর, জমির নিচে খনিজ সম্পদ থাকলে তো রাষ্ট্রের সোনায় সোহাগা। সেই জমি অধিগ্রহণ করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়ে রাষ্ট্র। এভাবেই সাংস্কৃতিক অবদমন সম্পন্ন হয় নিরুচ্চারে। হুল দিবসের শোকের আবহ হারিয়ে ফেলাও তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
বন-পাথর-জঙ্গলের সন্তানের ধৈর্য অনেক বেশি, চাহিদা অনেক কম। তাই তাদের নীরবতাকে সভ্যতার জয়ের সুবাস বলে ধরে প্রাথমিকভাবে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সাধু সাবধান! মনে রাখতে হবে– আদিবাসীরা চরিত্রগতভাবেই আনপ্রেডিকটেবল। প্রকৃতির সন্তানদের সেই স্বভাবের বদল ঘটানোর ক্ষমতা নাগরিক সভ্যতা এখনও অর্জন করেছে– এমন দলিল নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.