নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী: বহুকাল আগে আমি আমার পিতাঠাকুরের সঙ্গে এক বৈষ্ণব-পাটে গিয়েছিলাম। সেখানে বিগ্রহ দর্শন করে মহাপ্রসাদ ভোগ খাবার পর এক পরিচিত বৈষ্ণব আমার পিতাঠাকুরকে বললেন, সামনের দুটো গ্রাম পেরলেই এক গৃহস্থের বাড়িতে একজন মহাপুরুষ সাধু এসেছেন। লোকে তঁাকে বলছে, ‘বিষ্ণুর বামন অবতার’। লোকজন ভেঙে পড়ছে তঁার দর্শনে। তিনি নাকি অনেক সিদ্ধাই জানেন, একেবারে বাক্সিদ্ধ মহাপুরুষ।
বর্ণনা শেষ না-হতেই পিতাঠাকুর রাজি। বললেন, এত মানুষ নিত্য যঁার দর্শনে কষ্ট করে যাচ্ছে, তঁার মধে্য ঈশ্বরের বিভূতি কিছু তো আছেই। অতএব কাল সকালেই।
কাহিনিটা অনেক বড় ছিল, পথও ছিল লম্বা, কিন্তু মূল প্রস্তাবে জানাই– বহুশ্রুত বামনাবতারের দর্শন পাওয়া মাত্রই আমাদের মন ভরে গেল। আমার পিতাঠাকুর ভাগবতের শ্লোক উচ্চারণ করে বললেন, অবতার পুরুষের দর্শন হল– ‘অয়ং হি পরমো লাভ উত্তমশ্লোক-দর্শনম্’। প্রতু্যত্তরে সাধুজি বললেন, আমার ‘অবতার’ উপাধিটা এখন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমার গুরুপ্রদত্ত নাম ছিল: যুগলকিশোর দাস। কিন্তু আমার চেহারাটা দেখছেন তো? তিন হাতও লম্বা নয়। গুরুদেব আদর করে ডাকতেন ‘বামন’ বলে। তঁার সেই কৃপা-সমাদরের ফল ভোগ করছি আমি। মানুষ এই বেঁটে বামনকে ‘অবতার’ বানিয়ে দিল। আবার বলছে, আমি নাকি ‘বাক্সিদ্ধ’! আরে, তেমন সিদ্ধাই থাকলে আমি তো সবার আগে নিজেকে খানিক লম্বা করার সিদ্ধি খুঁজতাম! আমার সমস্যা হল– আমার গুরুকৃপার দানের উপরে মানুষের কৃপালব্ধ এই অবতারের বুজরুকি আর সইতে পারছি না। একটা বেঁটে বামনের কী এত সয়? বলুন।
আমরা প্রকৃত সাধুর সন্ধান পেয়েছিলাম সেদিন এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের (Kaushik Ganguly) ‘লক্ষ্মী ছেলে’ (Lokkhi Chele) দেখে মানুষের আরোপিত অন্ধত্বের ভয়ংকর পরিণাম দেখতে পেলাম। একটি গ্রামে, তথাকথিত অন্ত্যজ গৃহে একটি বাচ্চা মেয়ে জন্মেছে– যার চারটি হাত। ব্যস! অজ্ঞান ঘরের মানুষ থেকে আরম্ভ করে অজ্ঞান জনতা– প্রত্যেকে জয়োল্লাসে ফেটে পড়ল! স্বয়ং লক্ষ্মী অবতার জন্মগ্রহণ করেছেন পতিতজনের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে। ওই হিজলগঞ্জে অধর্মের অভু্যত্থান এটুকুই ছিল যে, ভদ্র-সভ্য এবং তথাকথিত আর্যজনেরা সেখানে পা পর্যন্ত মাড়াত না। কিন্তু ধর্মের গ্লানি এতটাই হল যে, গাঁয়ের জমিদারপুত্রের প্ররোচনায় সেই অন্ত্যজ-ভূমির শুদ্ধিকরণ করা হল। ‘ধর্মের নামে প্রণামী’ পড়তে লাগল সদে্যাজন্মা লক্ষ্মীঠাকুরের চার হাতের দৈবীপ্রতিষ্ঠায়। গঞ্জের জমিদারও চার হাতে টাকা কামাতে থাকল ধর্মের সমস্ত গ্লানি রোধ করে দিয়ে, নীচস্থানে নিজের শুদ্ধপদ বিচরণ করে।
লক্ষ্মীর অবতার দেখতে ভেঙে পড়ছে লোক। মেলা বসে গিয়েছে, তার মধে্য ধর্মের নতুন গ্লানি তৈরি হল। তিনজন তরুণ ডাক্তার বেড়িয়ে ফেরার পথে হঠাৎই বিকল হওয়া গাড়ির ঝামেলায় হিজলগঞ্জের এক ছোট্ট হোটেলে আশ্রয় নেয়। ক্রমে তাদের পরিচয় হয় এক পথভোলা উদার পথিকের সঙ্গে। পেশায় সেই পথিক সাংবাদিক এবং ফোটোগ্রাফার– কিন্তু মনে-মনে নিতান্তই অপেশাদার এক অযান্ত্রিক মনের মানুষ। ঠিক যেমন ততটাই অযান্ত্রিক মনস্বী ওই তিন ডাক্তার, অথচ যারা পেশাদারিত্বের জায়গায় ‘অফুলি রোমান্টিক’ এবং ‘ইমোশনালি রেসপনসিবল’।
এই ডাক্তার এবং সেই ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক উত্তাল ভক্ত-সমাগমের পাল্লায় পড়ে চার হাতের লক্ষ্মী-শিশুটিকে অন্যদের মতোই দর্শনার্থী হয়ে দেখতে যায়। ওই তিনজনের অন্যতম ‘ওরফে’ অমরনাথ দত্ত লক্ষ্মীর পা ছুঁয়ে অনিচ্ছুক ভক্তিভাবে বুঝতে পারে, লক্ষ্মীঠাকুরের গায়ে ধুম জ্বর। এই সেই তরুণ ডাক্তারের সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক যাত্রা শুরু। তার উপযুক্ত মানসিক সঙ্গী তার অন্য দুই ডাক্তার বন্ধু এবং সেই ফোটোগ্রাফার। জাগতিক কুটিলতা, গ্রাম্য বিশ্বাস, এবং স্বার্থসন্ধানী, প্রভাবশালী জমিদারের পড়ে যাওয়া জমিদারির প্রতিপূরণী অর্থলোভ– এ সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে ‘ওরফে’ অমরনাথের সংগোপন আরোগ্য-ভাবনা চিকিৎসকের রোমাঞ্চ তৈরি করেছে কৌশিকের ছবিতে।
এই ভয়ংকর যাত্রাপথে ওরফে অমরনাথের একটা অসাধারণ মন্তব্য ছিল এটাই যে– ভারতীয় দেব-দেবীর কারও কারও চার হাত, অথবা চার মাথা। ‘দশানন’ রাবণের তো দশটা মাথা, দুর্গা দশভুজা– তো, হাত-মাথার এই সংখ্যাধিক্য অবশ্যই একটা ‘রূপক’। দশটি মাথা মানে দশদিকে, দশটা বিষয়ে তিনি একইসঙ্গে মাথা খেলাতে পারেন। ‘দশভুজা’ বলতে যিনি দশজনের কাজ একা সামলাতে পারেন। অমরনাথের এই কথাটাই সম্ভবত এই ছবির ‘ফ্রেম অফ রেফারেন্স’; কুসংস্কার এবং ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তির উপায়।
আমরা যারা ভারতের ধর্ম-দর্শন নিয়ে ভাবি, পৌরাণিক দেব-দেবীর অাকার-প্রকার নিয়ে এতদিন যত লেখাজোকা করেছি, তারাও এটাই শাস্ত্রীয়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রথমত নিরাকার-নির্বিশেষ, নির্গুণ পরব্রহ্মের একটা শারীরিক রূপকল্পনাই নাকি দেবতার উপাসকদের কার্য-সাধনের জন্য, এবং ততোধিক তঁাদের বিনোদনের জন্য। এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ শ্লোক– অদ্বিতীয়, এবং চিন্ময়, কলাবিহীন এবং অশরীরী ব্রহ্মের রূপকল্পনা উপাসক-ভক্তদের কার্যসাধনের জন্য– চিন্ময়স্যাদ্বিতীয়স্য/ নিষ্কলস্যাশরীরিণঃ। উপাসকানানাং কার্যার্থং ব্রহ্মণো রূপকল্পনা।
তার মানে দঁাড়ায় যে, ঈশ্বরের একটা শরীর-কল্পনাও কিন্তু মানুষের ইচ্ছাধীন, সেখানে তঁাদের দশ হাত, চতুর্ভুজ, চতুরানন ব্রহ্মা, কিংবা পঞ্চানন শিব অথবা দেবরাজ ইন্দ্রের সহস্রচক্ষু তো অবশ্যই পৌরাণিক রূপকল্প! এবং এই বহু-বাহু, অনেক-মস্তক, অনেক-চক্ষুর দৈব বর্ণনা সতি্যই রূপক বা রূপ-কল্পনা– সেটা সেই চতুর্থ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্য। তিনি ‘আদর্শ’ এক রাজাকে বহু মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রসঙ্গে ইন্দ্রের সহস্রচক্ষুর সত্য উপস্থাপন করেছেন।
‘রামায়ণ’ দেখিয়েছে দেবরাজ ইন্দ্র তঁার গুরুপত্নী অহল্যার সঙ্গে ‘গুরু’ গৌতমের রূপ ধারণ করে রমণ করার ফলে গৌতমের অভিশাপ লাভ করেন। তাতে তঁার সারা গায়ে সহস্র যোনিচিহ্ন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অবশেষে বহু সাধ্য-সাধনা করে গুরুকৃপায় যোনিচিহ্নের বদলে তিনি সর্বাঙ্গে সহস্রচক্ষুর আশীর্বাদ লাভ করেন। তাতে আমরা ‘রূপক’ ভেঙে এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, দেবরাজ ইন্দ্র তঁার সহস্রচক্ষু দিয়ে দেবরাজে্যর সমস্ত খুঁটিনাটির উপর নজর রাখতে পারতেন বলেই তিনি ‘সহস্রচক্ষুঃ’। কিন্তু আমাদের এই রূপক ভাঙা অবোধের বোধমাত্র; কেননা কৌটিল্য হলেন সেই বিশালবুদ্ধি রাজশাস্ত্র-রচয়িতা, যঁার সম্বন্ধে ‘মুদ্রারাক্ষস’-এর নাট্যকার বিশাখ দত্ত বলেছেন– কৌটিল্য যদি ঘুমের মধে্যও বিড়বিড় করে কথা বলেন, তাহলেও তিনি অনর্থক কথা বলেন না– ন হি অনর্থকং কৌটিল্যঃ স্বপ্নে’পি ভাষতে।
কৌটিল্য রামায়ণ-মহাভারত এবং পুরাণ-ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু শাস্ত্রচর্চা তঁাকে এই মহাবুদ্ধি দিয়েছে যে, ধর্মকেও যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করতে হয়, তা না-হলে ‘ধর্মহানি’ হয়– যুক্তিহীন বিচারে ‘তু ধর্মহানিঃ প্রজায়তে’। সেই কৌটিল্য বিজিগীষু রাজার মন্ত্রিপরিষদ গঠন প্রসঙ্গে বলছেন, ইন্দ্র দেবরাজের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছিল একসহস্র ঋষির সমবায়ে। সেই ঋষিদের দিয়েই ইন্দ্র তঁার সমস্ত রাজকীয় কর্ম পরিদর্শন করাতেন বলেই ঋষিরা ছিলেন তঁার চক্ষুস্বরূপ। এজন্যই ইন্দ্রের দু’টি মাত্র চোখ থাকা সত্ত্বেও তঁাকে ‘সহস্রাক্ষ’ বলা হয়, ‘ইন্দ্রস্য মন্ত্রিপরিষদ্ ঋষীণাং সহস্রম্। স তচ্চক্ষুঃ। তস্মাদিমং দ্ব্যক্ষং সহস্রাক্ষমাপুঃ।’
খ্রিস্ট-পূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই যিনি এই বহু চক্ষুর ইঙ্গিতে দেবতাদের চতুরানন-পঞ্চাননের রূপক ভাঙার গান শুনিয়ে গিয়েছেন, তারপরেও এই একুশ-বাইশ শতকের মাঝখানে দঁাড়িয়ে যঁারা যমজ-সম্ভব কাবে্যর (‘কুমারসম্ভব কাব্য’র সঙ্গে কি শ্রুতিসাদৃশ্য পাচ্ছেন?) মধে্য লক্ষ্মীঠাকুরের চার হাত দেখে, গরুর পৃষ্ঠলগ্ন পঞ্চম পদকেও শুধু বিস্ময়-মুকুলিত-নেত্রে অবতার হিসাবে দেখছে, তাদের আমি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের টানটান ‘লক্ষ্মী ছেলে’-র থ্রিলার দেখতে বলি।
এই ছবির অভিনেতারা– জমিদার-পুত্রটি তো বটেই এবং অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রে– প্রত্যেকেই অসাধারণ, শুধু চারজন ছাড়া– অম্বরীশ, ওরফে অমরনাথ, বাবুল সুপ্রিয় এবং লক্ষ্মীর মা। আসলে, এঁরা আর অভিনয়ের জায়গায় নেই, এঁরা বাস্তবের চরিত্র হয়ে গিয়েছেন। এই ছবিতে তাই চতুর্ভুজা লক্ষ্মীর মায়ের নামে বৈদিক বিবাহ-সূক্তের মঙ্গল উচ্চারণ করে বলি, ‘সুমঙ্গলীরিয়ং বধূ রিমাং সমেত পশ্যত’– এই বধূ সুমঙ্গলী।
আপনারা প্রত্যেকে আসুন, দেখুন এই সিনেমা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.