শিবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য: সাধারণ নির্বাচনের দুটো পর্ব সম্পন্ন হয়েছে, যথাক্রমে ১৯ ও ২৬ এপ্রিল। তার সঙ্গে ১৯০টা আসনের ভাগ্য ইভিএম-বন্দি হয়েছে। তীব্র গরমের মধ্যেও লক্ষ লক্ষ নাগরিক মতদান করে গণতন্ত্রের উৎসবে শামিল হয়েছেন এবং ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছেন।
তামিলনাড়ু, পুদুচেরি, কেরল, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর (অসম ছাড়া) সমস্ত লোকসভা আসনে ভোট নেওয়া হয়ে গিয়েছে। অন্যান্য কয়েকটা রাজ্যে আংশিক ভোট নেওয়া হয়েছে। প্রচণ্ড গরমের জন্য ভোট নেওয়ার সময়সীমা সন্ধে ৬টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কর্নাটকে দু’-এক জায়গায় রি-পোলিংয়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তাছাড়া মোটামুটি নির্বাচনে অশান্তি রোখা গিয়েছে। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গের জন্য এই অহিংস নির্বাচন স্বস্তি এনেছে। মতদানের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মতদাতাদের উৎসাহ ২০১৯-এর চেয়ে গড়ে তিন-চার শতাংশ কম।
ভোটের হার সারা দেশে অবশ্যই একরকম নয়। প্রথাগতভাবে, দক্ষিণের রাজ্যগুলোয়, উত্তর-পূর্বের কিছু রাজ্যে এবং পশ্চিমবঙ্গে ভোটের হার এবারও বেশি। প্রথম দফায় সবচেয়ে কম মতদান হয়েছে বিহারে (৪৯.২৬%), দ্বিতীয় দফায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে উত্তরপ্রদেশে (৫৫.১৯%)। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে যথাক্রমে লাক্ষাদ্বীপে (৮৪.১৬%) ও মণিপুরে (৮৪.৮৫%)। লোকসভা কেন্দ্রের নিরিখে গত নির্বাচনের তুলনায় নাগাল্যান্ডে উল্লেখযোগ্যভাবে ২৫% ভোট কমেছে, মথুরায় অভিনেত্রী হেমা মালিনী লড়ছেন এবং সেখানে প্রায় ১২% ভোট কমেছে, সাতটা আসনে ১০%-এর উপরে ভোট কমেছে, ৫৩টি আসনে ৫-১০% ভোট হ্রাস পেয়েছে।
প্রথম দফার ভোটের পর সংবাদমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল মতদান কতটা হ্রাস পেল এবং কেন। দ্বিতীয় পর্বের ভোটে একটু জোয়ার এলেও সন্ধেবেলায় পাওয়া হিসাবে ২০১৯-এর তুলনায় ঘাটতি দেখা গেল। তারপরের দিনের খবরের কাগজে পরিমার্জিত হিসাব পাওয়া গেল না। বেশ ক’দিন বাদে দেখা গেল, নির্বাচন কমিশন একটা পরিসংখ্যান দিয়েছে, যা গতবারের নির্বাচনে দেওয়া পরিসংখ্যানের ফরম্যাট থেকে আলাদা ও সংক্ষিপ্ত। কেন তা করা হল, যথারীতি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আবার শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মতদানে অনুপস্থিত ভোটারের শতকরা হিসাব প্রাথমিক এস্টিমেটের থেকে অনেক কম। তার মানে, মিডিয়ায় যা চর্চার বিষয় ছিল, তা বস্তুত অবান্তর! অতএব সংখ্যাতত্ত্ব থেকে আপাতত নিজেদের সরিয়ে রাখাই শ্রেয়।
এই সমস্ত আলোচনার মূলে রয়েছে রেজাল্ট জানার অদম্য আগ্রহ। নির্বাচন কমিশন ভোটের সাতদফা শেষ হওয়ার আগে কোনও জনমত বা বুথফেরত সমীক্ষা প্রকাশ বা প্রচার করা ‘নিষিদ্ধ’ করেছে। স্বভাবতই মানুষের আগ্রহ আরও বেড়ে গিয়েছে। আপাতত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের অনুমান বা আত্মবিশ্বাস জাহির করছে। তার সঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তঁাদের সুচিন্তিত অথবা পক্ষপাতদুষ্ট মত জানাচ্ছেন। মুশকিল হচ্ছে, পরিসংখ্যান ছাড়া আলোচনা ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। প্রথম দফার পরে তবুও ভোটার টার্নআউট একটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে গিয়েছিল। শ্লথ পরিসংখ্যান প্রকাশ এবং প্রাথমিক অনুমান ও পরবর্তী পরিসংখ্যানে প্রবণতার ফারাক– সব মিলে সমীক্ষকরা ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন। কোনও কোনও টিভি চ্যানেল পুরনো ট্রেন্ড দেখিয়ে যাচ্ছে। হিস্টোরিক্যাল ডেটা-র মূল্য নেই, বলছি না। কিন্তু প্রত্যেকটা নির্বাচন আলাদা।
কয়েক মাস আগে হয়ে যাওয়া তেলেঙ্গানায় বিধানসভার নির্বাচনের আগে, এমনকী পরেও সমীক্ষকরা মানতে রাজি ছিলেন না যে, হায়দরাবাদে পালাবদল ঘটবে। কারণ, বিআরএস এবং তার নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভোট শতাংশের বড়সড় ব্যবধান ছিল পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোয়। হিস্টোরিক্যাল ডেটা-য় বেশি নিমগ্ন থাকলে এখনকার সত্যটা চোখে ভাসে না, এটা তারই একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ।
প্রচারের থিম ও গতিপ্রকৃতি সকলের সামনেই রয়েছে। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ইভিএম সম্পর্কে অনেক জল্পনার অবসান ঘটল। এ নিয়ে রাজনৈতিক উতোরচাপান প্রচারের অঙ্গ হয়ে গেল। এই রায়ের পর বর্তমান শাসক দলের ঝঁাজালো বক্তব্যে জনতা হয়তো ভুলেই যাচ্ছে, ইভিএম কংগ্রেস শাসনের অবদান। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইস্তাহার প্রকাশ করে থাকে, যার দু’-একটা পয়েন্ট নিয়ে সবসময়ই আলোচনা-পর্যালোচনা হয়। যেমন, রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা হটানো বিজেপির পুরনো সংকল্পপত্রে জায়গা পেত আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিত। অন্তত, সাধারণ ভোটারের কাছে ইস্তাহারের প্রাসঙ্গিকতা এইটুকুই। এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। এপ্রিলের ৪ তারিখে কংগ্রেসের ন্যায়পত্র প্রকাশ পেল। তার অব্যবহিত পরেই যথারীতি প্রতিপক্ষর বিরূপ মন্তব্য শোনা গেল। নির্বাচনের প্রচারে অল্পবিস্তর এর প্রতিফলন দেখা গেল, সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ পোস্ট বা ভিডিওয়।
১৯ তারিখে প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন হতেই এবং মতদাতাদের নিরুৎসাহ হওয়ার তত্ত্ব সামনে আসতেই নির্বাচনী প্রচার আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। কংগ্রেসের ইস্তাহার নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে শাসক দল সরব হল। সম্পদ পুনর্বণ্টন, উত্তরাধিকার কর, মঙ্গলসূত্র অপহরণ এবং এক বিশেষ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর তোষণের সমূহ বিপদ নাকি কংগ্রেস দলের ন্যায়পত্রের নিহিত সত্য। এরই মধ্যে এককালের ভারত সরকারের পছন্দের ‘টেকনোক্র্যাট’ স্যাম পিত্রোদা আমেরিকার উত্তরাধিকার ট্যাক্সের উদাহরণ এনে রাজনীতির আবহাওয়া আরও গরম করে দিলেন। যাই হোক, সাধারণত অপঠিত ও অল্পচর্চিত এই ম্যানিফেস্টো এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচনী প্রচারে বড় ভূমিকা নিল। এমনকী, ধর্মীয় মেরুকরণের আশঙ্কাও উঠে এল।
প্রশ্ন হল, দেশের সংবিধান যখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শের কথা বলে, তখন নাগরিকদের সম্পদের মূল্যায়ন করা কি বিপজ্জনক? আর এই নিয়ে সম্যক আলোচনার স্থান কি জনসভা? ন্যায়পত্রে সত্যি কী বলা হয়েছে, আর কী-কী পারসেপশন তৈরি হচ্ছে– প্রথমে এই দুটো আলাদা করা দরকার। যাই হোক, তীক্ষ্ণ শব্দাবলি, তীব্র শ্লেষ ও আসন্ন বিপদের সতর্কতার পরে দ্বিতীয় পর্বে সারা দেশে গড়ে ৬৬.৭১% মতদাতা উপস্থিতি দাখিল করলেন, প্রথম দফায় যা ছিল ৬৬.১৪%; মানে ০.৫৭% বৃদ্ধি। সংখ্যাতত্ত্বর নিরিখে এই হেরফের কি গুরুত্বপূর্ণ? পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে ৫.৩৩% ভোটার টার্নআউট কমেছে, যা ‘স্ট্যাটিসটিক্যালি সিগনিফিক্যান্ট’ বলে মনে করা যেতে পারে।
পরিসংখ্যানের সূত্র
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ৩০/৪/২০২৪ তারিখের প্রেস নোট
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.