বামপন্থীদের জনপ্রিয় একটি স্লোগান: ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব, বিপ্লব আনে মুক্তি’। এই স্লোগানের ভাল-মন্দ নিয়ে তর্কে না-গিয়েও একটি প্রশ্ন তোলা যায় দীর্ঘদিনের বামশাসিত, শিক্ষার হারে দেশের প্রথম সারিতে থাকা, কেরলের হালের ঘটমানতায়। সত্যিই কি শিক্ষা চেতনা আনে? খবরে প্রকাশ, কেরলের মানুষ এখন শেষকৃত্যে বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রস্তুত। এটাই ‘ট্রেন্ড’। এবং কখনওসখনও সেই খরচ পৌঁছে যাচ্ছে দশ লক্ষ টাকার অঙ্কেও!
কেরল থেকে প্রবাসী হওয়ার প্রবণতা প্রবল। ফলে আর্থিক সংগতি যাদের আছে, তারা এই চলতি হাওয়ায় গা ভাসাচ্ছে। অথচ বছর দশেক আগেও অন্তে্যষ্টিক্রিয়ার আচার-অনুষ্ঠানে অসম্ভব সংযম প্রদর্শন করত কেরলবাসী। তা ছিল পরিবেশ-বান্ধব, পকেট-বান্ধবও। অহরহ ছবি তোলা, ভিডিওগ্রাফি করা হত না। অ্যাম্বুল্যান্স, শববাহী গাড়ি, শ্মশান বা কবরস্থানের খরচ, প্যান্ডেল, অতিথি আপ্যায়ন– সব মিলিয়ে গড়ে দশ-পনেরো হাজার টাকা ব্যয় হত। তাহলে কি এখন খরচের বাহুল্য প্রাচুর্যের উৎকট প্রদর্শন বলেই ধরে নিতে হবে? না কি এ হল দীর্ঘদিন ধরে প্রিয়জনকে দূরে সরিয়ে রাখার ‘অপরাধবোধ’ ও তজ্জনিত ‘ক্ষতিপূরণ’? কারণ যাই হোক, এখন গাড়ির কনভয়, দামী কফিন, শ্মশানযাত্রার রাজকীয় আয়োজন– সর্বত্রই আড়ম্বরের ছবি, যা অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষিত মানুষের সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
মানুষ যতই শিক্ষিত হোক না কেন, ব্যবহারিক জীবনে আজন্মলালিত ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন। বিশেষত, ভারতের মতো দেশে। তাই কে-কী ধর্মীয় আচার পালন করবে, তা প্রশ্নাধীন নয়। এটা যে কোনও মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। এমনকী, পৈতৃক বা নিজের রোজগারে কীভাবে শেষকৃত্য হবে, সেটাও অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। কিন্তু রুচি? শেষকৃত্যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের নেপথে্য কী যুক্তি থাকতে পারে? যে টাকা অন্য কোনও সামাজিক কল্যাণকর কাজে লাগানো যেতে পারত? একজন ‘শিক্ষিত’ মানুষের কাছে সেটাই তো প্রত্যাশিত। বিশেষত, কেরলের মতো ‘শিক্ষিত’ রাজ্যে!
কেরল রাজ্য হিসাবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের থেকে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে, এ-কথা অস্বীকার করাও বাতুলতা হয়ে যায়। সেই প্রগতিকে নস্যাৎ করা যায় না। কিন্তু প্রদীপের নিচের অন্ধকারকে এড়িয়ে যাওয়াও তো কাজের কথা নয়। যে-রাজ্য শিক্ষায়, চেতনায় এগিয়ে থাকার বড়াই করে, সেখানে এমন পশ্চাদ্পসারী চর্চা বহাল থাকা কী বার্তা দেয়? কেরলের বন্যার সময় কেরলের অনেক বিত্তশালীই এগিয়ে এসেছিলেন বিধ্বস্তদের পুনর্বাসনের কাজে। সেই একই রাজ্যে শেষকৃত্যে বিত্তের এমন প্রদর্শন চিন্তা বাড়ায়। ভাবতে বাধ্য করায়, শিক্ষায় এগিয়ে থাকা কেরলেই যদি সংস্কারের চেহারা এমন হয়, তাহলে তুলনায় ভাবনায় পিছিয়ে-থাকা রাজ্যগুলিতে কী অবস্থা হতে পারে! শিক্ষার বিকাশ শুধু মার্কশিটে আবদ্ধ থাকলে সেই শিক্ষা অন্ধকারে জোনাক হতে পারবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.