সুতীর্থ চক্রবর্তী: মৌলবাদীদের সঙ্গে ‘জোট’ হবে কি হবে না, সিপিএমে (CPM) এই প্রশ্ন নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই কমিউনিস্টরা এই বিতর্ক করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সুবিধা বুঝে তারা মৌলবাদীদের সঙ্গে জোট করেছে। আবার, যখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তখন সেই জোট ভেঙে দলের মধ্যে তাত্ত্বিক বিতর্ক করেছে। কমিউনিস্টদের একটা সুবিধা হল: যখন যে-কৌশলটা তাদের প্রয়োজন হয় না, তখন সেটাকে তারা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে আস্তাকুঁড়েয় ছুড়ে ফেলে দেয়। আবার, রাজনৈতিক প্রয়োজন ও সুবিধা দেখা দিলে এর বিপরীত কাজটি করতে তারা দ্বিধা করে না।
কেরলে ১৯৮৫ সালে যখন মুসলিম লিগের (Muslim League) সঙ্গে সিপিএম জোট ভেঙে দিল, তখন বলা হয়েছিল, মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে জোট বাঁধা একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল। ওই ভুলের দায় এম. ভি. রাঘবনের উপর চাপিয়ে তাঁকে দল থেকে বিতাড়িত করেছিল সিপিএম। সেই সিপিএম আবার এখন মুসলিম লিগের সঙ্গে কেরলে জোট বাঁধার তোড়জোড় করছে! ১৯৮৫ সালে যে মুসলিম লিগকে সিপিএম ‘মৌলবাদী’ ঘোষণা করেছিল, পরে আবার নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে তাদেরকেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ইন্ডিয়ান মুসলিম লিগ-কে ‘এলডিএফ’ তথা বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে গ্রহণ করা হবে কি না, তা নিয়ে এবারও কেরল সিপিএমে জোর বিতর্ক হয়েছে। নবতিপর ভি. এস. অচ্যুতানন্দন ‘আইইউএমএল’-এর সঙ্গে জোটের ঘোর বিরোধী। জোটের পক্ষে ছিলেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।
যখন যেটা সুবিধা, সেই নীতি গ্রহণে সিপিএমের জুড়ি নেই। তাতে অবশ্য তারা যে সবসময় রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনটা নয়। সিপিএমের সাম্প্রতিক ব্রিগেড সভার চরিত্র দেখে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা কেন এটা করছেন, তা বোধগম্য নয়। হাতেগরম কেরলের উদাহরণ সবার সামনেই রয়েছে। ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে যে সংযুক্ত মোর্চা তৈরি হয়েছে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির ‘ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’-এর সঙ্গে সিপিএমের জোট বাঁধায় অবাক হয়ে যাওয়ার কোনও উপাদানই নেই। এই জোট বাঁধাকেই আবার ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলতে সিপিএমের সময় লাগবে না।
প্রাসঙ্গিক হওয়ার লক্ষ্যে সিপিএম গত কয়েক বছর ধরে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও কিছুই সাধারণ মানুষের কাছে দলকে ফের নিয়ে যেতে পারছে না। সাধারণ মানুষ বলতে খেতে-খামারে, কলকারখানায় থাকা মানুষ এবং শহর ও গ্রামের সাধারণ দরিদ্র জনতা। বামদের থেকে যারা এখন অনেক দূরে অবস্থান করে। এই মেহনতি ও দরিদ্র মানুষই ছিল একদা এই রাজ্যে কমিউনিস্টদের সমর্থনের ভিত্তি। যবে থেকে এই দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ সিপিএমের পাশ থেকে সরে গিয়েছে, তবে থেকেই সিপিএমের ভোটের সাফল্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের এই জন-ভিত্তি বা সমর্থন-ভিত্তি যখন গড়ে উঠেছিল, তখন তা রাতারাতি তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে দীর্ঘ লড়াই এবং আন্দোলনের ফসল ছিল সেই জন-ভিত্তি। ৩৪ বছর সরকারে থাকার দৌলতে যার ক্ষয় ধীরে ধীরে হয়েছে। একথা অস্বীকারের কোনও উপায় নেই, যারা একদা সিপিএমের সমর্থন-ভিত্তি ছিল, যে মানুষগুলো একসময় সিপিএমকে নিজের দল মনে করত, তারা-ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (mamata Banerjee) জনপ্রিয়তার এই তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছে।
সাধারণ রাজ্যবাসীর সেই সমর্থন রাতারাতি সিপিএমের কাছে ফের ফিরে যাওয়ার কোনও কারণ ঘটেনি। রাজ্যে দশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও সিপিএম এমন কোনও গণ আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি, যা তাকে ফের মেহনতি ও গরিব মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। বরং দশ বছরে মানুষ সিপিএমের থেকে আরও দূরেই চলে গিয়েছে। রাজ্যে পরপর ভোটের ফলে তা প্রমাণিত। বামদের ভোট কমতে কমতে রাজ্যে গত লোকসভা নির্বাচনে সেটা ৭ শতাংশে নেমে দাঁড়িয়েছে। শহর ও মফস্সলের যে-মধ্যবিত্তরা শেষ পর্যন্ত বামদের সঙ্গে টিকে ছিল, তাদের বড় অংশও গত লোকসভা ভোটে বিজেপির দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। এটা নিয়ে কারও সংশয় নেই। বিষয়টি কারও অজানাও নয়।
লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে-সমর্থন সিপিএমের ফেরানোর কথা ছিল, সেটাই শর্টকাটে ফিরে পেতে কি পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির (Abbas Siddiqui) সঙ্গে জোট বাঁধা? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো পরে মিলবে। বিধানসভা ভোটের ফল দেখার পর সিপিএম যদি দেখে রাজনৈতিক লাভ হয়নি, তাহলে নানা যুক্তি দেখিয়ে এই আব্বাসদের দূরে ঠেলতে সময় লাগবে না। দলের একাংশ তখন ‘আদর্শ’ নিয়ে বিতর্ক শুরু করবে। কোনও একজন নেতাকে চাঁদমারিও করা হতে পারে। এইভাবেই সিপিএম আগাগোড়া রাজনীতি করে এসেছে।
কমিউনিস্টরা তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। সমাজতন্ত্রী চিন-সহ ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়ার মতো দু’-একটি দেশ ছাড়া প্রায় সর্বত্র ভেঙে পড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব বিশ্বে লুপ্তপ্রায়। সর্বত্রই কমিউনিস্টদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। কারণ, কমিউনিস্টরা কোনও দেশেই কতগুলো মৌলিক প্রশ্নের কোনও সদু্ত্তর দিতে পারেনি। কমিউনিস্টরা ধর্ম নিয়ে তাদের অবস্থান কোথাওই স্বচ্ছভাবে ঘোষণা করতে পারেনি। এই অবস্থান দেশ-কাল-সময় ভেদে বদলেছে। ফলে ধর্মভিত্তিক দলগুলি বা সোজাকথায়, মৌলবাদীদের সম্পর্কে তাদের কী অবস্থান হবে, সে বিষয়ে কমিউনিস্টরা স্পষ্ট পদক্ষেপ করতে পারেনি। সিপিএমের ক্ষেত্রে তো এটা আরও ভীষণভাবে সত্যি। মুখে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে গিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধার প্রয়োজনে তারা বহু ক্ষেত্রেই মৌলবাদী ও তথাকথিত সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে কখনও প্রকাশ্যে, কখনও গোপনে বোঝাপড়া করেছে। বিজেপিকে সিপিএম এখন সাম্প্রদায়িক বলে। কিন্তু রাজীব গান্ধীর আমলে যখন বিজেপির সঙ্গে তারা গোপন বোঝাপড়া করেছিল, তখন বলা হয়েছিল ক্ষমতায় রাজীবের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙার জন্য এটা জরুরি। পরে আবার সেই কংগ্রেসই সিপিএমের বড় বন্ধু!
পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোটের ক্ষেত্রে হয়তো এখন কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধার বিষয়ে সিপিএম আশা করছে। লোকসভা ভোটে তারা বুঝে গিয়েছিল তাদের শেষ সম্বলটুকু রামের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছে। ফলে তারা এখন রহিমদের সন্ধানে নামতে চাইছে। সাচার কমিটির রিপোর্টের পর যারা তাদের থেকে আরও দূরে চলে গিয়েছিল। ব্রিগেডের সমাবেশে পিরজাদার সঙ্গে জোটের চটজলদি সাফল্য দেখা গিয়েছে। ব্রিগেডের সাফল্য ব্যালটে দেখা যাবে কি না, তার গ্যারান্টি নেই। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, সিপিএম সামান্য কিছু ভোটের জন্য এইভাবে জাত খোয়াল কেন? কথা হচ্ছে, সিপিএম যে কখনওই এই জাত খোয়ানোটাকে গুরুত্ব দেয়, এমনটা নয়। রাজনীতিতে একমুখে এককথা বলার রেওয়াজ নেই। সিপিএম সেই রেওয়াজটা কঠোরভাবে মেনে চলে। তাদের চোখে আজ যারা ধর্মনিরপেক্ষ, কাল তারা সাম্প্রদায়িক হয়ে যেতেই পারে। সবটাই নির্ভরশীল রাজনৈতিক সাফল্যের উপর। মুখে না স্বীকার করলেও, ‘যো জিতা ওহি সিকান্দর’ নীতি যে সিপিএমের রাজনীতির মূলমন্ত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে সিপিএমের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যাঁরা বিতর্ক করছেন, তাঁরা অযথা সময় নষ্ট করছেন। কেউ কেউ মার্কসবাদ, লেনিনবাদ উদ্ধৃত করে সিপিএমকে উপদেশ দিচ্ছেন। এটা অত্যন্ত হাস্যকর একটি প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.