সুতীর্থ চক্রবর্তী: যে মাধ্যমিকে ফেল করেছে সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে কীভাবে? দমদম কেন্দ্রে তাঁর বাম প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের সৌগত রায় সঠিক প্রশ্নটিই করেছেন। সৌগতবাবুর প্রশ্ন শুনে দেখলাম বেজায় গোসা করলেন বাম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য। সত্যিই তো, তিন বছর আগে দমদম লোকসভার অধীন রাজারহাট-গোপালপুর বিধানসভা কেন্দ্রর ভোটে যিনি হেরে গিয়েছেন, তিনি কীভাবে লোকসভার প্রার্থী হন? এ তো মাধ্যমিকে ফেল করে উচ্চ মাধ্যমিকে বসার মতোই ব্যাপার। রেগে গেলে কী করে চলবে নেপালদেববাবু?
৩৮ বছর আগে নেপালদেববাবু রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন। তারপর আর কোনও ভোটে জেতেননি তিনি। তাঁকেই কেন ফের দমদমে প্রার্থী করার দরকার পড়ল সিপিএমের? একদা বামপন্থীদের ঘাঁটিতে এখনও যে অল্পসংখ্যক বামমনস্ক মানুষ রয়ে গিয়েছেন, তাঁরা যে সিপিএমের এই সিদ্ধান্তে হতাশ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটা বামেদের হাত থেকে আগেই ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। ফলে দমদম-সহ সব কেন্দ্রেই যে বামেদের লড়াই তৃতীয় স্থান দখলের, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের। তাহলে খামোকা এমন কাউকে প্রার্থী করা কেন, যিনি শেষবার ভোটে জিতেছিলেন আটের দশকে, তাও রাজ্যসভায়? এই রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বামেদের লোকসভা ভোটে লড়াই কার্যত ‘প্রতীকী’। এই প্রতীকী লড়াইতেও কেন বামেরা বুড়ো ঘোড়াদের এগিয়ে দিল, তা এখন রাজনৈতিক মহলে চর্চার বিষয়। যাদবপুরে কি খুব প্রয়োজন ছিল বিকাশ ভট্টাচার্যকে প্রার্থী করার? আইনজীবী হিসাবে তাঁর একটা খ্যাতি রয়েছে। শহরের প্রাক্তন মেয়রও তিনি। ভোটে তিন বা চার নম্বরে শেষ করা কি তাঁর সম্মানের পক্ষে হানিকর নয়? ঠিক যেভাবে গত ভোটে সম্মানহানি হয়েছিল রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তর।
এবার লোকসভায় রাজ্যে যে ক’টি কেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত বামেরা প্রার্থী দেবে, সেখানে সবক’টিতেই অনায়াসে তারা তরুণ ও নতুন মুখ আনতে পারত। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। রাজ্যে যে আর কোনও দিন বামেদের সুদিন ফিরবে না, সে কথাও বলা যায় না। যে কোনও রাজনৈতিক দলকে তো অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। বামেদের এখন সেই লড়াই। তরুণ ও নবাগতদের পরিচিতি করে দেওয়ার জন্য এবারের লোকসভা ভোটই তো ছিল বামেদের কাছে সেরা সুযোগ। কেন নেপালদেববাবু, বিকাশবাবুদের বদলে দমদম, যাদবপুরে বামেরা তরুণদের প্রার্থী করবে না? নতুনকে গ্রহণ করার বিষয়ে এই অনীহাই বামেদের আরও অপ্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছে। দমদম ও যাদবপুরের বহু বামমনস্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই বলছেন, যেখানে জয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই সেখানে প্রবীণদের প্রার্থী করা কেন? বহু বামমনস্ক মানুষ এবার এতটাই হতাশ যে, তাঁরা বুথমুখো হবেন না। অনেকে বলছেন, ভোট দেবেন ‘নোটা’-য়। নোটার ভোট যে এবার বাড়ছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সংশয় নেই বামেদের ভোট আরও কমে তলানিতে চলে যাওয়া নিয়েও।
কয়েক দিন আগে ব্রিগেডে বামেদের সভাতেও দেখা গিয়েছিল এক ছবি। মাঠে যতই তারুণ্যের আধিপত্য থাক, মঞ্চের দখল ছিল সেই বৃদ্ধতন্ত্রের হাতেই। সেই মুখগুলোই মঞ্চে দেখা যাচ্ছিল, যাঁদেরকে ৩৪ বছরের বাম জমানায় মানুষ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। যদিও মাঠে এবার এমন মুখ ছিল যাঁদের ৩৪ বছরে দেখা যেত না। কিন্তু মঞ্চে তাঁদের কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তারুণ্যের প্রতীক হিসাবে ব্রিগেডে আগাম নাম ঘোষণা করা হয়েছিল কানহাইয়া কুমারের। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত আসেননি। ভোটেও দেখা যাচ্ছে এক ছবি। নতুন মুখ তুলে ধরার কোনও চেষ্টাই নেই বাম শিবিরের। জলপাইগুড়ি থেকে ধার করে নিয়ে গিয়ে কোচবিহারে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী করল গোবিন্দ রায়কে। যাঁকে আমরা ৪০ বছর ধরে নানা ভোটে প্রার্থী হতে দেখছি। রানাঘাটে তৃণমূলের প্রার্থীর বয়স এখনও ২৫ হয়নি। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে সিপিএম দাঁড় করাল প্রবীণা রমা বিশ্বাসকে। যিনি এবার পঞ্চায়েতের ভোটেও জিততে পারেননি। দক্ষিণ কলকাতায় বামেদের লড়াই অনেকটা জমানত রক্ষার। কিন্তু সেখানেও দাঁড় করানো হল না কোনও নতুন মুখকে। নন্দিনী মুখোপাধ্যায় আগে দাঁড়িয়েও হেরেছেন। মাঝে পাঁচ বছর তাঁকে দক্ষিণ কলকাতায় কোনও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি। তবুও তিনি ফের ফেরত এসেছেন ভোটে। কেন তাঁকে বামমনস্করাও ভোট দেবেন? বহু বামপন্থী বিদ্রুপ করে বলছেন, ভাগ্যিস রবীন দেব, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়রা আবার প্রার্থী হননি!
এবারের লোকসভা ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ বামেদের কাছে। কারণ স্বাধীনতার পর এই প্রথম বামেদের লড়াই দেশের সংসদে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এবার বামেরা সম্ভবত শূন্য হয়ে যাবে। একই অবস্থা ত্রিপুরাতেও। কেরলেও এবার প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। দেশের অন্য কোনও রাজ্য থেকে বামেদের কেউ জেতার জায়গায় রয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। বিহারের বেগুসরাইতে কানহাইয়া কুমার লড়াইয়ে থাকতে পারেন। ২০০৪ সালে বামেরা লোকসভায় ৬১টি আসনে জিতেছিল। মাত্র ১৫ বছরে তারা প্রায় বিলুপ্তির মুখে। কেরলে খুব ভাল ফল হলেও সংখ্যাটা দুই অঙ্কে পৌঁছাবে না। খারাপ ফল হলে তো কথাই নেই। রাহুল গান্ধীর হাত ধরে বামেদের অস্তিত্ব টেকাতে মরিয়া সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাহুলও বামেদের বিলুপ্তি নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.