বোরিয়া মজুমদার: খেলার বিস্তার সর্বব্যাপী। আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি, তা আপনাদের ভাবনায় ফেলতেই পারে। মনে হতেই পারে, নির্বাচনের মরশুমে আমাদের জীবনে খেলাধুলোর প্রভাব কীভাবে সর্বব্যাপী হতে পারে? হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, আমরা কেউ কেউ, যারা খেলাধুলো ভালবাসি, তারা ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ অনুসরণ করছি, নজর রাখছি IPL-এও। কিন্তু তাতেই তো আর খেলা সর্বব্যাপী হয়ে যায় না। বরং, আমাদের আশপাশে তাকালেই বোঝা যাবে- আদতে যা সর্বত্র বিরাজমান, তা হল রাজনীতি। যেভাবে বাংলায় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল ভিন্ন ভিন্ন সৃজনশীল স্লোগানে একে-অপরকে টেক্কা দিয়ে চলেছে, দেখে আন্দাজ করছি– প্রকৃতপক্ষেই বাংলা একটি মোড়ঘোরানো নির্বাচনের সাক্ষী হতে চলেছে। এবং এখানেই খেলাধুলো সর্বব্যাপী, বা বলা ভাল, খেলার ভাষা। অনেকেই হয়তো জানেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পদ্ধতিকে আমরা অনেকসময় ‘রেস’ বলে থাকি– প্রেসিডেন্সিয়াল রেস। ‘রেস’ শব্দটি খেলার দুনিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী শব্দচয়নে তা জায়গা করে নিয়েছে।
বর্তমানে বাংলার নির্বাচনী ভাষ্যে ব্যবহার করা অনেক শব্দই খেলাধুলো থেকে উদ্ভূত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (WB CM Mamata Banerjee) হোন বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Narendra Modi)– দু’জনেই ‘খেলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন একাধিক মুক্তমঞ্চে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘খেলা হবে’ স্লোগানের উত্তরে মোদি নির্বাচনী মঞ্চে ‘খেলা শেষ’ বলে জবাব দিয়েছেন। এখানেও কিন্তু খেলাধুলোর ভাষা নির্বাচনের আখ্যান নির্মাণ করছে। বাস্তবে ‘খেলা হবে’ বনাম ‘খেলা শেষ’– এই দু’টি স্লোগানের দ্বন্দ্বই দু’জন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাশালী জননেতার যুযুধান লড়াইকে ব্যাখ্যা করছে। দু’জনেই গ্যালারির দিকে চোখ রেখে খেলছেন, দু’জনেই খেলছেন জনপ্রিয়তার নিরিখে, দু’জনেরই খেলার অঙ্গ জনতা। এই নির্বাচন বিজেপি বনাম তৃণমূলের ‘খেলা’ নয়, এই ‘খেলা’ মোদি বনাম মমতার।
তিনটে বিষয় খেলার সঙ্গে জুড়ে থাকে, যার মধ্যে প্রথম হল ‘ফেয়ার প্লে’, বা নিয়ম মেনে খেলার চেতনা। বাংলায় ভোটদান গতকাল থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে। সুতরাং, এই মুহূর্তে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সামনে এটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু। নির্বাচন হওয়া উচিত পরিচ্ছন্ন এবং যথাযথ, জনগণের ভোটাধিকার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হওয়া কাম্য। তা না হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হিংসা অনিবার্য। জোরজুলুম, কারচুপির অভিযোগ-পালটা অভিযোগ চলতেই থাকবে, বিকৃত হবে রাজনৈতিক আখ্যানের পবিত্রতা। খেলাধুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত এই নৈতিক উপমা-ই রয়েছে এই নির্বাচনের মূলে। প্রথম দফার নির্বাচনের পর প্রাথমিক প্রশ্নই এটা– নির্বাচন স্বচ্ছ হচ্ছে তো? কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থেকে শুরু করে অন্যান্য যাবতীয় প্রক্রিয়ার আদত উদ্দেশ্য তো সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা।
খেলাধুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত যে দ্বিতীয় বিষয়টি এক্ষেত্রে জরুরি, তা হল– বিরোধীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাই থাকুক, এই শ্রদ্ধা অটুট থাকা বাঞ্ছনীয়। আপনি খেলার মাঠে সবচেয়ে শত্রুভাবাপন্ন প্রতিপক্ষ হতে পারেন, কিন্তু কোনও অজুহাতেই অনুগ্রহ, মর্যাদাবোধ এবং সম্মানের পথ থেকে সরে এলে চলবে না। এই প্রসঙ্গেই একটি অত্যন্ত নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি– এই নির্বাচনে নূ্যনতম মর্যাদাবোধও অবশিষ্ট নেই। রাজনৈতিক বক্তৃতায় যে ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা এতটাই বৈরিতাপূর্ণ, যে রীতিমতো অশালীন ঠেকছে কানে। তা সে ‘খেলা হবে’ হোক অথবা ‘খেলা শেষ’। জনাদেশের উপর ভিত্তি করেই তো নির্বাচন। যে নির্বাচনী ভাষায় মানুষকে অমর্যাদা করা হয়, আক্রমণ করা হয়– সেই ভাষা হিংস্র এবং ক্ষতিকারক। খেলাধুলো থেকে এই শিক্ষা পাওয়া যায়, আর এই শিক্ষার অভাব আমরা বিশেষভাবে টের পাচ্ছি চলতি নির্বাচনের মরশুমে।
তৃতীয়ত, খেলাধুলোর প্রধান শর্ত, প্রস্তুতি। কারণ দলের প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে দলের শক্তি। শচীন তেন্ডুলকর সবসময় আমাকে বলতেন– ‘খেলার সময় আপনি ইয়র্কারের সামনে পড়ে সেই বলেই আউট হয়ে যেতে পারেন, কারণ খেলা মানেই অনিশ্চয়তা। কিন্তু আপনাকে নিশ্চিত থাকতে হবে, আপনি আপনার সেরাটা দিয়েছেন, তারপরও কপাল মদত দেয়নি। নিজেকে তৈরি রেখে নিজের সেরাটা উগরে দেওয়ার কোনও বিকল্প নেই।’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সমস্ত রাজনৈতিক দলকেও এই একই কথা মাথায় রাখতে হয়। প্রত্যেকে নিজেদের সাধ্যমতো প্রস্তুত হয়েছে আসন্ন লড়াইয়ের জন্য। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য নিজেদের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে যতটা সম্ভব সৃজনশীল থাকার চেষ্টা করেছে তারা। এরপরও যদি প্রতিকূলতা ধেয়ে আসে, তাহলে তাদের হাতে আর কিছু থাকবে না। তবে তাদের অবচেতন মনে নিজেদেরকে বলতে হবে যে, তাদের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে– এর চেয়ে বেশি করণীয় কিছু নেই।
পরিশেষে, সমস্ত খেলাধুলোর সারকথাই হল কঠোর পরিশ্রম। শৃঙ্খলা এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা খেলাধুলার প্রধান হাতিয়ার। এবং এই নির্বাচনও ঠিক তেমন। একবার দেখে নিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি পায়ে চোট পাওয়ার পরও তাঁর ভোটারদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টায় রাজ্যজুড়ে অক্লান্ত প্রচারসভা করে গিয়েছেন। এক অনুকরণীয় শৃঙ্খলা এবং কঠোর পরিশ্রমের নমুনা দেখিয়েছেন তিনি। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও দেখুন। তিনি তাঁর দলের প্রচারে গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ উপেক্ষা করে একদিনে একাধিক গন্তব্যে সফর করেছেন, প্রচার চালিয়েছেন।
এই পরিশ্রমী নেতাদের কাছ থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। আমরা তাঁদের পছন্দ করি বা না করি, তাঁদের সমর্থনে ভোট দিই বা না দিই, তাঁরা এক অর্থে আমাদের ‘রোল মডেল’। আপাতদৃষ্টিতে খেলার সঙ্গে যুক্ত কঠোর পরিশ্রম ও শৃঙ্খলাই তাঁদের চালিকাশক্তি। আমরা মতাদর্শগতভাবে তাঁদের বিরোধী হতে পারি, কিন্তু তাঁদের কঠোর পরিশ্রমকে অস্বীকার করতে পারি না। একদিনে একাধিক জায়গায় ঘুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে যাওয়া সহজ নয় এবং আমাদের প্রত্যেকের উচিত এঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া। নির্বাচনে হার-জিত তো আছেই, তবে ফলাফলের ভিত্তিতে এই দুই নেতার কঠোর পরিশ্রমকে অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
বাংলার ভোটের মরশুমে দাঁড়িয়ে আমি চাইব– সেরা দলের জয় হোক। খেলাধুলোর মতোই নির্বাচন একটি প্রতিযোগিতা, যেখানে একপক্ষ জিতলে অপরপক্ষের হার অবধারিত। যে পক্ষই জিতুক, জনগণের রায় যার দিকেই যাক না কেন– তা সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা এবং গ্রহণ করে নেওয়াই আমাদের কর্তব্য। পরাজিত দলের প্রতিও আমাদের সমান মর্যাদাপূর্ণ আচরণ কাম্য। এটাই খেলার সারমর্ম। ‘খেলা হবে’ বা ‘খেলা শেষ’ ক্রমাগত বলে চলার পরেও খেলার চেতনা যাতে কখনওই লঙ্ঘন করা না হয়– তা নিশ্চিত করার দায় আমাদের উপরই বর্তায়। আশা করি, প্রতিটা দল তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে, কারণ বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাসে আমরা প্রবেশ করছি। আসুন না, সবাই মিলে জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে খেলার চেষ্টা করি । আসুন না সুস্থ নাগরিক হয়ে খেলি। খেলা হোক। খেলা শেষও হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন খেলার ছলে আমাদের চেতনা চিরতরে ধ্বংস না হয়। আগামী কয়েক সপ্তাহের নির্বাচনের জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের জন্য রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.