নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফরে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল, পাকিস্তানের ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়া। রাষ্ট্রসংঘের ভাষণে নাম না-করে মোদি নিশানা করেন পাকিস্তান ও চিনকে। চিনের বিরুদ্ধে যে কোনও অক্ষেই ভারতের কৌশলগত সহযোগিতা আমেরিকার কাছে কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে কমলা হ্যারিস কি ফের মোদিকে শ্লেষ ছুড়ে দিতেই কাশ্মীর নিয়ে করা মন্তব্যকে স্মরণ করাতে চাইলেন? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবতী
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi)৬৫ ঘণ্টার মার্কিন সফরে ভারত কী পেল, তা নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তুমুল আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। এটা হওয়ারই ছিল। দীর্ঘ দু’বছর বাদে মোদি আমেরিকা গেলেন। অতিমারীর মধ্যে এই দু’বছরে আমেরিকার রাজনীতির পটপরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ট্রাম্প যুগের অবসান ঘটেছে। বাইডেন-হ্যারিস জুটি ক্ষমতায় এসেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সঙ্গে এটাই ছিল মোদির প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। কোভিড পরিস্থিতি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের আধিপত্য বিস্তার এবং সর্বোপরি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালিবানের দখলে আফগানিস্তানের চলে যাওয়া- এই তিন প্রেক্ষাপটেই মোদির এই সফর অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সফরের গোড়াতেই মোদি আমেরিকার পাঁচটি ক্ষেত্রের পাঁচটি বড় কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আলাদা আলাদাভাবে এই পাঁচ সিইও মোদির সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলেছেন। বৈঠকের পর প্রত্যেকেরই ভারতে লগ্নির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ ইতিবাচক ঘটনা। চিনকে এড়াতে মার্কিন সংস্থাগুলি যে ভারতে লগ্নির ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়াচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনও অবকাশ নেই। ভারতের পক্ষে অচিরে তা আরও ভাল বার্তা আনার সহায়ক হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয়তা নিশ্চয়ই কিছুটা আশা জোগায়। কারণ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে মোদির কোনও টোটকা এখনও কাজ দেয়নি। দেশে বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান। নতুন কলকারখানা স্থাপন ও লগ্নি আশাপ্রদ নয়। দেশের অর্থনীতির যখন এই তমসাচ্ছন্ন অবস্থা, তখন আমেরিকায় গিয়ে মোদি যে শিল্পকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক ফেরি করবেন, সেটাও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
পাঁচ সিইও-র সঙ্গে সাক্ষাতের পর ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের সঙ্গে মোদির হইচই ফেলে দেওয়া বৈঠক কূটনৈতিক মহলে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ওই বৈঠক শুরুর সময় মোদি ও হ্যারিস পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন, সেখানে তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্যারিস মন্তব্য করেন- ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে জোরদার করা ও নিজের নিজের দেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’ মোদির পাশে দাঁড়িয়ে হ্যারিস কেন গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ টানলেন, সেই প্রশ্ন ঘিরে চর্চা চলছে। দু’বছর আগে যখন কাশ্মীরে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ হয়েছিল, তখন এই কমলা হ্যারিস মন্তব্য করেছিলেন- ‘কাশ্মীরিদের মনে করিয়ে দিই, তাঁরা একা নন। পরিস্থিতির উপর আমরাও নজর রাখছি।’ হ্যারিস তখন ভাইস প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেননি। তাঁর এই মন্তব্য মোদি সরকারের পক্ষে বেশ অস্বস্তিকর ছিল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডেমোক্র্যাট হ্যারিসকে (Kamala Harris) হয়তো সে-সময় অভিবাসী মার্কিনিদের ভোটের জন্যই এই মন্তব্য করতে হয়েছিল। কিন্তু মোদির সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি বৈঠকের বসার শুরুতেই কেন তিনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে জোরদার করা ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কথা উল্লেখ করলেন, সে বিষয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। ডেমোক্র্যাট হ্যারিস কি ফের একবার মোদিকে শ্লেষ ছুড়ে দিতেই নিজের কাশ্মীর নিয়ে করা মন্তব্যকে স্মরণ করাতে চাইলেন? এই প্রশ্ন কোনও কোনও মহল তুলছে।
মোদির সঙ্গে বৈঠকের আগে বাইডেনের টুইটে আফগানিস্তান প্রসঙ্গ ছিল না। তা নিয়েও প্রাথমিকভাবে কূটনৈতিক মহলে হইচই শুরু হয়ে যায়। মোদির যে সফরের মূল কেন্দ্রে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস, সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওই প্রসঙ্গটিকেই উহ্য রাখলেন কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তবে, বাইডেনের সঙ্গে প্রায় একঘণ্টা বৈঠকের শেষে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তরফে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তার পুরোটা জুড়েই ছিল আফগানিস্তান, তালিবান, সন্ত্রাসবাদ ও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসে পাকিস্তানের ভূমিকার প্রসঙ্গ। পরে মার্কিন বিদেশ দপ্তরের তরফেও যে যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ হয়, সেখানে যথাযোগ্য মর্যাদায় গুরুত্ব পায় আফগানিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের ইস্যু।
রাষ্ট্রসংঘে মোদির ভাষণে স্বাভাবিকভাবেই বিস্তারে উঠে আসে আফগানিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গ। নাম না-করে মোদি নিশানা করেন পাকিস্তান ও চিনকে। মার্কিন বিদেশনীতির ভরকেন্দ্রে এখন চলে এসেছে চিন। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনকে ঠেকাতে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীকে পারমাণবিক শক্তিতে সজ্জিত করতে আমেরিকা ও ব্রিটেন জোট বেঁধেছে। তাতে কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে ভারত, জাপান, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় অক্ষ ‘কোয়াড’। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর ‘কোয়াড’-এর সভা ছিল হোয়াইট হাউসেই। কোভিড পরিস্থিতিতে এই প্রথম চার দেশের নেতা মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন। আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার নবগঠিত সামরিক অক্ষ গঠনের সিদ্ধান্তে ইউরোপের অন্যান্য ‘ন্যাটো’-ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে জাপানও কিছুটা অসন্তুষ্ট। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সামরিক জোটে অংশ নিতে তাদেরও আগ্রহ ছিল। ভারতের যদিও এক্ষেত্রে সমস্যা নেই। কারণ, চিনের বিরুদ্ধে যে কোনও অক্ষেই ভারতের কৌশলগত সহযোগিতা আমেরিকার কাছে সবসময়ই কাঙ্ক্ষিত। মোদি-বাইডেনের বৈঠকের পরের বিবৃতিতেও সেই বিষয়টি কূটনৈতিক মহলের নজরে এসেছে।
মোদির এই সফরে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির দিক হল, পাকিস্তানের ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়া। মার্কিন প্রশাসনের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব যে কমেছে, তা মোদি-বাইডেন বৈঠক ঘিরে আগ্রহ থেকেই স্পষ্ট। আফগানিস্তান তালিবানের দখলে আসার পর সন্ত্রাসবাদকে ব্ল্যাকমেল করে পাকিস্তান যে আমেরিকা-সহ দুনিয়ার সমর্থন আদায় করতে পারবে না, তা বোঝা যায়। তালিবানি সন্ত্রাসের পাশে নেই দুনিয়া। তালিবানের প্রসার ও শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকাও পৃথিবীর কাছে জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘে ইমরান খানের ভাষণের পর ভারতের ফার্স্ট সেক্রেটারি তরুণী স্নেহা দুবে যেভাবে পাকিস্তানের মুখোশ খুলেছেন, তাতে আলোড়ন পড়েছে বিশ্বে। ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতিতেও আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস প্রসঙ্গটি গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করাই যে ভারতে সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করার প্রধান রাস্তা, মোদির মার্কিন সফরে এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভবিষ্যতে যা পাকিস্তানের ‘ফিনানশিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’ তথা ‘ফাটফ’-এর কালো তালিকায় ঢোকার পথ প্রশস্ত করে দেবে কি না, সেটা সময়ই বলবে।
হ্যারিসের গণতন্ত্র নিয়ে খোঁচার মধ্যেও তাই মোদির এই সফরের মধ্যে প্রাপ্তির ভাঁড়ার সন্ধান করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে ভারতীয় কূটনীতিকদের। কূটনৈতিক মহলের দাবি, পাকিস্তান ও চিনকে চাপে রাখার কৌশল যে সফল, তা তো মোদির এই মার্কিন সফরের পর বলা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.