বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই প্রতিবেদন সব ডাক্তারদের জন্য নয়, একাংশের জন্য। যাঁরা এখনও চিকিৎসার মূল নীতিতে অনড় থেকে পেশা পালন করেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট। বেসরকারি ক্ষেত্রের যাঁরা প্রকৃত দায়িত্ব স্বচ্ছভাবে পালন করেন, তাঁদের জন্যও এই প্রতিবেদন নয়। লিখছেন অপরাজিতা সেন।
আবার কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছেন সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা। উসকানি দিচ্ছেন কিছু সিনিয়র ডাক্তার। সোমবার বিকেল থেকেই এই কর্মবিরতির হুঙ্কার দেওয়া আছে।
আমরা বারবার বলছি, জুনিয়র ডাক্তারদের মূল দাবির সঙ্গে আমরা সহমত। আর জি করে ন্যায়বিচার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বহু দাবিই ন্যায্য। কিন্তু এর জন্য বারবার কর্মবিরতি, সেটা হতে পারে না। সরকারি হাসপাতাল মূলত সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষের জন্য। এখানে চিকিৎসায় হয়রানি হলে বাড়তি টাকা দিয়ে ভিড় বাড়ছে বেসরকারি ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্যসাথীর কল্যাণে কিছু মানুষ সুবিধা পেলেও অনেককেই অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। ফলে আন্দোলন এবং প্রতিবাদ চলুক, কিন্তু কর্মবিরতি নয়।
এর পরেও যে বা যাঁরা কর্মবিরতির পক্ষে ওকালতি করবেন, তাঁদের দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অন্যান্য পেশায় যদি কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি কেউ হন, তাহলেও কি গোটা পেশা কাজ বন্ধ করে বসে থাকেন? সাংবাদিক নিগ্রহ তো যুগে যুগে হয়ে এসেছে, তার মানে কি চ্যানেল আর কাগজ বন্ধ? ফলে, সাগর দত্ত হাসপাতাল বা অন্য কোথাও যদি বিচ্ছিন্ন আপত্তিকর ঘটনা ঘটে, তার জন্য সবটা বন্ধ করার অধিকার থাকে কি? ওড়িশায় রোগিণীদের ধর্ষণ করলেন এক চিকিৎসক, গ্রেপ্তারও, তাহলে কি সব ডাক্তারই খারাপ? পেশার সকলকেই একনজরে দেখতে হবে?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি আরও তীব্র এবং আমজনতার খারাপ অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসায় এত খরচ কেন, বিল বাড়ে কেন? যে জুনিয়র ডাক্তাররা রোজ নীতিকথা শোনাচ্ছেন, বিপ্লবী ভাব দেখাচ্ছেন, তাঁরা কি অস্বীকার করবেন যে অনেকের শিরদাঁড়া বন্ধক আছে বড় প্রাইভেট হাসপাতালে। জবাব দিতে হবে, (এক) সরকারি কাজে অবহেলা করে অনেকে প্রাইভেটে রোগী দেখার কাজে যান কি না। (দুই) একাংশের চিকিৎসক বা চিকিৎসা কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট ওষুধ কোম্পানির দামি ওষুধ ব্যবহার করিয়ে তার থেকে কমিশন খান কি না। (তিন) একাংশের ডাক্তার দরকারে বা অদরকারে বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়ে সেখান থেকে কমিশন পান কি না। (চার) একাংশের ডাক্তার পেসমেকার বা অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যাবহার করিয়ে সেখান থেকেও কাটমানি নেন কি না। (পাঁচ) বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি যে কিছু ডাক্তারকে দেশবিদেশে সফরে নিয়ে যায়, সেটা কি শুধুই সমাজসেবার কারণে? (ছয়) কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে ডাক্তারদের উপর বিল করানোর ‘আর্থিক টার্গেট’ ঠিক করে দেওয়া থাকে কি না?
(সাত) কোনও রোগী ভর্তি হলেই কেন প্রথমে জিজ্ঞাসা করা হয় বিমা আছে কি না, এতে কী কী তফাৎ হয়? এধরনের আরও বেশ কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে খোলামেলাভাবে আলোচিত হয়। কারণ মেডিক্যাল বিষয়টা সকলের ক্ষেত্রেই জরুরি এবং এর খরচ বেড়ে গেলে সমস্যা হয়। অথচ এই অতিরিক্ত খরচের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাংশের ডাক্তার দায়ী, যাঁরা পরোক্ষভাবে ওই বর্ধিত অর্থের সুবিধাভোগী। দিনের পর দিন এই চক্র কাজ করে চলেছে। আজ কিছু জুনিয়র ডাক্তার কথায় কথায় কাজ বন্ধের হুমকি দিচ্ছেন, কিন্তু কমিশন বন্ধ করে আমজনতার চাপ কমানোর কথা তাঁদের মুখে নেই কেন? আজ আর জি করে জঘন্যতম নারকীয় ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার প্রতিবাদে নাগরিক আবেগকে ব্যবহার করে এই ডাক্তারদের একাংশ নিজেদের স্বার্থে বিপ্লবী সাজছে। কিন্তু আজ না হলে কাল, অদূর ভবিষ্যতে কিংবা ভবিষ্যতে এই অপ্রিয় প্রশ্নগুলোর উত্তর এই নাগরিক সমাজই চাইবে।
এখন যে পুলিশ বা রাজনীতিবিদদের ভিলেন বানানো হচ্ছে, প্রাইভেট সেক্টরের অতিরিক্ত বিল থেকে বাঁচতে আমজনতা সেই নেতাদেরই দ্বারস্থ হয় অনুরোধ করার জন্য। ক্ষোভ সামলাতে এই পুলিশকেই ছুটে যেতে হয়। ফলে যত সহজে যে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে কিছু জুনিয়র ডাক্তার কুৎসিত পরিবেশ তৈরি করছেন, ভবিষ্যতে এই পরিবেশের জন্য তঁাদেরও আক্ষেপ করতে হবে। বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যদি কোনও সরকারি এজেন্সি হিসাব পরীক্ষা করে, কত টাকা কোথায় গেছে তালিকা প্রকাশিত হয়, অনেক চিকিৎসকের সামাজিক সম্মান নিয়ে টানাপোড়েন তৈরি হবে।
মেডিক্যাল সিস্টেম একটা জরুরি জায়গা। ডাক্তাররা ভগবানের মতো। ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক, বিশ্বাসের সম্পর্ক। এখন রোগীরা বোঝেন তাঁরা ‘মানি মেকিং মেশিন’। তাই বিশ্বাসযোগ্যতা রাখার মূল দায়িত্ব ডাক্তারদের। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে আমজনতার করের টাকার ভরতুকিতে সস্তায় পড়ে ডাক্তার হবেন, আর তার পরে আকাশছোঁয়া ভিজিট আর প্রাইভেটের চক্কর, এটাই বা কতদিন চলবে? জানি, এই অপ্রিয় প্রশ্নগুলো উঠলে অনেকে হাঁ হাঁ করে উঠবেন, কিন্তু যদি এই একটা পেশা থেকে কথায় কথায় কর্মবিরতির ‘থ্রেট কালচার’ শুরু হয়, তাহলে অন্য প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার দায়িত্বও তাঁরা নেবেন না কেন?
পুনশ্চ: আরও একটি অপ্রিয় কথা। সেদিন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির বৈঠকের সময় সামনে দাঁড়িয়ে যে জুনিয়র মহিলা ডাক্তার স্বাভাবিক ছিলেন, হঠাৎ ক্যামেরায় বাইটস দেওয়ার সময় কেঁদে নাটক করলেন, তাঁর বাবা একজন ডাক্তার, এবং তাঁর বিরুদ্ধে রোগিণীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে, চার্জশিটও হয়ে গিয়েছে। সেই অভিযুক্ত ডাক্তারের এক মেয়ে কেঁদে আর জি করের ন্যায়বিচার চাইছেন, এক জামাই এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ অথচ জামাইষষ্ঠী খেতে যায় ওই শ্লীলতাহানিতে অভিযুক্ত শ্বশুরের কাছে, এত দ্বিচারিতা নিয়ে এই অংশটি নিজেদের স্বার্থে মিডিয়াকে ব্যবহার করে কিছু প্রচার পেতে পারে। কিন্তু সিস্টেমের মূল সমস্যাগুলির সমাধান এদের উদ্দেশ্য নয়। প্রতিবাদী আমরা সবাই। এর মধ্যেও এমন অনেক ঈশ্বর সম ডাক্তার এবং জুনিয়র ডাক্তার অবিরাম বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে চলেছেন, তাঁরাও ন্যায়বিচার চান, কিন্তু এই অন্য উদ্দেশ্যের প্রচারের নাটকে মুখ দেখিয়ে পরিচিতি বাড়ানোর দৌড়ে তাঁরা নেই।
এই অংশটির জন্যই এখনও মেডিক্যাল সিস্টেম টিকে আছে। সরকারের উচিত এই অংশটিকে আরও বেশি করে কাজে লাগিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়ন করা। আন্দোলনের নামে ব্ল্যাকমেল করে টেবিলে বসা মানেই জ্ঞানীগুণী আর নীরবে কাজ করে যাওয়ারা দূরে থাকবেন, এটা চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত বেসরকারি ক্ষেত্রের অশুভ চক্রই শেষ হাসি হাসবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.