গৌতম লাহিড়ী: বর্তমানের ইসলামাবাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম গাহ। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের জন্ম এই গ্রামেই। দেশভাগের কারণে এপারে চলে আসার পর একবারের জন্যও জন্মভিটে দেখতে যাননি। তবে সহপাঠীদের
সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ছেলেবেলার স্কুলে, গ্রামের রাস্তায় বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে ভোলেননি।
পারভেজ মুশারফ তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তিনি মনমোহনের সুপারিশ মেনেছিলেন। উদ্দেশ্য–একবারের জন্য মনমোহনকে নিয়ে আসতে পারলে স্বীকৃতি বৃদ্ধি পায়। গ্রামের স্কুল সেজে উঠেছিল। শিখ-রীতি অনুসারে হাজার-হাজার পায়ের জুতো আর শাল জমা হল। যা এখনও নাকি আছে! একবার ইসলামাবাদে গিয়ে শুনেছিলাম। ছেলেবেলায় তেলের কুপি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতেন মেধাবী মনমোহন। ছিলেন উর্দু ভাষায় পারদর্শী। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর হিন্দি-ভাষণ লেখা থাকত উর্দুতে। পার্লামেন্টে বহুবার উর্দু শায়রিতে বিপক্ষকে ছুরির মতো ধারালো জবাব দিয়েছেন মৃদুভাষী মানুষটি। বিপক্ষ তাঁকে ব্যঙ্গ করত ‘মৌনীমোহন’ বলে। ২০১৩ সালে বিতর্কের জবাবি ভাষণে মির্জা গালিব উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘হাজারো জবাব সে অচ্ছি হ্যায় খামোশি মেরি/ না জানে কিতনে সওয়ালো কি আব্রু রখে’–আমার নীরবতা হাজার জবাবের থেকে বাঙ্ময়।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সঙ্গে বিদেশ সফর করেছি অজস্রবার। নিয়ম করে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতেন বিমানের মধ্যেই। একবার জানতে চেয়েছিলাম, নিজের জন্মভিটেয় যেতে মন চায়? হেসে বলেছিলেন, ‘গোটা ভারতই তো আমার জন্মভূমি’। পরবর্তীতে সুযোগ এলেও পাকিস্তানে জঙ্গি-হামলার কারণে তিনি পাক-সফর প্রত্যাখ্যান করেন। মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে দুর্নীতির বহু অভিযোগ উঠেছিল। তবু, তাঁর চিরকালের নীল পাগড়ি শরতের আকাশের মতোই স্বচ্ছ ছিল শেষ দিন পর্যন্ত।
অনেকের মত, তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা দুর্ঘটনার মতোই আকস্মিক। তাঁর রাজনীতিতে আসাটাও সহসা। কংগ্রেসের বাণিজ্যমন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্র প্রথম মনমোহনকে আবিষ্কার করেন। ১৯৭১ সালে বাণিজ্য মন্ত্রকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেন তাঁকে। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের অফিস থেকে ফোন গেলে–”প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অর্থমন্ত্রী করবেন’ বিশ্বাস করেননি। পরে নরসিমা রাও ফোন করে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে আসুন শিগগির’। তখন বিশ্বাস হয়। এরপর কার্যত ভারতের অর্থনীতির ‘জনক’ হয় ওঠেন। তারপর যত সরকার হয়েছে কেউ-ই মনমোহনের আর্থিক উদারীকরণ থেকে বিচ্যুত হতে পারেনি।
অর্থমন্ত্রী হওয়ার সময় হর্ষদ মেহতা শেয়ার কেলেঙ্কারিতে উত্তাল দেশ। মনমোহন পদত্যাগ করতে চাইলেন। নরসিমা রাও মানেননি। এমনকী, বিরোধী দলনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী মনমোহনের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, রাজনীতির জন্য অনেক কিছু বলতে হয়। আপনি ইস্তফা দেবেন না। লাইসেন্স-রাজ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য বিজেপি সমর্থন করেছিল তাঁকে।
মনমোহন সিংয়ের সৌজন্যবোধ তুলনাহীন। ১৯৮২-’৮৫-তে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ছিলেন। তখন প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী। প্রণবকে ‘স্যর’ সম্বোধন করতেন মনমোহন। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও সেই অভ্যাস বদলাননি। প্রণব অস্বস্তি বোধ করলেও না। একবার আমার সামনেই ফোন মনমোহনের। উত্তেজিত প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বলতে শুনলাম, ‘কতবার বলেছি ডোন্ট কল মি স্যর। তুমি এখন পিএম! গভর্নর নয়।’ নরসিমা রাওয়ের সরকার পতনের পর কংগ্রেস তখন ‘বিরোধী’ শিবির। সমস্যা তৈরি হল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি নিয়ে। বিজেপি আগে এর বিরোধিতা করলেও সরকার গড়ার পর বুঝল চুক্তিটি কতখানি প্রাসঙ্গিক। দল হিসাবে কংগ্রেস চাইছিল সমর্থন না করতে। মনমোহন এবং প্রণব–ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বোঝালেন, বিরোধী পক্ষ হলেও–বিজেপিকে তাদের সমর্থন করা উচিত দেশের স্বার্থে। তা-ই হল। ভারতের সম্মান বাঁচল।
২০০৪ সালে সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রত্যাখ্যান করার পর মনমোহন প্রধানমন্ত্রী হলেন অপ্রত্যাশিতভাবে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন সোনিয়াকে বলেছিলেন, তিনি মনমোহনের অধীনে অর্থমন্ত্রী হবেন না। অথচ সরকার চালানোর যাবতীয় দায়িত্ব তিনি প্রণবকে দেন। এমনকী, বিদেশ-সফরের সময় প্রণবকে মন্ত্রিসভার পৌরোহিত্য করার অধিকার দেন। পরবর্তীকালে সংকট এল আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করা নিয়ে। তৎকালীন ইউপিএ সরকার ছিল পুরোপুরি জোটনির্ভর। মনমোহনের সিদ্ধান্তে ইউপিএ সরকারের প্রধান শরিক বামেরা রুখে দাঁড়াল। সোনিয়া দেখলেন সরকারের পতন নিশ্চিত। কংগ্রেস ঘনিষ্ঠ বামনেতা ও তৎকালীন যোজনা কমিশনের ডেপুটি মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া তখন সোনিয়াকে জানান, এই পরমাণু চুক্তি না হলে মনমোহন সিং ইস্তফা দেবেন। বামেরা চুক্তিকে সমর্থন না-করার দাবিতে অনড় রইল। ওদিকে, চুক্তি সমর্থন করলেন মুলায়ম সিং যাদব। সে যাত্রায় বেঁচে গেল সরকার। তখন থেকেই প্রায় প্রত্যেকের মধ্যে ‘ধারণা’ তৈরি হল মনমোহন আমেরিকা-পন্থী।
আদতে তিনি এককেন্দ্রিক বিশ্বকে বদলে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে। হরকিষেন সিং সুরজিৎ ছিলেন মনমোহনের ব্যক্তিগত বন্ধু। ওঁর শোকসভায় মনমোহন বলেছিলেন সুরজিৎ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে ‘ব্রিক্স’ গঠন করার– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে। পরমাণু চুক্তি করার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের উচ্চ-প্রযুক্তির উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। চুক্তির পর ভারত অনুমোদন পায় ‘cryogenic engine’ উৎপাদনের– হালে যা দিয়ে মঙ্গল এবং মানুষ চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়।
ছোট-বড় প্রত্যেকের কথা শুনতেন মনমোহন। একবার ওঁর সঙ্গে মায়ানমার যাচ্ছি। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সায়েদ আকবরউদ্দিন জানতেন, আমি একমাত্র সাংবাদিক যে ২৫ বছর পর আবারও মায়ানমার যাচ্ছি। প্রথম গিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তখনকার ‘বার্মা’-য়। জানতে পেরে বিমানের মধ্যে ওঁর কক্ষে ডেকে মনমোহনজি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন কী দেখেছি! আমার মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিক তাঁর এই ব্যবহারে অভিভূত হয়েছিলাম। বারাক ওবামা তাঁকে ‘গুরু’ মানতেন। নিজের আত্মজীবনীতে সেকথা তিনি উল্লেখ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম বিদেশি অতিথি হিসাবে মনমোহন হোয়াইট হাউসে ডিনারে যান। সঙ্গী ছিলাম তাঁর মিডিয়া প্রতিনিধি হিসাবে। উচ্চশিক্ষার জন্য ওবামা-মনমোহন বৃত্তি ঘোষণা হয়েছিল সেদিন।
‘উদার অর্থনীতি’র প্রবক্তা হলেও তিনি সামাজিক প্রকল্প সরকারি অর্থে করার পক্ষে ছিলেন। কর্মসংস্থানে গ্যারান্টি, তথ্য জানার ও শিক্ষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার করার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেন। আধার কার্ড, জিএসটি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। নিশ্চিতভাবে সোনিয়ার সমর্থন ও প্রণবের লাগু করার পরিকল্পনা তাঁকে সাহায্য করেছিল। দুর্নীতি-বিরোধী অর্ডিন্যান্স যেদিন রাহুল গান্ধী দিল্লির প্রেস ক্লাবে এসে ছিঁড়ে ফেলেন, সেদিন তিনি বিদেশে। দুঃখ পেয়েছিলেন। জনান্তিকে বলেছিলেন, এর জন্য রাহুলকে একদিন পস্তাতে হবে। বর্তমানে, ওই আইন থাকলে রাহুলকে দু’-বছরের শাস্তিতে সংসদ পদ খোয়াতে হত না।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.