কৃষক আন্দোলন বিভাজনের রাজনীতির প্রত্যুত্তরে আরও গভীর অভিঘাত তৈরি করল। মুজফ্ফরনগরে মহাপঞ্চায়েতের দিন দেখা গেল, জাঠ কৃষকদের আপ্যায়নে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কৃষকরা রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করছে। জাঠ ও মুসলিম কৃষকদের ঐক্যে হাত মিলিয়েছে গুজ্জররাও। এই ঐক্য কি শুধুমাত্র ঠাকুর-ব্রাহ্মণ জোট দিয়ে ভাঙা যাবে? যারা আসন্ন বিধানসভা ভোটে জাতপাত, ধর্মের সমীকরণে ভোটের হিসেবনিকেশ চালাচ্ছে, তাদের কাছে এই বার্তা স্বস্তির নয়। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
ন’-মাসের কৃষক আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েত থেকে। আট বছর আগে যে মুজফ্ফরনগরে কৃষক মহাপঞ্চায়েত থেকে বিভাজনের রাজনীতির এক নতুন আখ্যান রচনা হয়েছিল, সম্প্রতি তার বিপরীত ঘটনাটাই ঘটল সেখানে। এবার সম্প্রীতির এক নতুন ভাষ্য রচনা হয়েছে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই ছোট জনপদে। কৃষক আন্দোলন জাতপাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে এক নতুন ঐক্যের বার্তা দিল সেই রাজ্যে, যেখানে বহুদিন ধরেই বিভাজনের রাজনীতিই দস্তুর।
তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। একের পর এক মহাপঞ্চায়েতগুলিতে যে পরিমাণে কৃষকের ভিড় জমছে, তাতে এটা স্পষ্ট, এই আন্দোলন সহজে দমার নয়। মুজফ্ফরনগরের পর এবার উত্তাল হল হরিয়ানার কার্নাল। হাজার হাজার কৃষক ব্যারিকেড ভেঙে সরকারি অফিস ঘেরাও করে রাখলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তিন কৃষি আইন নিয়ে অনড় বিজেপি ও কেন্দ্র। কেন্দ্রের এই অনড় মনোভাবের কোনও ব্যাখ্যা সাধারণ চোখে বোঝা যায় না। ন’-মাস ধরে যখন কৃষকরা রাজধানীর বুকে বসে তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন এটাও বোঝা যাচ্ছে না এই জেদাজেদির রাজনৈতিক মূল্য বিজেপি তথা কেন্দ্রের শাসক দলকে কীভাবে চোকাতে হবে?
মুজফ্ফরনগরে কৃষকনেতা রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, “স্বাধীনতা আন্দোলন ৯০ বছর চলেছিল। তাঁদের আন্দোলনের বয়স মাত্র ন’-মাস।” অর্থাৎ কৃষক-নেতারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, খেলা সবে শুরু। মুজফ্ফরনগর থেকেই উত্তরপ্রদেশ-উত্তরাখণ্ড মিশন ঘোষিত হয়েছে। এই দুই রাজ্যে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারানোই এই মিশনের উদ্দেশ্য। মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েত একটি বার্তাই খুব জোরালোভাবে দিচ্ছে যে, এই আন্দোলনকে আর কোনওভাবেই খাটো করা যাবে না। ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগরে টিকায়েতদের কিষান মহাপঞ্চায়েত থেকে ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল। যে দাঙ্গা টানা তিনমাস চলে। দাঙ্গা টানা তিনমাস চললেও, যে বিভাজন ওই দাঙ্গার হাত ধরে বিশেষত উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছিল, তার অভিঘাত আজও বিদ্যমান।
তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ওই বিভাজনের রাজনীতির জবাবে আরও গভীর অভিঘাত তৈরির রাস্তা রচনা করল। মহাপঞ্চায়েতের দিন দেখা গেল, জাঠ কৃষকদের আপ্যায়নে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কৃষকরা রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করছেন। মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েতে যদি ১০ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়ে থাকে, তাহলে বার্তা ছিল একটাই- সেটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির।
আট বছর আগে মুজফ্ফরনগরের কৃষকরা নিজেদের মধ্যে জাঠ ও মুসলিম বিভাজন করে বিভেদের জন্ম দিয়েছিলেন। এবারের মহাপঞ্চায়েত সেই জাঠ ও মুসলিম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সংহতির বার্তা দিল। এই বার্তা নিশ্চয়ই তাদের পক্ষে স্বস্তিকর নয়, যারা আসন্ন বিধানসভা ভোটে জাতপাত, ধর্মের সমীকরণে ভোটের হিসেবনিকেশ চালাচ্ছে।
মহাপঞ্চায়েত এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যদি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বার্তা এভাবে দিতেই থাকে, তাহলে ২০২৪-এর আগে সব অঙ্ক ওলটপালট হয়ে যাবে, তা বলা বাহুল্য। উত্তরপ্রদেশে এক সময়ে হিন্দুত্বকে রুখেছিল জাতপাতের সমীকরণ। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা এরপর কৌশল বদলে সেই জাতপাতের সমীকরণকেই হাতিয়ার করে তাদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কৃষক আন্দোলন নতুন এক সম্ভাবনার মুখে ফের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিকে। হিন্দুত্বকে রুখতে এবার সক্রিয় কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া জাতপাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠা মানুষের ঐক্য। শাসক দল এরপর কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে, সেটা দেখার। কিন্তু গো-বলয়ের রাজনীতিতে মানুষের এই ঐক্য বেশ অনেক দিন পর প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিগত কয়েক দশক ধরে গো-বলয়ে আমরা শুধু বিভাজনের রাজনীতির দাপাদাপিই দেখেছি। যা এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল মুজফ্ফরনগরের ২০১৩-র সেই মহাপঞ্চায়েতের হাত ধরে।
তিন কৃষি আইন কৃষিতে কর্পোরেট সাম্রাজ্যের আধিপত্যকে নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, এই আশঙ্কা থেকেই কৃষি আন্দোলনের সূচনা। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে বড় কৃষকরাই। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের বড় অংশ যে এই আন্দোলন থেকে এখনও দূরে রয়েছে, তাতে সংশয় নেই। আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও তার আঁচ যে সামগ্রিকভাবে কৃষক সমাজের উপর পড়ছে না, তা নয়। দিল্লি থেকে দূরবর্তী রাজ্যেও বিজেপি বিরোধিতার রাজনীতির অন্যতম উপাদান হিসাবে কাজ করছে, রাজধানীর বুকে ন’-মাসের টানা কৃষক আন্দোলনের প্রভাব। কেন্দ্র সরকারের অভিমত, তিন কৃষি আইন কৃষিক্ষেত্রে যে সংস্কারের রাস্তা প্রশস্ত করবে, তার ফল ভারতের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী। ১৯৯১ সালে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের মধ্য দিয়ে শিল্প পরিষেবার ক্ষেত্রে নয়া অর্থনীতির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তিন নয়া কৃষি আইন কৃষিক্ষেত্রে সেটাই সুনিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, ১৯৯১ সালের সেই যাত্রা কি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর পক্ষে ইতিবাচক হয়েছে? জাতীয় উৎপাদন যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
কিন্তু, সম্পদের বণ্টন যদি সুষম না হয়, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সে তো আমরা তিন দশক ধরেই প্রত্যক্ষ করছি। দারিদ্র ও বেকারত্ব, দু’ক্ষেত্রেই আমরা এগচ্ছি।
কৃষক আন্দোলন আমাদের অর্থনীতির এই মৌলিক প্রশ্নগুলির সামনে দাঁড় করিয়েছে। সরকারের একদল বন্ধু-ব্যবসায়ী তথা কর্পোরেট সংস্থার মুনাফা বৃদ্ধি ছাড়া যে নয়া তিন কৃষি আইন নতুন আর কোনও লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছে দেবে না, তা খুব স্পষ্টভাবে বলছে উত্তর ভারতের কৃষকরা। এই বলার মধ্যে বাস্তবতা কতটা, তার উত্তর ভবিষ্যতে মিলবে। কিন্তু, কেন্দ্রের অনড় মনোভাব ধীরে ধীরে যে পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, তা যে বিজেপি তথা শাসক দলের পক্ষে স্বস্তিকর হবে না, সে-কথা এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে।
মুজফ্ফরনগরের পর কার্নালের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, বিজেপি-শাসিত এই দুই রাজ্যে কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের কতটা সমর্থন বর্ষিত হচ্ছে। মুজফ্ফরনগরে জাঠ ও মুসলিম কৃষকদের যে ঐক্য মহাপঞ্চায়েতে রচিত হয়েছে, তারপরেও যোগী আদিত্যনাথ কীভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছেন, সেই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে উঠতে শুরু করেছে। জাঠ, মুসলিমদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে গুজ্জররাও। এই ঐক্য কি শুধুমাত্র ঠাকুর-ব্রাহ্মণ জোট দিয়ে ভাঙা যাবে? গত কয়েক দিন যাবৎ সংবাদমাধ্যমে এই প্রশ্ন নিয়েই আলোচনা চলছে। সন্দেহ নেই, পরিস্থিতির খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পাঁচ রাজ্যের ভোটের দিন ঘোষণা হতেও আর বেশিদিন নেই। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও পাঞ্জাবের ভোট যত কাছে এগিয়ে আসবে, তত কৃষক আন্দোলনের অভিঘাত কোনদিকে যাচ্ছে, তার উত্তর আমাদের কাছে স্পষ্টতর হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.