ফাইল ছবি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্গের দ্বিতীয় নামও নয় যে, সেখানে অন্যায়-অবিচার হয় না। বরং যাদবপুর যা করছে, তাতে যাদবপুর যে অবিচারেরই অন্য নাম হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা স্বীকার করার সময় চলে এসেছে। লিখলেন মৌমিতা।
ছোটবেলা থেকে পাড়ায় বড় হতে হতে আমরা দেখেছি, কোনও না কোনও মঞ্চ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের কৃতীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনায় প্রায় একটি কথা অনেকেই বলে যে, যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে এরকম স্ট্যান্ড করে, তারা সাধারণত একটু সমাজবিচ্ছিন্ন হয়, একটু একাচোরা হয়, পড়াশোনা নিয়েই থাকে। তাদের সমাজের বিভিন্ন কাজে একটু সম্পৃক্ত করে নিলে ভাল। মেধাবী, সত্যিকারের পড়াশোনায় ভাল ছেলে-মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই রাতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্যারাম খেলে না, কোনও ঠেকে বসে থাকে না, তাদের দিনের আট থেকে দশ ঘণ্টা পড়াশোনায় যায়। তার বাইরে কারও একটু খেলার নেশা থাকে। কারও-বা বই পড়ার নেশা। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা অন্যান্য বিষয়ে ভর্তি হলে কীভাবে সেই মেধাবী ছেলের ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়ে যায়, তা যাদবপুর না দেখালে আমরা জানতে পারতাম না!
কথিত, যাদবপুরে মেধাবীদের নাকি মেধা-চর্চার জন্য হেরোইন থেকে মারিজুয়ানা সমস্ত কিছুর দরকার। যেটা প্রবল আতঙ্কের বিষয়, তা হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি রমরমা মাদক ব্যবসা আরম্ভ হয়েছে, যার কথা আমরা অনেকে জানি, কিন্তু যার প্রতি কোনও কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বরং এমন কথা বললে একটি তরফ থেকে এখন বলা হচ্ছে, যে-রাজ্যে আবগারি থেকে অনেক রাজস্ব আসে, সেই রাজ্যে নাকি মদ নিয়ে কথা বলা যাবে না। আশ্চর্যের বিষয়! তাহলে যে বস্তিতে দিন-রাত অশ্লীল গালাগালি হয়, বা অন্যরকম সব তাণ্ডব চলে, সেই বস্তিতে বসে একটি ছেলে ভাল করে পড়াশোনা করতে পারবে না?
ফুটপাতে স্ট্রিট লাইটের নিচে বসে কত ছেলে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করে গেল, কত ছেলে– যাদের মা অন্যের বাড়িতে ঠিকে-শ্রমের কাজ করে, বা যাদের বাবা রিকশা চালায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করল। স্ট্যান্ড করতে হলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেহিসেবি জীবন কাটাতে হবে, নেশা-ভাং করতে হবে– এমন বললে তো কর্তা ঘোড়ায় হাসবে! আশ্চর্যের ব্যাপার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধার কথা যারা বলছে, মুক্ত মনের কথা যারা বলছে, সেই ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে যাদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হবে, তাদের একটি বড় অংশ চলে যাবে বঙ্গের বাইরে। অতএব পশ্চিমবঙ্গের করদাতাদের টাকায় যাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হল, তাদের বড় বড় চাকরির কোনও সুফল পশ্চিমবঙ্গ পাবে না। কারণ, তারা তো কর দেবে সম্ভবত অন্য দেশের সরকারকে, আর না হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি অন্য কোনও রাজ্যের সরকারকে।
এ এক অদ্ভুত বিপ্লব, যে-বিপ্লব স্কুলে পড়াকালীন থাকে না, যে-বিপ্লব চাকরি-জীবনে চলে গেলে থাকে না, যে-বিপ্লব শুধু যাদবপুরে শুরু হয়ে যাদবপুরেই (Jadavpur University) শেষ হয়ে যায়। তাতে মাঝেমধ্যে মনে হয়, যাদবপুর কি ইন্দ্রপুরী বা টেকনিশিয়ান’স স্টুডিও, যেখানে ঢুকলে পরেই সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের কিছু ছেলে-মেয়েরও বিপ্লবীর ভূমিকায় অভিনয় করতে সাধ জাগে! এখানে গ্রামের ছেলেদের দিকে দোষ ঠেলে দেওয়া হবে জানা কথা, কিন্তু আসল বিষয়টা হল, গ্রাম থেকে আসা একটি ছেলের মস্তিষ্ক পচানোর কাজ করে শহরের কিছু বাস্তুঘুঘু, যারা বছরের পর বছর পরীক্ষা না দিয়ে কিংবা দেওয়ার পরও, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও, হস্টেল ব্লক করে রাখে বা আটক করে রাখে। যে-ঘরে ছেলেটির ওপর অত্যাচার হয়েছিল, সেই ঘরের বাইরের দেওয়ালেই একটা চ্যানেলে দেখা গেল লেখা আছে– ‘বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না।’ প্রশ্ন জাগে, প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই অসামান্য পঙ্ক্তির ‘লাল টুকটুকে স্বপ্ন’ মানে কি এক্ষেত্রে এক নাবালকের নিথর রক্তে রঙিন দেহ?
যাদবপুরের একদল সিসিটিভি বসানোর বিরোধিতা করতে গিয়ে যেটা পরিষ্কার করে দিয়েছে, তা হল– তাদের অনেক কিছু লুকোনোর আছে। ‘একটা ঘটনা দিয়ে যাদবপুরের বিচার করবেন না’– যারা বলছে, সেই একই লোকগুলো কেন রোহিত ভেমুলার একটা ঘটনা দিয়ে হায়দরাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির বিচার করেছিল? নিজের বেলা অঁাটিসঁাটি, পরের বেলায় দঁাতকপাটি? সারা ভারতের ক্ষেত্রে যখন একটা বা দুটো উদাহরণ হলেই তা নিয়ে ঝঁাপিয়ে পড়তে হচ্ছে, তখন যাদবপুরের এত বড় একটা কাণ্ডকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে যারা দাগিয়ে দিতে চাইছে, তারা আসলে যাদবপুরের অপরাধীদের আড়াল করতে চাইছে।
ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘বয়েজ লকার রুম’ জাতীয় অনেকরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা যাদবপুরে ঘটে গিয়েছে। প্রকৃত দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে যাদবপুরে। মেয়েদের গোপন ছবি থেকে শুরু করে ড্রাগ মাফিয়াদের যাতায়াত– সমস্ত কিছুর মুক্তাঞ্চল তৈরি হয়ে গিয়েছে যাদবপুরে। জনৈক ছাত্রী বলছিলেন– যাদবপুরে নাকি বহিরাগতরা আসে গান গাইতে, কবিতা পড়তে, কারণ যাদবপুর ছাড়া আর কোনও গণতান্ত্রিক জায়গা নেই পশ্চিমবাংলায়। শুনলে হাসিও পায়! যদি যাদবপুর ছাড়া আর কোনও গণতান্ত্রিক জায়গা পশ্চিমবঙ্গে না থাকে, তাহলে যাদবপুরের এই স্বঘোষিত বিপ্লবীদের তো সবার আগে বলা উচিত– মতাদর্শ নির্বিশেষ সব রাজনৈতিক দল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বাগত। তা কি হয়?
অভিযোগ, হস্টেল-লাগোয়া বাড়িগুলির মেয়েরা বারান্দায় আসতে পারে না, ছাদে উঠতে পারে না, কেবলমাত্র ওই মেন হস্টেলে থাকা ছাত্রদের অশালীন অঙ্গভঙ্গি এবং বিকৃত মানসিকতা থেকে জন্ম নেওয়া উন্মত্ত গালাগালির কারণে। এই যদি মেধার পরিচয় হয়, তাহলে সেই মেধাকে সন্দেহ করার সময় এসেছে, সন্দেহ করার সময় এসেছে বিপ্লবের ভেক ধরে ছদ্মবেশে ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা প্রত্যেকটি ছেলে এবং মেয়েকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই একটা জায়গা, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কোনও অধ্যাপকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে সেই অনুযায়ী নাম্বার ওঠা-পড়া করে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কোনও স্বর্গের দ্বিতীয় নাম নয় যে, সেখানে অন্যায়-অবিচার হয় না। বরং যাদবপুর যা করছে, তাতে যাদবপুর যে অবিচারেরই অন্য নাম হয়ে দঁাড়াচ্ছে, তা স্বীকার করার সময় চলে এসেছে। ইউজিসি-র নিয়ম যদি ভারতের প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে খাটে, তাহলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সেটিকে খাটতে দিতে হবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কোনও মেধাবীও নয় আইনের ঊর্ধ্বে।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.