ভোট এলেই এজেন্সিকে ব্যবহার করে বিজেপি বিরোধী দল ও বিরোধী নেতাদের উপর চাপ তৈরি করছে। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাক্-স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের মিথ্যা মামলায় ফঁাসিয়ে দেওয়া এক বিপজ্জনক প্রবণতা। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
কংগ্রেসি জমানায় গোপন সিবিআই ফাইলের বিষয়টি রাজনীতিতে খুব প্রচলিত ছিল। বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে তৈরি এই ফাইল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতেন বলে কথিত ছিল। অবশ্য শুধু বিরোধী নেতাদের ক্ষেত্রেই এই ফাইল প্রযোজ্য হত, এমন নয়। দলীয় নেতাদের নামেও নাকি এরকম ফাইল থাকত। ট্যাঁফো করলে হাইকমান্ড নাকি ড্রয়ার খুলে সংশ্লিষ্ট নেতাকে এই ফাইল দেখিয়ে দিতেন। এই ফাইল রাখার বিষয়টি কত দূর সত্য, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে সরকারিভাবে কেউ কখনও মুখ খোলেনি।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সিবিআই, ইডি (ED), এনআইএ, ইনকাম ট্যাক্সের মতো কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বিজেপি যা করছে, তাতে কোনও রাখঢাকের বালাই নেই। সরকার গড়তে ও সরকার ফেলতেই শুধু নয়, ভোটের আগে এই ধরনের এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করে বিজেপি বিরোধী দল ও বিরোধী নেতাদের উপর যে চাপ তৈরি করছে, তা নজিরবিহীন। ভোট এলেই শুধু অ-বিজেপি দল শাসিত রাজে্য এজেন্সির তৎপরতা চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলপাইগুড়ির জনসভায় এক পা এগিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হুঁশিয়ারি দিয়ে গেলেন, ৪ জুনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অারও কঠোর ব্যবস্থা হবে। অর্থাৎ, ভোটের অাগে বিরোধীদের ভয় দেখানো।
এখনও পর্যন্ত ২০২৪-এর নির্বাচন ঘিরে দেশবাসীর মধে্য উত্তেজনা কম। এই কম উত্তেজনার কারণ হিসাবে একদিকে দীর্ঘতম ভোটপ্রক্রিয়ার কথা যেমন বলা হচ্ছে, তেমনই বলা হচ্ছে যে, এবারে শাসক দলের সঙ্গে বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম। অধিকাংশ জনমত সমীক্ষার রায়েই নরেন্দ্র মোদি সরকারের ফিরে আসার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ নিশ্চিত। ফলাফল যখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে আছে, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এজেন্সিকে ব্যবহার করে বিরোধীদের কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে কেন এত তৎপরতা, সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর নেই। কেনই বা মোদিকে হুমকি দিতে হচ্ছে, তা-ও স্পষ্ট নয়।
বিশেষত, বাংলার ক্ষেত্রে এজেন্সির যে-ধরনের তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা অতীতে কখনও ঘটেনি। এমনকী, মোদি সরকারের আমলে হওয়া অাগের নির্বাচনগুলিতেও এরকমের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। যদিও গত দশ বছরে এই রাজে্যর কত রাজনৈতিক নেতাকে সিবিআই, ইডি, এনআইএ (NIA), ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তলব করেছে, সেই হিসাব নিতে গেলে দেখা যাবে তা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু ভোটের আগে যা ঘটছে, তা অতীতে কখনও কল্পনা করা যায়নি। ভূপতিনগরে যে ঘটনাটির প্রেক্ষিতে এনআইএ দু’জন তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করেছে এবং একাধিক নেতাকে শমন পাঠিয়েছে, তা প্রায় দু’-বছর আগের।
একটা বাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। রাজে্য এরকম বিস্ফোরণের ঘটনা অতীতে অজস্র ঘটেছে। এই ঘটনাটি যে খাগড়াগড়ের মতো নয়, সেটা প্রমাণিত। অর্থাৎ এই ঘটনার সঙ্গে কোনওরকম জঙ্গিযোগের সম্পর্ক নেই। সম্ভবত বোমা তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে। কী উদ্দেশে্য সেখানে কী ধরনের বোমা তৈরি হচ্ছিল, তা অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষ। দোষীদেরও কঠোর সাজা পাওয়া জরুরি। যদিও বিস্ফোরণে যে-বাড়িটি উড়ে গিয়েছিল, তার মালিকও ঘটনাস্থলে নিহত হন। তবুও দেখা দরকার ওই ঘটনার সঙ্গে আরও কারা যুক্ত রয়েছেন। একটি মামলার সূত্রে ঘটনাটির তদন্তে এনআইএ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এত দিন আগের একটি ঘটনায় হঠাৎ ভোটের আগে স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতাকে ধরতেই কেন এনআইএ-র এত তৎপরতা? যদি ওই তৃণমূল নেতারা বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে কোনওভাবে জড়িয়ে থাকেন, তাহলে তঁাদের অনেক আগেই তো এনআইএ গ্রেফতার করতে পারত! একইভাবে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের পর কিছু হিংসাত্মক ঘটনার জন্য সিবিআই হঠাৎ তিন বছর বাদে লোকসভা ভোটের মুখে বেছে বেছে কিছু তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করছে। সন্দেশখালিতেও যে লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে শেখ শাহাজাহানের বাড়িতে ইডি তল্লাশিতে গিয়েছিল, তা নিয়ে সংশয় নেই। ঘটনাচক্রে সন্দেশখালির পুরো বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। সন্দেশখালিতে শাহজাহানদের রাজত্ব তো হঠাৎ কয়েক দিন আগে শুরু হয়নি। গত প্রায় এক দশক ধরেই তা চলছিল। ইডির হঠাৎ ভোটের আগে কেন টনক নড়ল?
এজেন্সির সক্রিয়তা অন্যান্য অ-বিজেপি শাসিত রাজে্যও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। দিল্লি ও ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীরা যে লোকসভা ভোটের প্রেক্ষিতেই দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন, তা কারও অজানা নয়। গ্রেফতার হয়েছেন দেশের অসংখ্য বিরোধী নেতানেত্রী। বিরোধী নেতানেত্রীদের নানারকম দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করে আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধ আইনে (পিএমএলএ) মামলা করে দেওয়া হচ্ছে। এই পিএমএলএ অত্যন্ত কঠোর একটি আইন। রাষ্ট্র সংঘের প্রস্তাবের ভিত্তিতে দেশে মাদক চোরাচালান রুখতে এই কঠোর আইনটি তৈরি করা হয়েছিল। সে-কারণে এই আইনে চট করে জামিন মেলে না।
ভারতে প্রচলিত অ্যাংলো-স্যাক্সন অাইনশাস্ত্র অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা যায় না। কিন্তু পিএমএলএ আইনের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে নির্দোষ। ফলে, এই আইনে একবার মামলা চালু হলে কোনও আদালতের বিচারক-ই চট করে জামিন দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেন না। কারণ, সেক্ষেত্রে তঁাকে প্রমাণ করতে হয় যে, অভিযুক্ত নির্দোষ। এরকম একটি কড়া আইন যে কোনও ধরনের আর্থিক দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার অর্থই হল বিনা বিচারে কাউকে দীর্ঘকাল বন্দি রাখার একটি কৌশল।
গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের যাতে যে কোনও মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে না দেওয়া হয়, তার জন্য কিছু রক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকে। ইদানীং ভারতের ক্ষেত্রে সেসব কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে থানায় একটা এফআইআর করে তদন্তের নামে তাদের জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এইরকম ঘটনা ঘটতে থাকলে একদিকে যেমন রাজনীতিতে কোনও ভদ্রলোক আসবে না, তেমনই গণতন্ত্রে বিরোধিতা বলেও কিছু থাকবে না। মিথ্যা মামলায় ফঁাসিয়ে দেওয়া এক বিপজ্জনক প্রবণতা। গণতন্ত্রকে বঁাচাতে গেলে এটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।
ভোট ঘোষণা হয়ে গেলে ‘আদর্শ আচরণবিধি’ চালু হয়ে যায়। গত কয়েক দশক ধরে আমরা দেখেছি ‘আদর্শ আচরণবিধি’ চালু হয়ে গেলে কার্যত দেশের শাসন ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। সেই সময় বিরোধীরাও অনেকটা নিশ্চিন্তবোধ করে। কারণ সেক্ষেত্রে মিথ্যা মামলায় ফঁাসানো, অযথা পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থার হেনস্তা, এই ঘটনা সাধারণভাবে ঘটতে দেখা যায় না। এবারই ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের শাসনেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে অসম্ভব তৎপর। তৃণমূলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, পুরনো অভিযোগ থাকার কারণে রাজ্য পুলিশের ডিজিকে কমিশন ভোট ঘোষণার পরেই বদলি করে দিল। অথচ বিজেপি নেতার সঙ্গে এনআইএ-র এসপির সন্দেহজনক সাক্ষাতের অভিযোগ তৃণমূল তোলার পরেও কমিশন সেই এনঅাইএ কর্তাকে সরানোর বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না। নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে এবার ভোট শুরুর আগেই বিরাট প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।
নির্বাচন কমিশনের উচিত ‘আদর্শ আচরণবিধি’-র মর্যাদা ও গুরুত্বকে রক্ষা করা। ভোটের আগে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বাক্-স্বাধীনতা কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, তা দেখার কাজ কমিশনের। ভোটের আগে যদি নেতা ও কর্মীরা গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলার ভয়ে ভীত হয়ে থাকেন, তাহলে নির্বাচন কীভাবে অবাধ ও স্বচ্ছ হবে? নির্বাচন কমিশনকে কঠোর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণের জন্য দেশজু়ড়ে দাবি উঠেছে। সাধারণ মানুষের এই দাবিকে মান্যতা দিতে হবে কমিশনকে। ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া কোনও নির্বাচন কমিশনের লক্ষ্য হতে পারে না। কমিশনার পদে বসে টি. এন. শেষন নির্বাচন কমিশনকে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেই উচ্চতাকে ধরে রাখার জন্য বর্তমান কমিশনাররাও সচেষ্ট হবেন, সেটাই প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মানুষের। শেষন-পূর্ব জমানার দিকে হঁাটা তো কোনও কাজের কথা হতে পারে না!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.