Advertisement
Advertisement

Breaking News

Swami Vivekananda

যিনি মাছ খান তিনি আবার কীসের সন্ন্যাসী!

‘যত মত তত পথ’ নিয়ে বিদ্রুপ! এইচজি অমোঘ লীলা প্রভুজিকে নিষিদ্ধ করেছে ইসকন।

Iskon Monk slams Swami Vivekananda and Ramakrishna, controversy arise | Sangbad Pratidin
Published by: Sulaya Singha
  • Posted:July 11, 2023 7:42 pm
  • Updated:July 11, 2023 7:42 pm  

অরিঞ্জয় বোস: যিনি মাছ খান তিনি আবার কীসের সন্ন্যাসী! যত মত তত পথ! এমন আজব কথা কেউ আবার বলতে পারেন নাকি? তা-ও নয় হল। তা বলে গীতা পাঠের থেকে ফুটবল খেলাকে কেউ বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন! তা-ও আবার একজন সন্ন্যাসী হয়ে! প্রশ্নগুলো উঠছে। আর সে প্রশ্ন তুলছেন তথাকথিত এক সন্ন্যাসীই। তাঁর ভঙ্গিতে স্পষ্ট যে, এমন সন্ন্যাসীকে তিনি সন্ন্যাসী বলে স্বীকারই করেন না। তা এইসব অভিযোগ কার বিরুদ্ধে? সকলেই জানেন, যাঁদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে তাঁরা হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ। ভারতবর্ষের ধর্মসাধনা যাঁদের ভাবনা আর কর্মে পেয়েছে আধুনিকতম রূপটি, তাঁদেরকেই সোশ্যাল মিডিয়া মাতানো প্রশ্নের কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন, আজ এতদিন পর যদি স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দকে তাঁর বৈরাগ্যের পরীক্ষা দিতে হয়, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! যদি শ্রীরামকৃষ্ণকে আজ ব্যাখ্যা করতে হয় কেন তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন, তবে তাঁর থেকে দুর্ভাগ্যের কি আর কিছু হতে পারে? সেই দুর্ভাগ্য যে ঘনিয়েই উঠেছে, সাম্প্রতিক বিতর্কই তাঁর প্রমাণ। আর তাই আমাদের আরও বেশি করে ফিরে যেতে হবে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সমীপে।

‘গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের নিকটবর্তী হইবে’- এ-কথা বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তথাকতথিত এই সন্ন্যাসী। তাঁর প্রশ্ন, গীতার থেকে ফুটবল খেলা বড় হতে পারে? অভাবনীয় ভঙ্গিতে তিনি এই প্রশ্ন তুলেছেন। যার অর্থ অনেকটা এরকম যে, এমন কথা কোনও সন্ন্যাসী কীভাবে বলতে পারেন? তাঁর একই প্রশ্ন, শ্রীরামকৃষ্ণের যুগান্তকারী সেই উক্তি ‘যত মত তত পথ’ নিয়েও। কীভাবে এই কথাটির অর্থ বুঝেছেন তিনি! ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন, যদি অস্ট্রেলিয়ায় কেউ যেতে চায়, তাহলে কি যে কোনও রাস্তায় তা যাওয়া যায়! নাকি এরকম কেউ বলতে পারে! ব্যাখ্যার এহেন বহর দেখেই বোঝা যায়, তিনি না চেনেন ভারতবর্ষের ধর্মের শ্বাশ্বত আত্মাটিকে, না বোঝেন গীতা। শ্রীগীতার কথাই বলা যাক। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সেখানে অর্জুনকে বলছেন, ‘বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতিবাদিনঃ’। এই ‘নান্যদস্তীতিবাদিনঃ’ শব্দটির দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক। এর অর্থ এই যে, ‘অন্যৎ ন অস্তি ইতি বাদিনঃ’ অর্থাৎ তদ্ভিন্ন আর কিছু নেই এমন মতবাদী। কার সম্পর্কে এই কথা বলা হচ্ছে? না, ‘বেদবাদরতাঃ’ অর্থাৎ বেদোক্ত কাম্যকর্মের প্রশংসাবাদে অনুরক্ত যাঁরা। সোজা কথায়, বেদের কর্মকাণ্ডের স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর কথায় যাঁরা অনুরক্ত, তাঁরা মনে করেন যে এ ভিন্ন আর পথ নেই। সেই গোঁড়া মতবাদীদের স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- ‘অবিপশ্চিতঃ’ অর্থাৎ অল্পবুদ্ধি এবং অবিবেকী। তাহলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই তো বলে দিলেন যে, একরকম মতবাদে যাঁরা অনুরক্ত, এবং সেটাকেই শিরোধার্য করে বসে থাকেন, তাঁরা আসলে সমগ্রটিকে অনুধাবনই করতে পারেন না। ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের ভাবনা প্রসারিত হয়। এবং বুঝতে পারি যে, এই একমাত্রিক ভাবনার পথ থেকে আমাদের বেরনোর অবকাশ আছে। এক পথই একমাত্র ঈশ্বর উপাসনার পথ নয়। আমরা অনুধাবন করতে পারি, উত্তরকালে ঠাকুর যে যত মত তত পথের মতো ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার আধুনিকতম বাণীটি জগতের সামনে আনলেন, তার বীজ ছিল শ্রীগীতাতে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখেই। সোশ্যাল মিডিয়া কাঁপানো এই সন্ন্যাসীপ্রবর, ফুটবল খেলেছেন কিনা সন্দেহ, সম্ভবত গীতাও ছুঁয়ে দেখেননি। তবে তিনি এটা জানেন যে, গরমাগরম প্রবচন দিলে হাততালি কুড়নো যায়। তিনি সেই কাজটিই করেছেন অম্লানবদনে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি: বিরোধ সর্বব্যাপী হলে সামলাতে পারবে তো বিজেপি?]

দুর্ভাগ্য যে, আজও আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ বা স্বামী বিবেকানন্দের উদার ধর্মচিন্তার সারটুকু গ্রহণ করতে পারিনি। কন্যাকুমারীতে সেই একাকী উপলখণ্ডের উপর নিবিড় ধ্যানে যেদিন মগ্ন হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, সেদিন তাঁর বুকের মধ্যে জ্বলে উঠেছিল অপূর্ব এক আলো। সেই বৈদিক যুগ থেকে যে সনাতন ভাবনা মন্থন হয়ে চলেছে ভারতসাগরে, তারই অমৃত যেন আলো হয়ে সেদিন ধরা দিল তাঁর বুকে। বহু উপলব্ধির স্তর পেরোতে পেরোতে সেদিন তিনি দর্শন করলেন বিশ্বরূপ। ভারতমাতৃকার বিশ্বরূপ। বহু ধর্ম, বহু ভাবনা, বহু সাধনার মিলনক্ষেত্র এই ভারতবর্ষ। সেই শ্বাশ্বত অনুভবটিকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই ভারতবাসীর মুক্তি- ‘তিনি উপলব্ধি করলেন, ধর্মই ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। তাঁর সমাহিত বিশুদ্ধ গহন চিত্তে ধ্বনিত হল এই বাণী- যে আধ্যাত্মিক প্রভাবে ভারতবর্ষ একদিন বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল, সেই আধ্যাত্মিক অনুভূতিরই জাগৃতি ঘটাতে হবে। আর সেই জাগরণ ঘটাতে হবে সর্বসাধারণের মধ্যে। জনগণের অভ্যুদয় ছাড়া ভারতের অভ্যুদয় সম্ভব নয়।’ ভারতের ‘অধ্যাত্মমহিমোজ্জ্বল’ আত্মাটিকে আপনার মধ্যে ধারণ করেই সেদিন আগামীর ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। স্বামীজি হয়তো আজ দেখে দুঃখিতই হবেন যে, সেই ভারতে অভ্যুদয় এখন সন্ন্যাসীর মাছ খাওয়া উচিত কি উচিত নয় মার্কা সস্তা প্রশ্নের প্রবচনে গিয়ে ঠেকেছে।

আসলে দোষ বোধহয় এই সময়টির শোণিতপ্রবাহেই। সে কোনও কিছুই হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। বরং বাইরের আবরণটিকেই জড়িয়ে ধরতে চায় বেশি করে। উক্ত সন্ন্যাসীও স্বামীজির কথাগুলির বাইরের খোলসটিই দেখেছেন মাত্র। তাতে অবগাহন করেননি। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের যে গহন ধারা, যে সমন্বয়ের উদার পথের সলতেটি তিনি পাকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, আর যা অবলম্বন করেই অনির্বাণ শিখা হয়ে একদিন জ্বলে উঠল তাঁর নরেন, সে সবের কতটুকুই বা আমরা মনে রেখেছি! বরং আমাদের রাজনৈতিক বাতাবরণ ক্রমশ ধর্মের নামে গ্রহিষ্ণুতার উলটো পথেই আমাদের চালিত করছে। তাতে বিভেদ বাড়ছে, বিদ্বেষ বাড়ছে। মানুষ যত ভাঙে, তত অসহায় বোধ করে। আর সেই অসহায়ত্বের পথ থেকে মুক্তির খোঁজে সে ধর্মকেই আঁকড়ে ধরতে চায়। ঠিক সেখানেই হাজির হন দলে-টানা এই সব প্রবচন ফিরি করা ‘বাবাজি’রা। তাঁরা নিজেদের দলে মানুষকে টানতে গিয়ে সন্ন্যাসীর আদর্শকেই ক্ষুণ্ণ করতে থাকেন। কোথায় সেই সন্ন্যাসীর সমভাব! কোথায় সেই উদার বৈরাগ্য, যা জগতকে আপন ভাবতে শেখায়। উলটে তিনি আর-এক সন্ন্যাসীর কথার অপব্যাখ্যা করেই দলভারী করতে তৈরি। এ যেন সন্ন্যাসীবেশে রাজনীতির ছক। আর এই অবনমনই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠেছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর উলটোটাই। আমরা যদি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারাটিকে বোঝার চেষ্টা করতাম, তাহলে যে খোলা আকাশ বুকের মধ্যে পেতাম, সেটিই হয়ে উঠত আমাদের প্রকৃত ধর্ম। মানুষের ধর্ম। অধ্যাত্মসাধনাকে যেভাবে ব্যক্তিগত সিদ্ধির কাঠামোর বাইরে এনে দেশ ও দশের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ও পেরেছিলেন তাঁরা, তা বোধহয় আজ আমরা ধারণ তো দূর, অনুধাবন অব্দি করতে পারি না। আর তাই ধর্মের নামে অপব্যাখ্যার জঙ্গল ক্রমে ঘন হয়ে ওঠে। অথচ হায়! এই দেশেই তো আবির্ভাব হয়েছিল স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের। শংকরভাষ্যের মূল ধরে ধরে যিনি একমাত্রিক ব্যাখ্যার গোঁড়ামি দূর করেছিলেন। ধর্মের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অন্য দিগন্ত উন্মোচন করে প্রেম-ভক্তিকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ স্থান। আর তাই তাঁর ধর্ম আন্দোলন হয়ে উঠেছিল সমাজবিপ্লবও। জং ধরা সমাজের খোল-নলচে বদলে গিয়েছল সেই খাপ-খোলা তলোয়ারের মতো শাণিত ভাবনার সমীপে। উত্তরকালে আরও একবার ধর্মের সেই নবদিগন্ত উন্মোচিত হল ঠাকুর আর স্বামীজির হাতেই। সাধনার সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হল মানুষ। মানুষই হয়ে উঠল ঈশ্বর। গণমানুষের মুক্তি যে ধর্মেতে, তা মানুষকে বাদ দিয়ে হয় কী করে! অতএব পৃথিবী পেল জীবজ্ঞানে শিব সেবার মহামন্ত্র। যে মন্ত্র আজও আমাদের ধর্মভিত্তিক দেশে গণতন্ত্রকে দিশা দেখায়।

ঠাকুর ও স্বামীজির ভাবাদর্শের এই যে বিপুল ঐশ্বর্য তা বোধহয় বৃথাই যায়। যখন খোদ সন্ন্যাসীর বেশে কেউ অপব্যাখ্যার জাল বিছিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান, তখন আমাদের উদ্বেগের শেষ থাকে না। বাঙালিরা হয়তো স্বামীজির অপমানে ফুঁসে উঠেছেন। প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু স্বামীজির অপমান তো শুধু বাঙালির অপমান নয়। আসলে তা ভারতবর্ষের অধ্যাত্ম-আত্মারই অপমান। ধর্মের নামে যদি তা চলতে থাকে, তবে তার থেকে বড় অধর্ম বোধহয় আর কিছুই নেই।

[আরও পড়ুন: শাহরুখের নেড়া মাথার ট্যাটুতেই কী লুকিয়ে ‘জওয়ান’-এর গল্প? উত্তর খুঁজতে কালঘাম ভক্তদের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement