কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। আমরা, যাঁরা সেই জওয়ানদের ছত্রছায়ায় জীবনযাপন করি। জওয়ানদের প্রতি তাঁরা কতটা দায়িত্ব পালন করি? যতটা করি ততটা যথেষ্ট তো? সমাজের কাছে প্রশ্ন করলেন সুলয়া সিংহ
বন্দেমাতরম, জয় হিন্দ, ঝণ্ডা উঁচা রহে হামারা। প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসে এসব শ্লোক আওরে নিজেদের দেশপ্রেমীর কুরসিতে বসাতে আমরা একেবারেই বেশি সময় খরচ করি না। এখন তো আবার প্রেক্ষাগৃহে ছবি শুরুর আগে নিয়ম করে উঠে দাঁড়ানোর রীতি চালু হয়েছে। দেশাত্মবোধক ছবি হলে তো কথাই নেই। বড়পর্দায় সীমান্তে জঙ্গিদের নিকেশ করে দেশের সেনাদের সঙ্গে আমরাও সেলিব্রেশনে মেতে উঠি। উত্তেজনা বেশি হলে আবার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে বড়পর্দার জওয়ানদের কুর্নিশও জানাই। আসলে তা সেনার প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।
মহেন্দ্র সিং ধোনি, শচীন তেণ্ডুলকর বা অক্ষয় কুমারের মতো তারকারা সেনাদের সঙ্গে সময় কাটানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে আমাদের দায়িত্ব আরও বাড়ে। সেই পোস্ট লাইক, শেয়ার, কমেন্ট করে নিজেদের দেশপ্রেমের জন্য নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হয়। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ আমাদের বেঁকে যাওয়া শিরদাঁড়ায় সজোরে আঘাত করেছিল। ফের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর উপায় বাতলে দিয়েছিল। তার কৃতিত্ব কিন্তু শুধুই জওয়ানদের দেওয়া হয়নি। উপর থেকে নিচ, সব স্তরই অল্পবিস্তর ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছিল। এভাবেই দিনের পর দিন দেশের প্রতি ভালবাসাকে তুলে ধরেছি আমরা। কিন্তু যাঁদের সাফল্যে আমরা রেস্তরাঁয় গিয়ে বিরিয়ানি খাই, যাঁদের রাত জাগার মূল্যে আমরা নিরাপদে শান্তির ঘুম ঘুমোতে পারি, তাঁদের অন্দরমহলে কি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি কখনও? কতজন দেখার চেষ্টা করেছি আর কতজন সে প্রয়োজন মনে করিনি, এর সমীকরণ করতে বসলে দাড়িপাল্লার একদিক কিন্তু অনেকটাই কাত হয়ে যাবে।
সীমান্তে জওয়ানরা বড়সড় সাফল্য পেলে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে সেই খবর। ভারতীয় সেনার উন্নতির জন্য অস্ত্রসস্ত্র, মিসাইল, লঞ্চার কেনার মতো উদ্যোগে বাহবা কুড়িয়ে নিয়ে যায় কেন্দ্র। অথচ প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো অজানা থেকে যায় তাঁদের জীবনের ছোটছোট না পাওয়ার কাহিনিগুলি। আর সেই কাহিনি তুলে ধরলেই বিপাকে পড়তে হয়। কেউ মুখ খুললেই ওঠে হাজারটা প্রশ্ন। তাকে ‘মিথ্যেবাদী’ আখ্যা দিতেও দেরি করা হয় না।
সেনা মানেই পরিশ্রমী, সেনা মানেই নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ জীবন, সেনা মানেই দেশের জন্য আত্মত্যাগ। এভাবেই সেনাদের ছবি মনের আঙিনায় এঁকেনি আমরা। কিন্তু সেনা মানে তো কয়েদি নয়। সেনা মানে তো শক্তি। মুম্বই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এক জঙ্গি হাজতে বসে বিরিয়ানি খেয়েছে। আর সেখানে সেনাদের কপালে সঠিক পরিমাণ খাবার জোটে না। বাস্তব যদি এটাই হয়, তাহলে কীভাবে লড়বেন তাঁরা। কীভাবে শক্রুপক্ষ দুরমুশ করে দেশরক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে। সেনাদের বুলেট প্রুফ পোশাক জোটাতে হিমশিম খায় সরকার। তাতেও তাঁরা কোনও নালিশ জানায় না। আতঙ্কের অন্ধকারে এগিয়ে যেতে পিছপা হয় না। নিজেদের স্বার্থে নয়। সবটাই দেশের জন্য। বদলে পেট ভরে খাওয়াও কি প্রাপ্য নয় তাঁদের?
দিনের পর দিন না আধপেটা খেয়েও যাঁরা সীমান্তে অক্লান্তভাবে লড়াই চালিয়ে যান, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের ছবিটা কি আরও একটু সুন্দর আশা করতে পারি না আমরা। ‘বন্দেমাতরম’ হাঁক ছেড়েই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় আমাদের? আমরা, আমরা মানে আম আদমি, আমরা মানে সমাজ। আমরা মানে শাসক গোষ্ঠী, আমরা মানে বিরোধী গোষ্ঠী। আমরা মানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। আমরা মানে যারা সেই জওয়ানদের ছত্রছায়ায় জীবনযাপন করি। দেশের মর্যাদা রক্ষা করেন যাঁরা, তেরঙ্গার মতো তাঁদের জীবন কি আরও খানিকটা রঙিন করার দায়িত্ব আমরা নিতে পারি না?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.