আর্টিমিসিয়া গাছের নির্যাসে থাকা আর্টিমিসিনিন করোনার অব্যর্থ দাওয়াই বলে উঠছে দাবি। এনিয়ে গবেষণাও চলছে জোর কদমে। কতটা যুক্তিযুক্ত এই দাবি? কলম ধরলেন হীরালাল মজুমদার মেমোরিয়াল কলেজের অধ্যাপক ঋত্বিক আচার্য।
প্রবাদ আছে “বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলেই পরিচয়।” হ্যাঁ প্রাপ্ত ফলাফলেই পরিচয় সহস্রাব্দ প্রাচীন এই ঐতিহাসিক গাছের। গাছটির ঔষধি হিসেবে ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় আনুমানিক ১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। গাছটি চিনের সীমানা ছাড়িয়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি এই গাছ পাওয়া যায় মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আফ্রিকাতেও এই গাছের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। সুন্দর গন্ধের জন্য এই গাছের পরিচিত ইংরেজি নাম sweet worm wood, বিজ্ঞানসম্মত নাম: Artemisia Annua, গোত্র: কম্পোজিটি। মহামারি করোনার কবল থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে এই গাছ থেকে পাওয়া গৌণ বিপাকজাত বস্তু আর্টিমিসিনিন। এই দাবিতে সোচ্চার বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা, বাদ যাচ্ছেন না রাষ্ট্র প্রধানরাও।
Artemisia Annua এবং তার গৌণ বিপাকজাত বস্তু আর্টিমিসিনিন নিয়ে জোর গবেষণা চলছে বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। আর্টিমিসিনিন আদপে একটি সিসকোয়তারপিন ল্যাক্টোন এন্ডোপারক্সাইড রাসায়নিক। ২০১৫ সালে চায়না অ্যাকাডেমি অফ ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী টু ইউইউ ম্যালেরিয়া রোগের বিকল্প চিকিৎসার জন্য এই আর্টিমিসিনিনের আবিষ্কার ও সফল প্রয়োগের জন্য যৌথভাবে শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসা শাখায় নোবেল পুরস্কার পান। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় এই মুহূর্তে ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পাশাপাশি গুরুত্ব পাচ্ছে এই আর্টিমিসিনিন।
এই মুহূর্তে এটা প্রায় কারওরই অজানা নয় যে প্রাথমিকভাবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন COVID-19-এর চিকিৎসা বা প্রফিল্যাক্সিসে খুব কার্যকর মনে করা হলেও, এখন আর সেকথা মনে করা হচ্ছে না। ব্রাজিল, আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর নেতিবাচক ফল মিলেছে অজস্র। বিকল্প হিসেবে উঠে আসছে আর্টিমিসিনিনের উপযোগিতার কথা। আর্টিমিসিনিনের বিষক্রিয়া যেমন শরীরে খুবই কম, তেমনি রয়েছে SARS-COV-এর ক্ষেত্রে এর সাফল্যের কথা। ২০০৫ সালে বেজিং ইনস্টিটিউট অফ চাইনিস অ্যাকাডেমির বিজ্ঞানীদের (শি-ইউ লি এবং সহ-গবেষকদের) প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে SARS-COV-এর মারণ স্ট্রেইন BJ001-সহ অন্যান্য স্ট্রেইনের সংক্রমণ প্রতিরোধে আর্টিমিসিনিনের সফল প্রয়োগের উল্লেখ রয়েছে সুস্পষ্টভাবে। আর্টিমিসিনিনের মানুষের শরীরে কাজ করার পথটাও একটু আলাদা। এই রাসায়নিকটি ভাইরাসকে সরাসরি আক্রমণ করে না। বরং পোষক দেহকোষের PAK1 বা তার আপস্ট্রিম কোনও অংশে যেখানে ভাইরাস সংক্রমণ করতে পারে সেই জায়গাকে আটকে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকায়।
আর্টিমিসিনিনের এতগুলো ইতিবাচক দিককে মাথায় রেখে গবেষণা শুরু করেছে জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ কলইডস অ্যান্ড ইন্টারফেসেসের বিজ্ঞানীরা। এদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করছে আমেরিকার আর্টেম লাইফ। সঙ্গে রয়েছেন ডেনমার্কের বিশিষ্ট গবেষকরাও। ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ কলইডস অ্যান্ড ইন্টারফেসেসের অধিকর্তা পিটার সিবার্গার এবং সংস্থার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ক্যারি গিলমোরে তাঁদের গবেষণার সাফল্য নিয়ে অসম্ভব আশাবাদী। প্রসঙ্গত এই সংস্থা Artemisia Annua’র উপর গবেষণা চালাচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। COVID-19-এর চিকিৎসা বা প্রফিল্যাক্সিসে Artemisia Annua’র উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা চলছে আজ প্রায় ২ মাস।
COVID-19-এর চিকিৎসা বা প্রফিল্যাক্সিসে Artemisia Annua’র উপযোগিতা নিয়ে একপ্রকার নিশ্চিত ম্যাডাগ্যাস্কারের মালাগাসি ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপ্লায়েড রিসার্চের বিজ্ঞানীরা। রাষ্ট্রপতি আন্দ্রি রোজেলিনার আত্মবিশ্বাস আরও বেশি। Artemisia Annua’র শুকনো পাতার নির্যাস “COVID ORGANICS” দেদার বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বোতলের জুস দেশের নাগরিকরা পান করছে করোনা প্রতিরোধী হিসেবে। রাষ্ট্রপতি আন্দ্রি রোজেলিনার দাবি, আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত অন্তত আরও ২০টি দেশ চেয়ে পাঠিয়েছে এই “COVID ORGANICS” নামক Artemisia Annua’র শুকনো পাতার নির্যাস। ম্যাডাগ্যাস্কারের রাষ্ট্রনায়ক ও বিজ্ঞানীদের দাবী এই নির্যাস তাদের দেশে ঠেকিয়ে রেখেছে করোনার প্রকোপ। তাঁদের দাবির ভিত্তি হচ্ছে দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের পরিসংখ্যান। ২ কোটি ৬০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ২৮৩। যার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১১৪ জন, মৃত ব্যক্তির সংখ্যা শূন্য।
প্রথমে আশাবাদী না হলেও ৪ মে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে Artemisia Annua এবং আর্টিমিসিনিনের বিষয়ে বিশেষ আস্থা পোষণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা (WHO)। ম্যাডাগ্যাস্কারের পরিসংখ্যানেরও বিজ্ঞানসম্মত ইতিবাচক দিক দেখতে পাচ্ছে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ কলইডস এন্ড ইন্টারফেসেসের বিজ্ঞানীরা। তার পাশাপাশি Artemisia Annua’র শুকনো পাতার নির্যাস “COVID ORGANICS”-এর প্রয়োগের কোনও নেতিবাচক প্রভাবও এখন অবধি সামনে আসেনি। এ বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমাদের দেশে Artemisia’র অন্যান্য বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া গেলেও এই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতিটি পাওয়া যেত না মাত্র কয়েক বছর আগে অবধি। অশেষ উপযোগিতার জন্য বর্তমানে কাশ্মীর-সহ দেশের উত্তরের বেশ কিছু রাজ্যে ফলন হয় এই গাছটির। কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে মার্কিন বিজ্ঞানী ক্লেমনের সহায়তায় আমাদের দেশে শুরু হয় এই গাছের ফলন। Artemisia Annua নিয়ে চলা এই গবেষণার বিষয়ে আর কতগুলো বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে COVID-19-এর প্রতিকারে সুনিশ্চিত ভাবে কাজে আসবে এই ভেষজ উপাদান। সম্ভব হবে প্রাচীন আয়ুর্বেদের হাত ধরে অতি কম খরচে এই মহামারিকে আটকে দেওয়া। সম্ভব হবে দ্রুত স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো আমাদের দেশকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.