কৃষি বিল প্রত্যাহারের ফলে উত্তরপ্রদেশ, বিশেষত জাঠ-অধ্যুষিত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবে বিজেপির ভাল ফল হবে কি হবে না- তার জবাব ভবিষ্যতের গর্ভে। আপাতত এইটুকু বলা যায়, কৃষক আন্দোলন শুরুর এক বছর পরে এই বোধোদয় ঘটা রাজনৈতিক সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে ‘অ-মোদিসুলভ অ্যাকশন’। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
নির্বাচন বড় বালাই। ইদানীং তো মনে হয়, শুধু আমাদের দেশে নয়, ‘বিশ্ব’ নামক গ্রামজু়ড়েই ভোট হল রাষ্ট্রনেতাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। আর, ভারত বলে ১৩৫ কোটি মানুষের এই দেশে তো নির্বাচন কার্যত রোজকার ব্যাপার। প্রতিনিয়ত দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে ভোট হয়ে চলেছে। অতএব, উদারবাদী গণতন্ত্রে ভোটে জেতা হল প্রধান মোক্ষ। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হওয়ার পর ২০২২-এর গোড়ায় বিজেপির কাছে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ হল- উত্তরপ্রদেশে আবার জয় লাভ করা। আর, পাঞ্জাবে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের হাত ধরে কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে বিজেপি উদ্যত।
এই হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এই পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করলেন, তিনটি কৃষি আইনই প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। যাকে বলে ‘রিপিল’। মোদি নিজে হিন্দি ভাষণের মধ্যেও সচেতনভাবে ‘রিপিল’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। আবেগমথিত কণ্ঠে কৃষকদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা এবার গ্রামে ফিরে যান। চাষাবাদ করুন। পরিবার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আসুন, আমরা এক নতুন অধ্যায় শুরু করি।’
এই নরেন্দ্র মোদিকে আমরা অনেকেই চিনি না। শুক্রবার গুরু নানকের জন্মদিনে আইন প্রত্যাহার কি নিছকই আবেগতাড়িত হয়ে করলেন তিনি? কৃষকদের স্বার্থে করলেন? মানবতার কারণে করলেন? তা-ই যদি হয়, তবে এই আন্দোলনকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ কেন বলা হয়েছিল? কেন এই কৃষক-নেতাদের উপর দমননীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল? পুলিশের লাঠি, এমনকী, গুলিও চলেছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সুপুত্র তো কৃষকদের উপর দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত চালিয়ে দিলেন লখিমপুরে! গত এক বছরে কম কৃষকের রক্ত ঝরেনি।
আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল এই কৃষকরা ‘সন্ত্রাসবাদী’, এঁরা পাঞ্জাবের ধনী চাষি, জোতদার কুলাক। বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজাররা দেখিয়েছিলেন, এই চাষিদের শিবিরে এসি মেশিন লাগানো, মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউ গাড়ি আসছে, ট্রাক্টরে করে বহু পাঞ্জাবি পরিবার দিল্লি সীমান্তে এসে পিকনিক করছে, অনেকে তো আরও একধাপ এগিয়ে বললেন- কানাডা থেকে খলিস্তানিরা টাকা পাঠাচ্ছে। আবার, খলিস্তান আন্দোলন জাগ্রত করতে তৎপর বিদেশি শক্তি।
উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। একবার তিনি বলেছিলেন মোদি ‘রোল ব্যাক’-এ বিশ্বাস করেন না। তিনি ‘রোল ব্যাক’ প্রধানমন্ত্রী নন। যা সিদ্ধান্ত নেন, চট করে নেন না। তার জন্য সময় নেন, কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নিলে তা প্রত্যাহার করতে চান না। অথচ, ২০১৯-এর জয়লাভের পর থেকেই নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি নরেন্দ্র মোদি। কোনও সন্দেহ নেই, ২০১৪ সালের সেই জনপ্রিয়তা এখন তাঁর আর নেই। যদিও এখনও তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং বিরোধী শিবির ছত্রভঙ্গ, বিশেষত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তো এক ছেঁড়া তমসুকে পরিণত হয়েছে। তবু প্রকৃতির সূত্র বলে, ২০১৯ সালের পরিস্থিতিতেও বদল এসেছে। সিদ্ধান্তে অটল প্রধানমন্ত্রী এখন উত্তরাখণ্ড, এমনকী, কর্নাটকেও মুখ্যমন্ত্রী বদল করেন। অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় না-হেঁটে সমন্বয় বাড়াতে আগ্রহী। মোদি দেখলেন, ধনী-জোতদার জাতীয় তকমা দিয়েও কৃষক আন্দোলন ভাঙা যায়নি। উলটে পাঞ্জাব-হরিয়ানার ধনী কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ভাগচাষি, প্রান্তিক চাষিরা। অন্যান্য রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামের চাষিরাও এই কৃষক আন্দোলনের অ-রাজনৈতিক মঞ্চের প্রতীকী সত্তার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে পেরেছেন, যুক্ত করতে চেয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম এই অ-রাজনৈতিক মঞ্চের কৃষক-নেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। কথা বলেন। একদা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তিনি আজকের ‘মমতা’-য় উপনীত হয়েছেন। সেই মমতার সঙ্গে কলকাতায় দেখা করতে আসেন টিকায়েত। এমনকী, সিঙ্গুরেও যান। তেভাগা-তেলেঙ্গানার মধ্য দিয়ে সিপিএম একটা সময়ে যেভাবে কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছিল, মমতার তৃণমূল কংগ্রেসও সেভাবে কৃষক-চৈতন্যকে মূলধন করে এগিয়েছে।
এবারের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হতে চলেছে ২৯ নভেম্বর। মমতা দিল্লি আসছেন ২২ নভেম্বর। প্ল্যান ছিল, কৃষকদের ইস্যু নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ অচল করে দেবে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মমতার জুজু দেখছিলেন। এবং আরএসএস তথা সংঘ পরিবারও মনে করছিল, গণতন্ত্রে ভুল শোধরানো নিরন্তর আত্মখননের চেয়ে ঢের ভাল।
অতএব, মোদির রাজনৈতিক পিছু হঠা। এতে রাজনৈতিক চমক আছে। তবে, সংসদের বিরোধী-বিক্ষোভ সামলানোর এই ‘প্রি-এম্পটিভ মুভ’-এর ফলে উত্তরপ্রদেশ, বিশেষত জাঠ-অধ্যুষিত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবে বিজেপির ভাল ফল হবে কি হবে না- তার জবাব ভবিষ্যতের গর্ভে। আপাতত এইটুকু বলা যায়, একটা গোটা বছর পরে এই বোধোদয় ঘটা রাজনৈতিক সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে ‘অ-মোদিসুলভ অ্যাকশন’। এর মধ্যে পলিটিক্যাল হিপোক্রেসি-ও থাকতে পারে, কিন্তু তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণে এটা হল ভোট-রাজনীতির দাওয়াই। পিছু হঠার রাজনৈতিক রণকৌশল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.