প্রতীকী ছবি।
‘এক দেশ এক ভোট’ শৃঙ্খলটি ফিরিয়ে আনার জন্য আর্থিক সাশ্রয়কেই কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন প্রধানতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছিল। সমর্থন জানিয়েছিল প্রতিটি রাজনৈতিক দলই। তবে সেই শৃঙ্খল ভেঙে যায় ১৯৫৯ সালে, নেহরুর আমলে। মোদি সরকার তা আবার ফিরিয়ে আনতে চায়, কিন্তু নেপথ্যে আইনি ও নৈতিক বিরোধ একগুচ্ছ। ’২৪-এ আদৌ কি তা সম্ভব? কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
‘এক দেশ এক ভোট’-এর ধারণাটি নতুন নয়। বিষয়টির সঙ্গে আমরা অপরিচিতও নই। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ১৯৫১-’৫২ থেকে টানা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমরা মোটের উপর ‘এক দেশ এক ভোট’ দেখেছি। বাংলায় ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালেও আমরা একসঙ্গে বিধানসভা ও লোকসভা ভোট প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৫৯ সালে জওহরলাল নেহরু কেরলে ই. এম. এস. নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সরকারকে ৩৫৬ ধারা জারি করে ফেলে দেওয়ার পর সাময়িকভাবে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর শৃঙ্খলটি ছিন্ন হয়। ১৯৬৭ সালের পর থেকে ইন্দিরা গান্ধী ধারাবাহিকভাবে রাজ্যে-রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করতে শুরু করায় স্থায়ীভাবে শৃঙ্খলটি ছিন্ন হয়ে যায়। ছয়ের দশকের শেষ থেকে অবশ্য রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও বহু ক্ষেত্রে লোকসভা ও বিধানসভা পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। বারবার অকাল বিধানসভা ও লোকসভা ভোট হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ‘এক দেশ এক ভোট’ শৃঙ্খলটি রক্ষা করা যায়নি।
ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় ১৯৮৩ সালে ফের ‘এক দেশ এক ভোট’ শৃঙ্খলটি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব আসে। সে-সময় প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকেই এসেছিল। ‘এক দেশ এক ভোট’ শৃঙ্খলটি ফিরিয়ে আনার জন্য আর্থিক সাশ্রয়কেই কমিশন প্রধানতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। তখনও অবাধ ও স্বচ্ছ ভোটের বিষয়টি এতটা প্রাধান্য পায়নি। ফলে, বাহিনী মোতায়েনের সমস্যাটি কমিশনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ভোটে আদর্শ আচরণবিধিও এখনকার মতো কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হত না। ঘন-ঘন আচরণবিধি লাগু হওয়ার জন্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে ক্ষতি হচ্ছে, এমন যুক্তিও সে-সময় গুরুত্ব পায়নি। রাজনীতিতে ‘রেউড়ি’ সংস্কৃতিও সে-সময় এইভাবে প্রভাব বিস্তার করেনি। বারবার ভোট মানেই বছরভর গাদা গাদা প্রতিশ্রুতি, ব্যাপারটা তখনও এমন ছিল না। সরকারের অহেতুক খরচ বাঁচাতে নির্বাচন কমিশন সারা দেশে পাঁচ বছর অন্তর একটা ভোট চেয়েছিল। কমিশনের এই ভাবনাকে সমর্থন জানিয়েছিল প্রতিটি রাজনৈতিক দলই।
১৯৯১ সালে চন্দ্রশেখরের সরকার পড়ে যাওয়ার পর যখন দেশে অকাল লোকসভা ভোট নেমে এল, তখন খরচ বাঁচাতে সিপিএম বাংলা ও কেরলে একইসঙ্গে বিধানসভা ভোট সেরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মেয়াদ ফুরনোর একবছর আগেই জে্যাতি বসু বাংলায় বিধানসভা ভেঙে দিয়েছিলেন। একই ঘটনা কেরলেও হয়েছিল। ওই বছর লোকসভা ভোট চলাকালীন প্রচারে বেরিয়ে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে নিহত হন রাজীব গান্ধী। কেরলের বিধানসভা ও লোকসভার আসনে ভোট গ্রহণ হয়েছিল রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে। সহানুভূতির হাওয়ায় কেরলে পরাজিত হয়েছিল ই. কে. নায়নারের বাম সরকার। রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার আগেই বাংলায় ভোট পর্ব মিটে গিয়েছিল। ১৯৯৬-তেও বাংলায় লোকসভার সঙ্গেই বিধানসভা ভোট হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৮-তে কেন্দ্রের জোট সরকার পড়ে যাওয়ায় বাংলায় ফের একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের শৃঙ্খলটি ভেঙে যায়। একইসঙ্গে, লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের শৃঙ্খলটি এখনও টিকে রয়েছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচলপ্রদেশ ও সিকিমে।
১৯৮৩-র পর থেকে দেশে ধারাবাহিকভাবে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর বিষয়টি চর্চায় থাকলেও সেটি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সামগ্রিক প্রচেষ্টা কখনও দেখা যায়নি। ১৯৯৯ সালে আইন কমিশন প্রস্তাবটি রূপায়ণ করার কথা বলেছিল। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী ইস্তেহারে বিষয়টি রেখেছিলেন। ২০১৭ সালে নীতি আয়োগ এই নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। ২০১৮ সালে আইন কমিশন তার রিপোর্টে বলে সংবিধান সংশোধন ও জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের পরিবর্তন ছাড়া ‘এক দেশ এক ভোট’ শৃঙ্খলটি রূপায়িত করা যাবে না। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবটি দেশের অর্ধেক রাজ্যের বিধানসভায় অনুমোদন করাতে হবে বলেও জানায় আইন কমিশন। কারণ ‘এক দেশ এক ভোট’ রূপায়িত করতে গেলে কেন্দ্রকে প্রয়োজনমতো লোকসভা ও কিছু রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ সাময়িকভাবে বাড়াতে ও কমাতে হবে, যার জন্য সংবিধানের ৮৩(২) ও ১৭২(১) ধারায় সংশোধন জরুরি। সেটা আবার দেশের অর্ধেক রাজ্যের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। রাজ্যগুলির মত নিয়ে ১৯৫১-র জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং লোকসভা ও বিধানসভার ‘রুল্স অফ প্রসিডিউর’-এও পরিবর্তন দরকার। অর্থাৎ, বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক দলগুলির বোঝাপড়ার উপর দাঁড়িয়ে নেই। যেমন- নয়ের দশকে সিপিএম চেয়েছিল তাদের রাজ্যগুলিতে অন্তত একইসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোট ফিরিয়ে অানতে। সেভাবে ‘এক দেশ এক ভোট’ ফেরানো সম্ভব নয়।
একইসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের পরম্পরাটি ভেঙে দেওয়ার পিছনে দায় প্রধানত কংগ্রেসের। সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে নির্বাচিত রাজ্য সরকার ভেঙে দেওয়ার সংস্কৃতি যেমন তারা-ই চালু করে, তেমনই দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের আধিপত্য চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারগুলিতে নিয়মিত অস্থিরতা তৈরি হওয়ার রেওয়াজটি আসে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘এক দেশ এক ভোট’ শৃঙ্খলটি ফিরিয়ে আনতে গেলে লোকসভা-সহ সব রাজ্যে পাঁচ বছরের জন্য বিধানসভার স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে। যদি লোকসভা বা বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হয়, তাহলে কীভাবে সরকার গড়া যাবে, তার আইনি পথ নির্দিষ্ট করা দরকার। অনাস্থা প্রস্তাবের জেরে বা শাসক দলের ভাঙনের জেরে সরকার পড়ে গেলেও যাতে সবসময় বিকল্প সরকার গড়া যায়, তার স্পষ্ট নির্দেশিকা অাইনে রাখতে হবে। এস. আর. বোম্মাই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ৩৫৬ ধারার সংস্কৃতির কার্যত অবসান ঘটেছে দেশে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৭-এর মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে দেশে ৩৯টি সরকার ফেলেছিলেন। এ-কথা ঠিক যে, সেই পরিস্থিতি ফেরার সম্ভাবনা আর নেই। কিন্তু ‘এক দেশ এক ভোট’ ফেরাতে এখন কংগ্রেস-ই সবচেয়ে বড় বিরোধী।
‘এক দেশ এক ভোট’ উপর থেকে চাপানো হলে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিপন্ন হবে বলে কংগ্রেস-সহ বেশ কিছু বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভিমত। নরেন্দ্র মোদি সরকার নতুন করে ‘এক দেশ এক ভোট’-এর যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, তাতে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের সঙ্গে পঞ্চায়েত ও পুরভোটও করে নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। কমিটির ‘টার্মস অফ রেফারেন্স’-এ তিনটি ভোটের কথাই বলা হয়েছে। এখন পাঁচ বছরের মেয়াদে বাংলা-সহ অধিকাংশ রাজ্যে তিনটে ভোট দেখতে হয়। ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি যদি কার্যকর হয়, তাহলে পাঁচ বছরে মাত্র একবারই সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে। বিরোধীদের বক্তব্য, এতে বিধানসভা ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ভোটের চরিত্র নষ্ট হবে। সাধারণ নির্বাচন তথা লোকসভা ভোটের আড়ালে সবকিছু চাপা পড়বে। বিরোধীরা বলছে, সংবিধানের পয়লা নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভারত হল রাজ্যগুলির ইউনিয়ন। মানে, রাজ্যগুলির একটি পৃথক সত্তা আছে। রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করলে সংবিধানে বর্ণিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ক্ষুণ্ণ হবে। তাছাড়া, পাঁচ বছরের মধ্যে একাধিক ভোট দেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। কোনও একটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের রায় দেখেও কেন্দ্র বহু সময় নীতি বদলে বাধ্য হয়। পাঁচ বছরে একটি ভোট হলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা বাড়ার সুযোগ থাকে। ১৯৫১-’৫২ থেকে ১৯৬৭-র মধ্যে অবশ্য এই কথা কেন বলা হয়নি, তার সদুত্তর নেই। সেই সময় তো সংবিধান প্রণেতারাও অনেকে জীবিত ছিলেন।
সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডাকার কথা ঘোষিত হওয়ার একদিনের মধ্যেই কেন্দ্র ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে কমিটি গঠন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হচ্ছে, সংসদের বিশেষ অধিবেশনের সঙ্গে ‘এক দেশ এক ভোট’ আইন করার একটা যোগাযোগ রয়েছে। সেটার সম্ভাবনা অবশ্য কম। কমিটির দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যদি এ-সংক্রান্ত কোনও বিল আনার কথাও সরকার বিবেচনা করে, তাহলে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কমিটিকে সরকার খতিয়ে দেখতে বলেছে এই কাজের জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হলে, তা দেশের অর্ধেক বিধানসভায় পাস করানো প্রয়োজন কি না। সেটা যদি না-ও হয়, তাহলেও সংসদের দুই কক্ষে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করানো সহজ নয়। ২০২৪ সালে ‘এক দেশ এক ভোট’ হয়ে যাবে এটা এখনও পর্যন্ত কষ্টকল্পনা। তবে বিষয়টি নিয়ে যে আপাতত বিতর্ক তীব্র হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.