যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও কি মাঠে ভারত-পাক লড়াই সম্ভব? সন্ত্রাস থাবা বসাচ্ছে এপারে৷ আর ওপারের আশা ভারত মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দেবে৷ কেন? এপারের মানুষের কীসের দায়? সীমান্তে রক্তপাতের মধ্যেও কি দু’দেশের ক্রিকেট সিরিজ সম্ভব? উত্তর খুঁজলেন সুলয়া সিংহ৷
ছোটবেলায় পাশের বাড়ির এক দিদি একবার খেলার মাঝে গালে একটা চড় কষিয়েছিল৷ আমার অপরাধ, নিজের খেলনাটা ফেরত চেয়েছিলাম৷ বেশ অবাক হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম৷ পরের দিন আর ওর সঙ্গে খেলতে যাইনি৷ ক’দিন পর আবার খেলতে ডাকল৷ পুরনো কথা মনে রেখে বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে নেই৷ মা শেখাতেন৷ তাই সব ভুলে ছুটে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু আবার একই ঘটনা ঘটল৷ রাগে মুখ লাল হয়ে গেলেও সেবারও মনে মনে মাফ করে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু তৃতীয়বারও যখন ওর স্বভাবে পরিবর্তন এল না, তখন আমিই নিজের অভ্যেসটা পাল্টে ফেললাম৷ খেলার জন্য নতুন বন্ধু খুঁজে নিলাম৷
ইদানীং একটা প্রশ্ন শুনে বারবার সেই ঘটনার কথাই মনে পড়ে যায়৷ ভারত কি আর কখনও পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলবে? না কি প্রতিবেশি দেশের বিরুদ্ধে ভারতের বাইশ গজে মুখোমুখি হওয়া উচিত? উচিত হলে কেন উচিত৷ উচিত নয়ই বা কেন?
সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে চিন ও জাপানের শক্রুতা তো কম নয়৷ কিন্তু তারা কি বাস্কেটবল খেলে না? আর উত্তর বনাম দক্ষিণ কোরিয়ার লড়াই! সেও তো জন্ম থেকে শুনে আসছি৷ কিন্তু দু’দেশের মধ্যে ফুটবল তো বন্ধ হয়ে যায়নি৷ তাহলে ইন্দো-পাক ক্রিকেট নিয়ে এত জটিলতা কীসের? ‘খেলা আর সন্ত্রাসকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না৷’ ‘খেলার মাঠে রাজনীতির কোনও স্থান নেই৷’ এসব সংলাপ তো আকছার শুনি৷ কিন্তু সত্যিই যদি এমনটা হয় তাহলে পাক প্রদেশে কোহলি ভক্ত যখন আনন্দে বাড়ির ছাদে ভারতের ঝান্ডা ওড়ায়, তখন কেন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পাক ক্রিকেটাররা সেই ভক্তের হয়ে সুর চড়ান না?
এই যে আইপিএল-এ পাক ক্রিকেটারদের খেলার অনুমতি নেই৷ এখানে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের রাগটা ঠিক কোথায়? প্রতিভা সত্ত্বেও ক্রিকেটারদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না, না কি ঘরে মোটা অঙ্কের টাকা না ঢোকা! উত্তরটা নিশ্চয়ই সযত্নে শাহরিয়ার খানের সিন্দুকে তোলা রয়েছে৷ “তোমরা আমাকে সন্ত্রাস দাও, আমি তোমাদের উপার্জনের পথ চওড়া করে দেব৷” এমন স্লোগান দেওয়ার মতো ইচ্ছে বা মানসিকতা কি ভারতমাতার রয়েছে? পুরোপুরি নেইও কিন্তু বলা যাবে না৷ সেই জন্যই তো ওয়াসিম আক্রম, শোয়েব আখতারদের কাছে ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়েছে৷ আচ্ছা, তাঁরাও তো ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সিরিজ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ সেই চেনা-চেনা সংলাপগুলো আওড়ান৷ অথচ তাঁদের টুইটার অ্যাকাউন্ট তন্নতন্ন করে খুঁজেও উরির শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর কোনও চিহ্ন মিলল না! দু’দিন আগে পাক অধিনায়ক মিসবা-উল-হক তো আবার সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন৷
এতদিন যে বিষয়টা আবেদন অনুরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এবার পরিণত হল দোষারোপে! “আমরা তো খেলতেই চাই, ওরা না খেললে কী করব৷” আরে অদ্ভুত ব্যাপার তো৷ কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে আপনার বাড়িতে বিনা অনুমতিতে যারা ঢুকে পড়ে, তাদের পরিবারের সঙ্গে আপনি বসে মিষ্টি খাবেন? উত্তরটা যদি ‘না’ হয়, তাহলে ভারতীয়রা কেন ‘হ্যাঁ’ বলবে বলতে পারেন?
আমিও একজন ক্রিকেট ভক্ত৷ ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের ক’দিন আগে থেকে ক্যালেন্ডারে একটা করে দিন গত হলে পেন দিয়ে কেটে দিই৷ আর অবশেষে সেই ঐতিহাসিক দিনটি এলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে সবচেয়ে বড় ফ্যান হিসেবে ঘোষণা করি৷ তাই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে যে আমার পাঁচটা কথা বলা সাজে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়৷ এ বছর বিশ্বকাপ চলাকালীন ইডেনে প্র্যাকটিসের ফাঁকে যখন বিরাট কোহলি আর শাহিদ আফ্রিদি হাত মিলিয়ে ছিলেন, তখন একঝাঁক ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠেছিল৷ তীব্র ঝড়ঝঞ্ঝার পর এক পশলা বৃষ্টির মতোই শান্তি দিয়েছিল সেই দৃশ্য৷ আফ্রিদিকে দেখে এদেশের যে মহিলাদের মনে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, তাদের ব্যথাটা আরও কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু সত্যিকারের ভক্ত হিসেবে শুধু আমারই মনে পড়েছিল আফ্রিদির সেই কথাগুলো, ‘ভারতীয়দের মন আমাদের মতো বড় নয়৷’ সন্ত্রাসের জুজু যে দেশের মাটি থেকে ক্রিকেটকে কেড়ে নিতে পারে, তাদের মন বড় বৈকি!
হ্যাঁ, আমিও মাঠে ভারত-পাক লড়াই দেখতে চাই৷ কিন্তু রক্তঝরা পরিবেশের মধ্যে নয়৷ এই পরিবেশে আমিও কোটলার পিচ খুঁড়ে দেওয়ার ঘটনাকে সমর্থন করলে কি খুব ভুল করব? ওদের স্বভাব পাল্টাবে না৷ তাই এবারও বরং আমিই নিজের অভ্যেসটা পাল্টে ফেলি৷ নিজের ক্রিকেটীয় আবেগটা অন্য কোনও দলের জন্যই তোলা থাক৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.