২০২১-এর সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ৬৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। গত একবছর ধরে তা কমতে কমতে এখন ৫৫০ বিলিয়ন ডলারে এসে পৌঁছেছে। সরল হিসাব অনুযায়ী, তা দিয়ে ন’মাসের আমদানি খরচ দেশ মেটাতে পারবে। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে ঘাটতি হলে কী পরিস্থিতি হয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
দেশের অর্থনীতির উপর একের পর এক ধাক্কা এসেই চলেছে। প্রবল বেকারত্ব, তীব্র মূল্যবৃদ্ধির পর এবার সংকট ঘনিয়ে আসছে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে। গত কয়েক মাস ধরে যে-হারে দেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে ক্ষয় হচ্ছে, তাতে বিপদ খুব দূরে দাঁড়িয়ে নেই। এইভাবে আরও কয়েক মাস চলতে থাকলে আমদানি চালিয়ে যাওয়ার মতো বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ ব্যাংকের (RBI) হাতে থাকবে না। আমদানি কোনওভাবে সংকুচিত হয়ে গেলে দেশের কী অবস্থা হতে পারে, সে ব্যাপারে ধারণা আমাদের সকলেরই রয়েছে। জ্বালানির ৮০ শতাংশ আমাদের আমদানি করতে হয়। বিদেশি মুদ্রার সংকটে কোনওভাবে জ্বালানির ভাণ্ডারে টান পড়লে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। শ্রীলঙ্কা ছোট দ্বীপরাষ্ট্র। কোনওভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের এত বড় দেশের পক্ষে কোনও কিছুই সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।
অর্থনীতিবিদরা আশ্বাস দিচ্ছেন যে, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি এত দ্রুত ভারতে হওয়া সম্ভব নয়। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার উদ্বেগজনকভাবে প্রতি মাসে সংকুচিত হতে থাকলেও এখনও বিপজ্জনক জায়গায় আমরা পৌঁছইনি বলে তাঁদের অভিমত। যে-পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ভারতের হাতে রয়েছে, তাতে সেই পরিস্থিতি চট করে আসার কথা নয় বলেও এঁরা মনে করেন। ২০২১-এর সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ৬৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কিন্তু, গত একবছর ধরে তা কমতে কমতে এখন ৫৫০ বিলিয়ন ডলারে এসে পৌঁছেছে। গত তিন মাসে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার থেকে খরচ হয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে এখন প্রায় ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার ভাণ্ডার থেকে কমছে। রিজার্ভ ব্যাংকের ভাণ্ডারে যে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার রয়েছে, তা দিয়ে ন’মাসের আমদানি খরচ দেশ মেটাতে পারবে। কিন্তু, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি আরও কিছুদিন চলতে থাকলে, দেখা যাবে, রিজার্ভ ব্যাংকের হাতে একমাস আমদানির খরচ মেটানোর মতো ডলারও থাকবে না।
কেন এই পরিস্থিতি আচমকা তৈরি হল, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কোভিডের সময় থেকে বিশ্বের অধিকাংশ অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়েছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ যে পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি মূল্যবৃদ্ধির সংকট কাটাতে এখন নিয়মিত তাদের দেশে ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। আমেরিকা যত সুদের হার বাড়ায়, তত আমাদের দেশ থেকে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি চলে যায় মার্কিন বন্ডের দিকে। এইভাবে রিজার্ভ ব্যাংকের ডলার ভাণ্ডার কমতে থাকে। আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকেও সবসময় ধাক্কা দেয়। অতএব, একদিকে রপ্তানি কমছে এবং অন্যদিকে দেশের বাজার থেকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ উঠে যাচ্ছে। দুটো একসঙ্গে চলতে থাকায় বিদেশি মুদ্রার ক্ষেত্রে চলতি খাতে বড় পরিমাণ ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে। এই ঘাটতি মেটাতে গিয়েই বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত আট মাসে ভারত ৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা খুইয়েছে।
চলতি খাতে এই বিপুল ঘাটতি ছাড়াও টাকার দাম ধরে রাখতে রিজার্ভ ব্যাংকে ডলারের খরচ বাড়ায়। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম ৮০ টাকার নিচে যাতে না চলে যায়, তা নিশ্চিত করতে রিজার্ভ ব্যাংকের ভাঁড়ার থেকে ডলার খরচ করে। গত কয়েক মাসে রিজার্ভ ব্যাংকের যে-খরচ অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে।
প্রতি শুক্রবার বিকেলে রিজার্ভ ব্যাংক ঘোষণা করে তাদের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে কত ডলার রয়েছে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় শুক্রবারের বিকেলে রিজার্ভ ব্যাংকের এই ঘোষণা আতঙ্ক তৈরি করেছে। আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার আরও কিছুটা বাড়াতে পারে। ফলে ভারতের বাজার থেকে ডলার উড়ে যাওয়ার পরিস্থিতির আশু বদল হচ্ছে না। আমেরিকায় সুদের হার বাড়লে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি মার্কিন ট্রেজারির বন্ডেই বেশি করে লগ্নি করে। কারণ, সেখান থেকে নিশ্চিত আয় বৃদ্ধির পরিমাণ বেড়ে যায়। যত বেশি ডলার মার্কিন বন্ডের দিকে ঝুঁকবে, তত ভারতের মতো দেশে বিদেশি লগ্নির বাজারে ঘাটতি তৈরি হবে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে উন্নত দেশগুলির উপভোক্তারা তাদের ব্যয় কমাচ্ছে। ফলে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা কমছে। এই অবস্থায় ভারত যে রপ্তানি বাড়াবে, তার উপায় নেই।
আমাদের আরও সমস্যা হল, ইউরোপীয় দেশগুলি বা আমেরিকা (America) ভারতীয় পণ্যের আমদানি কমাতে পারলেও আমরা আমাদের ইচ্ছামতো আমদানি খরচ কমাতে পারি না। জ্বালানির জন্য আমাদের আমদানির উপর নির্ভরশীল থাকতেই হয়। দেশে যে পরিমাণ গাড়ি-ঘোড়া বাড়ছে, তাতে জ্বালানির খরচ কমার কোনও লক্ষণই নেই। পেট্রোল, ডিজেলের দাম দেশে ১০০ পার করলেও সাধারণ মানুষ যে এর ব্যবহার কমিয়েছে, তা মোটেই বলা যাবে না। শহরের রাস্তায় সিগনালে দাঁড়ালেই বোঝা যায় যে, প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণ জ্বালানি আমরা পোড়াচ্ছি। এই জ্বালানি পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যে আমরা দেশের বহুমূল্য বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ও খরচ করে ফেলছি, তা সবসময় বুঝতে পারি না। কিন্তু জ্বালানির খরচ এই হারে বাড়তে থাকলে সংকট অনিবার্য। সংকট পরিস্থিতি তৈরি হলে সরকারকে রেশন করে সাধারণ মানুষকে জ্বালানি বিক্রি করতে হবে। যে পরিস্থিতি সম্প্রতি তৈরি হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। প্রতিদিন একটি গাড়ি কত পরিমাণ পেট্রোল বা ডিজেল কিনতে পারবে, তা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রেও স্থির করে দেওয়া হয়েছিল একটি পরিবার বছরে ক’টি গ্যাস পাবে। ভারতেও কিন্তু এইরকম একটা পরিস্থিতি অচিরে চলে আসতে পারে। এইরকম একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে রিজার্ভ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। ফলে, বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারের ধারাবাহিক অবক্ষয় আমরা কোনওভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ বলে উড়িয়ে দিতে পারি না।
যে সমস্ত অর্থনীতিবিদ এখনও বলে চলেছেন, উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি; তাঁদের কথায় চোখ বন্ধ করে ভরসা করাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। গত তিন মাস ধরে যে পরিস্থিতি চলছে, তা একইভাবে চলতে থাকলে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি সময়ের অপেক্ষা। শুধু আগস্ট মাসেই বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গিয়েছে। সেপ্টেম্বরে এই জায়গাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, দেখা যাক। উৎসবের মরশুম শুরু হয়ে গিয়েছে। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে উৎসবের মরশুম তার চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে পৌঁছবে। এই সময় দেশে উপভোক্তারা সব খরচই বাড়াবেন। বছরের শেষে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার আরও কতটা তলানিতে যায়, এখন সেটাই দেখার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.