২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯ সংবিধান সভার ১১তম অধিবেশন শেষে আমাদের সংবিধান গৃহীত হয়। প্রশ্ন হল, অর্পণ তো করে বসলাম, কিন্তু নিজেদের সংবিধান আপন হল কি? লোকতন্ত্র স্বীকৃতি পেল, কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র পরিচালনার চাবিকাঠি এই সংবিধান কি এখনও আইনি নথি মাত্র? কতদূর তা সমাজে, সাধারণ মানুষের মননে সম্পৃক্ত হল? কলমে দীপংকর সিংহ
ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে আজকের দিনটা ‘সংবিধান দিবস’ হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দাবি করে। ১৯৪৯ সালে, সংবিধান সভার ১১তম অধিবেশন শেষে, এই দিন আমাদের সংবিধান গৃহীত হয়। যদিও চালু হতে আরও ১৪ মাস লেগে যায়। এমন দিন উপলক্ষ করে জনমানসে এই সংবিধান কতটা ‘আমাদের’ হয়ে উঠল তার অল্পস্বল্প হিসাবনিকাশ করা যেতে পারে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় শুরুতে আছে, ‘আমরা ভারতের জনগণ… সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে সংকল্প করিয়া এই সংবিধান গ্রহণ করিতেছি, বিধিবদ্ধ করিতেছি, এবং আমাদিগকে অর্পণ করিতেছি।’ প্রশ্ন হল, অর্পণ তো করে বসলাম, কিন্তু নিজেদের সংবিধান আপন হল কি? লোকতন্ত্র স্বীকৃতি পেল, কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র পরিচালনার চাবিকাঠি এই সংবিধান কি একটা আইনি নথি হয়েই থাকল? কতদূর তা সমাজে, সাধারণ মানুষের মননে সম্পৃক্ত হল?
ভারতের সংবিধান মূলত ‘এলিট’ ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট নথি, এরকম বক্তব্য আছে। এটা ঘটনা যে, সংবিধান-প্রণেতাদের অধিকাংশই এসেছিলেন সমাজের উচ্চতম পর্যায় থেকে। ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে টানা ২ বছর ১১ মাস ধরে সংবিধান সভায় যে-বিতর্ক চলে তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এই শ্রেণির মানুষজন। ওই সভায় মধ্যবর্গের লোকজন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। নারী প্রতিনিধি ছিল মাত্র ২০ শতাংশ! খসড়া কমিটি ছিল নারীবর্জিত। তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ এঁদের বিশেষ মেলেনি। এ-কথাও বলা হয়– ব্রিটিশ সংবিধান, ব্রিটিশ সংসদ-প্রণীত ‘ভারত শাসন আইন’ (১৯৩৫) ও যুক্তরাষ্ট্র-সহ কয়েকটা বিদেশি দেশের সংবিধান ঘেঁটে তৈরি এই সংবিধান ততটা ভারতের জমি-নির্ভর নয়। গলদ কি তাহলে গোড়াতেই?
সংবিধান সভার বিতর্কের গঠন, গতিপ্রকৃতি ও সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার অবকাশ আছে। কিন্তু তাঁদের এক ধরনের সদিচ্ছা ছিল। সদ্যস্বাধীন দেশে রাষ্ট্রনির্মাণের সদিচ্ছা, যা সংবিধান জুড়েই প্রকাশ পেয়েছে।
কোনও সংবিধান-ই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়, ভারতের সংবিধানও এই বিধানের ব্যতিক্রম নয়। আর তা নয় বলেই, প্রণেতারা ভারতের সংবিধানকে ‘জীবন্ত নথি’ বলে অভিহিত করেন। এর অর্থ, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই সংবিধানে পরিবর্তন করা যাবে। শতাধিক সংশোধন একদিকে সংবিধান রূপকারদের এই বক্তব্য বাস্তবায়িত করেছে। তবে, এর অন্যদিকও আছে।
সংবিধানের জিয়নকাঠি তো জনগণ। সংবিধান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততায়। যেহেতু ‘We the People’ শব্দবন্ধ আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে ধার করেছি, এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ওই দেশে ১৭৮৭-’৮৮ সালে সংবিধান অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ‘জনগণ’ ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। সংবাদপত্র, কফি হাউস, এমনকী, ডাইনিং টেবিলও হয়ে ওঠে আলোচনার জায়গা। এ বিষয়ে পলিন মাইয়ার-এর বই ‘Ratification: The People Debate the Constitution, 1787-1788’ (২০১০) উল্লেখযোগ্য। ভারতে জনগণের এমন সুযোগ জোটেনি। পরিস্থিতিও ছিল অন্যরকম। সাত দশক পার হয়ে গেলেও এখানে সংবিধান চেতনায় জনগণকে শামিল করার কাজে বেশ ঘাটতি থাকল। তা বলে সাধারণ মানুষ যে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছে তা নয়। রোহিত দে-র “A People’s Constitution: The Everyday Life of Law in the Indian Republic” (২০১৮)-এ দেখা যায়, কীভাবে সাংবিধানিক ভাষার ‘গণ্ডি’ ও ‘র্যাডিক্যাল’ রাজনৈতিক আন্দোলনের সীমানা ছাপিয়ে দলিত, আদিবাসী-সহ প্রান্তভুক্ত, সুবিধাবঞ্চিত আমজনতার একাংশ মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে সংবিধানকে ‘জন সম্পদ’-এ রূপান্তরিত করছে। তবে এতে মূল ছবিটা বদলায়নি।
লক্ষণীয়, ভারতে অতি-বামপন্থী ছাড়া সব রাজনীতিবিদ-ই সংবিধানের দিব্যি দিতে কসুর করেন না। বিচিত্র শোনালেও বলতে হয়, দেশের রাজনীতির মানে ভীষণ অবনমন সত্ত্বেও যত্রতত্র সংবিধানের আবাহন কমেনি, হয়তো ঘটা বেড়েছে। দেশের নানা প্রান্তে জনসাধারণের অধিকার লঙ্ঘনে রাজনৈতিক শক্তি ‘সাংবিধানিক অধিকার’-কে বাগাড়ম্বরে পরিণত করেছেন। এমনটাই হওয়ার কথা। কারণ, সংবিধানের অন্যতম চালিকাশক্তি আইনের অনুশাসন যত পিছু হটবে, সংবিধানের দৃশ্যমানতা ও তার মূল উদ্দেশ্য সাধিত করার প্রচেষ্টাও শাসকদের বাগাড়ম্বরে ক্রমশ গৌণ হয়ে যাবে। দেশে যত জনমোহিনীবাদী (populist) রাজনীতি ঘনীভূত হবে, ‘আমরা, ভারতের জনগণ’-এর জীবন থেকে সংবিধান ও সাংবিধানিক বিন্যাস দূরে থেকে যাবে। কারণ, আইন অনুশাসনের উপাদান মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা ও অবশ্যই জনগণের রায়ে নির্বাচিত সরকারের সীমিত ক্ষমতা ভারতের সংবিধান জুড়ে প্রতিফলিত হয়।
আজকের দিনটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সংবিধান দিবস’ হিসাবে পালন করার নির্দেশ জারি করেছে ‘ইউজিসি’। ‘একতরফা’ এই সিদ্ধান্তে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। নেই মামার চেয়ে হয়তো কানা মামা ভাল। কিন্তু বছরে একদিন এ কাজ করে সংবিধান চেতনা তৈরি করা যায় না। আসলে, আমাদের দেশে তৃণমূল স্তরে সংবিধান সাক্ষরতার বিষয়টাও উপেক্ষিত। দু’-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। যেমন, কেরলের কোল্লাম জেলায় নাগরিক সংবিধান সাক্ষরতা প্রচারে স্থানীয় অধিবাসীদের সংবিধানের ইতিহাস, প্রস্তাবনা, মৌলিক অধিকার ও সাংবিধানিক পথে আইনি প্রতিকার সম্বন্ধে সচেতন করা হয়।
আমাদের দেশে স্কুল পর্যায়ে সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়ানোর চল থাকলেও তাতে যান্ত্রিকতাই বেশি। কোথাও সহজ-সরল ভাষায় ব্যাপকভাবে সংবিধানের মূল বিষয়গুলো জনমানসে তুলে ধরার উদ্যোগ নেই। গ্রাফিক বইয়ের যুগে চিত্তাকর্ষক ছবি দিয়েও তো সংবিধানকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়। আমেরিকায় তার নিদর্শন আছে। আইনি ভাষা সংবলিত প্রায় ৪০০ পাতার জটিল সংবিধান সাধারণ মানুষ পড়তে পারে না। সেজন্য কি তারা নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকারের উৎসমুখ সম্পর্কে জানতে পারবে না? একজন নিরক্ষর, সহায়-সম্বলহীন ভারতীয় নাগরিকেরও তো অধিকার আছে তার জীবনে সংবিধানের কী ভূমিকা, তা জানার।
দেশে ভোটতন্ত্র রাজনীতিকদের হাতে যে ‘পরিশীলিত’ রূপ পেয়েছে তাতে নিশ্চিতভাবে তাঁরা-ই নানা রূপে ক্ষমতায় থাকবেন। জনগণ সরাসরি শাসনক্ষমতা দখল করতে পারে না, করতে যাচ্ছেও না। তাহলে মানুষের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে সংবিধান-চেতনা আনতে এত কুণ্ঠা কেন? অধিকার-সচেতন আত্মপ্রত্যয়ী সহ-নাগরিকের সঙ্গে সহাবস্থান কি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ? শাসকবর্গ কেন যে ‘জয়’ করেও ভয় পান!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.