Advertisement
Advertisement
Congress

আবার একটা ‘চিন্তন শিবির’, তবুও কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ কি ধূসর?

এর উপযোগিতা কতখানি?

Is 'Chintan Shibir' path to Congress' salvation | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:May 14, 2022 3:26 pm
  • Updated:May 16, 2022 4:43 pm  

আবার একটা ‘চিন্তন শিবির’? এর উপযোগিতা কতখানি? অতীতে কংগ্রেস ভেঙে জাতপাতের দল হয়েছে, ধর্মের দল হয়েছে, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক দল হয়েছে। কেননা, কংগ্রেসের মধ্যে ছিল বহুত্ববাদের উপাদান। অথচ এখন শতাব্দীপ্রাচীন দলটি নিজের অবস্থান ও কনভিকশন স্থির করতে পারছে না। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

তেলেঙ্গানায় কিছুদিন আগে রাহুল গান্ধী একটি জনসভা করলেন। সেই জনসভায় এক অভূতপূর্ব ভিড় লক্ষ করা গেল। এখন কংগ্রেসের জনসভায় ‘ভিড়’ এক বিরল ঘটনা। শুধু রাহুল গান্ধী কেন, কংগ্রেসের শীর্ষনেতা থেকে কর্মী প্রত্যেকেই সেই জনসভার সাফল্যে উদ্দীপিত। অনেকে অবশ্য বলছেন যে, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর এবং শাসকদলের বিরুদ্ধে মানুষের অভাব-অভিযোগও তীব্র, অসন্তোষও প্রবল। তারই প্রতিফলন ঘটেছে জনসভায়।

Advertisement

সে কারণ যাই হোক, তেলেঙ্গানার এই জনসভার সাফল্য দেখে রাহুল-ঘনিষ্ঠ শীর্ষ কংগ্রেস নেতা রজনী পাটিলে বলেছেন, ‘চিন্তন শিবির’ করে কী হবে? ‘চিন্তন শিবির’ তো কোনও বাস্তব সমাধান এনে দেয় না। গত কয়েক বছর ধরে তো নানা স্তরে চিন্তন-ই চলছে। তার চেয়ে ভাল, তেলেঙ্গানায় যেভাবে কংগ্রেস জনসভা সংগঠিত করেছে, ঠিক সেইভাবে রাজ্যে-রাজ্যে জনসভা হোক। আর, সেই সভায় রাহুল গান্ধী উপস্থিত থাকুন। তার জন্য যদি রাহুল গান্ধী সময় দিতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে কংগ্রেসের প্রাপ্তি।

[আরও পড়ুন: রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে স্থগিতাদেশ এলেও রয়েছে আরও ভয়ঙ্কর ইউএপিএ]

রজনী পাটিলের বক্তব্য নিয়ে কংগ্রেসে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। এই সরগরম পরিস্থিতিতে বেশ কিছু কংগ্রেস নেতা আবার এটাও বলছেন, জনসভা তেলেঙ্গানায় সফল হয়েছে তা’ বলে সব রাজ্যে একটা করে জনসভা করার ক্ষমতা কি আছে কংগ্রেসের? পশ্চিমবঙ্গে রানি রাসমণি রোডে লোক জোগাড় করতে গেলে কংগ্রেসকে হিমশিম খেতে হয়। গেল বিধানসভা ভোটের পর তো কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গ থেকে কার্যত নিশ্চিহ্ন। এমনকী, যে মধ্যপ্রদেশে পাঁচমারি ‘চিন্তন শিবির’ হয়েছিল ১৯৯৮ সালে, সেই মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস কত দিন রাজত্ব করল? লখনউ শহরের ভোট হয়ে গেল। কিন্তু সে-অর্থে সংগঠিত বৃহৎ জনসভা কোথায় দেখলাম আমরা? কোনও ঘটনা ঘটলে রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা যান বটে। তবে ধারাবাহিকভাবে নিয়ম করে যেভাবে বিজেপির নেতারা জনসভা করেন, তদনুরূপ সভা-সমিতির সংগঠন কংগ্রেসে শেষ কবে হয়েছে?

প্রশ্ন উঠবে, তাই বলে ‘চিন্তন শিবির’ যখন উদয়পুরে হচ্ছে, তখন অন্যায়টাই বা কী? শুধু ওয়ার্কিং কমিটির নয়, কংগ্রেসের নানা স্তরের নেতারা এসে এক-একটা ‘চিন্তন শিবির’ করছেন। নাই বা হল সেটা এআইসিসির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন, তাই বলে আলাপ-আলোচনার একটা প্রক্রিয়া তো পিরামিডের উপরের চূড়া থেকে তলার স্তর পর্যন্ত পৌঁছয়। বাঘ-সিংহ থেকে পিপীলিকা প্রত্যেকের কাছে বার্তা পৌঁছে উজ্জীবিত করতে পারলে সেটা তো খারাপ কিছু নয়! কিছু না-হওয়ার থেকে তো কংগ্রেসে কিছু একটা হচ্ছে- এটাই ‘ব্রেকিং নিউজ’!

‘চিন্তন শিবির’-এ সংগঠন এবং জনসভা এড়িয়ে ইলেকট্রনিক চ্যানেল এবং ডিজিটাল মিডিয়ার আনুকূল্যে আলাপ-আলোচনার আবহ তৈরি করে কংগ্রেস। যা বিজেপিও করে। এতে করে কিছু ‘আলেখ্য’ (ন্যারেটিভ) তৈরি করা যায়। সেই আলেখ্য হলই বা ভারচুয়াল রিয়্যালিটি। কিন্তু তারও একটা বাজারদর আছে এই সময়ে। কিন্তু বিজেপি সেই ভারচুয়াল রিয়্যালিটিকে যেভাবে উৎপাদন করে, ঠিক তেমনভাবেই বাস্তবে সংগঠন এবং জনসভার কাজও করে। শুধু মোবাইলের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ অভিযান নয়। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরিবারের সাহায্য নিয়ে ভোটের সময় এবং ভোটের পরে বিজেপি জেলায় জেলায় কাজ করে।

একটা উদাহরণ দিই। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় প্রতি মুহূর্তে বিজেপি কাজ করছে। তা’ বলে নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ নিয়মিত সংযোগ রাখছেন তা নয়। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মাকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কার্যত। বিজেপির রাজ্য সভাপতি হেমন্তর কাছে আসেন নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে। আর, হেমন্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় স্তরে সেগুলির সমাধানের চেষ্টা করেন। সংগঠনটি বাড়াতে সাহায্য করেন। সমস্যার সমাধান সেখানে না হলে, বা জটিলতা বাড়লে তা তারপর দিল্লি এসে পৌঁছয় অমিত শাহর কাছে। এই যে একটা বিকেন্দ্রীভূত, অথচ সংগঠিত সরকার ও সংগঠন চালানো, সেটা কীভাবে সম্ভব- তা জানতে হবে রাহুলকে, শিখতে হবে।

১৯৯৮ সালে যখন পাঁচমারিতে অধিবেশন হয়েছিল, এখনও মনে পড়ে, তখন বিরাট বিতর্ক হয়েছিল যে, ‘একলা চলো রে’ নীতি থেকে সরে এসে কংগ্রেস শরিক দলগুলোর হাত ধরবে কি না, জোট রাজনীতিতে যাবে কি না তা নিয়ে! সংস্কৃতি এবং কংগ্রেসের জোটের বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়ে কৌশল পরিবর্তনের কথা প্রসঙ্গে জোরাল সওয়াল তুলেছিলেন অর্জুন সিং। প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, জোট দরকার, জোটের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু কংগ্রেস যদি বেশি জোট করে, জোটের সঙ্গে আপস করে, কংগ্রেসের স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। দলটি আবার স্বমহিমায় ফিরে আসবে, যদি তারা ‘একলা চলো রে’ নীতির দীর্ঘমেয়াদি কৌশলে অটল থাকে।

সুতরাং, অস্থায়ীভাবে সাময়িক জোট সংস্কৃতিতে কিন্তু কংগ্রেসকে এগতে হবে নিজের মর্যাদা রেখে। তবেই তারা ফিরে পেতে পারে হৃতগৌরব। কংগ্রেস ভেঙে জাতপাতের দল হয়েছে, কংগ্রেস ভেঙে ধর্মের দল হয়েছে, কংগ্রেস ভেঙে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক দল হয়েছে। কেননা, দলটির মধ্যে ছিল বহুত্ববাদের সব উপাদান। তাই তাদের পুনরুজ্জীবিত হতে গেলে জোট শরিক নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

সেই বিতর্কের অবসান ঘটেছে। পাঁচমারির পরে দীর্ঘদিন কংগ্রেস জোট সরকার চালিয়েছে। এই জোট যে প্রয়োজন, তা বোঝার জন্য কি পাঁচমারি অধিবেশন খুব জরুরি ছিল? ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে কীভাবে জোট সরকার গড়া যায়। সেই সরকারের জোটের সংস্কৃতি এবং মণ্ডল কমিশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল গঠন, তার ইতিহাস আমাদের আর কারও অজানা নয়। মোরারজি দেশাইকে দিয়ে চরণ সিংয়ের সরকার গঠনের যে-রণকৌশল, সেটাও রাজীব গান্ধীর চন্দ্রশেখরকে সমর্থন জুগিয়ে। রাজীব গান্ধী চন্দ্রশেখরকে সমর্থন করলেন, তার পরেও দেবগৌড়া এবং গুজরালেরও সমর্থন করে কংগ্রেস জোট সরকার চালিয়েছে।

কিন্তু এখন কংগ্রেস ‘একা’ চলতে পারবে না, সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। সোনিয়া গান্ধীর মতো নেত্রীকেও কিন্তু পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল রামবিলাস পাসোয়ানের বাড়ি, মানভঞ্জন করতে। অনেকে বলেছিলেন যে, এটা ‘রাজনীতিকদের শো’। তবে সেই রাজনীতিতে ‘রাজনীতি’-টা দেখানোটা জরুরি ছিল। বার্তা দেওয়ার দরকার ছিল যে, সোনিয়া গান্ধী শুধু রামবিলাস পাসোয়ানের আঞ্চলিক দলের কথা নয়, দলিত জনসমাজের কথা বাস্তবে ভাবছেন। এখন তো দলিত সমাজের বাড়িতে খেতে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে, সেগুলোর আবার ‘ফোটো সেশন’ হয়। কিন্তু তাতে কংগ্রেসের সংগঠন কি বাড়ে? তাতে কি কংগ্রেসের নেতৃত্বের সমাধান হয়? ‘চিন্তন শিবির’-এ রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে, তাই উদয়পুর বেছে নেওয়া হয়েছে এটা খুব স্বাভাবিক। তাতে অনেক সহজ হয় এই ধরনের সংগঠন করতে। কিন্তু সেই চিন্তন শিবিরে দাবি উঠছে যে, রাহুল গান্ধীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সভাপতি’ হিসাবে গ্রহণ করে নেওয়া। যদিও প্রশান্ত কিশোরের অভিমত, গান্ধী পরিবারকে সরিয়ে অন্য কোনও নেতাকে সামনে রাখলে দলের ভাল ফল হবে।

সমস্যা হচ্ছে যে, এই পরিস্থিতিতে একের পর এক ভোটের ফলাফলে কংগ্রেস হারছে। কংগ্রেসের শতকরা ভোট কমছে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে বিশ্বাসযোগ্যতাও কমছে। বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়ায় রাহুল গান্ধী হাসির খোরাকে পরিণত। কিন্তু তা প্রতিহত করতে এখনও কংগ্রেস তার জমিদারি সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আধুনিক হয়ে উঠতে পারছে না।

সুতরাং, চিন্তন শিবিরে কংগ্রেস ২০২৪ সালের আগে একটা সুস্পষ্ট পথনির্দেশিকা তৈরি করবে, আর হইহই করে আবার ভৈরব গতিতে এগবে- এমনটা বোধহয় আশা কংগ্রেস-কর্মীরা নিজেরাও করছেন না। রাহুল গান্ধী সম্প্রতি বলেছিলেন যে, ক্ষমতা হচ্ছে বিষ, তিনি সেই বিষপান করতে চান না। তিনি মানুষের উন্নয়ন চান। কিন্তু আজকের রাজনৈতিক ক্ষমতার রাজনীতিতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশলকে কী বলা হয়?

রাহুল গান্ধী ক্ষমতাকে যদি ‘বিষ’ বলে মনে করেন, তবে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে সন্ন্যাস নিচ্ছেন না কেন? তাই ‘চিন্তন শিবির’-এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল সুস্পষ্ট কনভিকশন। ‘সাদা’ এবং ‘কালো’, অথবা ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর রাজনীতির মধ্যেই কোথাও একটা রাহুল গান্ধীকে দলের হয়ে অবস্থান নিতে হবে। কারণ, ধূসরতার মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে
পারে না।

[আরও পড়ুন: ভারতীয় রাজনীতিতে অব্যাহত প্রতিহিংসার ধারা, সংবিধানের শক্তি কি গতায়ু?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement