কিশোর ঘোষ: এক বাঙালি কবির স্বপ্ন শুনে সেদিন খুব মন খারাপ হল। স্বপ্ন শোনানোর আগে কবি সরাসরি বললেন, ”পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা অস্ত যাচ্ছে। মানতে হবে, পছন্দ না হলেও সত্যি।” আমি বললাম, ”আপনিও বলছেন!” কবি বললেন, ”হ্যাঁ।” আমি বললাম, ”স্বপ্নটা বলুন।” কবি বললেন, ”ছোট স্বপ্ন। দেখলাম, আমি একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পায়ের কাছে থরে থরে সাজানো চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস, মঙ্গলকাব্য, ঈশ্বর গুপ্ত, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শঙ্খ, শক্তির বই। আমি একেকটা বই হাতে তুলছি, পাতা ছিঁড়ছি আর ছাদ থেকে উড়িয়ে দিচ্ছি। পাতাগুলো খানিক দূরে উড়ে গিয়ে দপ করে জ্বলে উঠছে।”
গড় হিসেব বলছে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও দেশ-বিদেশের প্রবাসী মিলিয়ে ৩০ কোটি মানুষ বাংলা বলেন। বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক কথ্য ভাষা, এও সত্যি। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বাংলাভাষার (Bengali Language) একজন প্রধান কবি এমন ভয় ধরানো স্বপ্ন দেখলেন কেন? তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় বলেই কি? এটা একটা সত্যি। তবে আরও প্রশ্ন আছে। যেমন, এই যে কোটি কোটি লোকে বাংলা বলছেন, তারা কেমন বাংলা বলছেন? তারা কতটা বাংলা, কতটা ‘বাংরাজি’ আর কতখানি ‘বাংহিংরাজি’? এবং সবচাইতে জরুরি প্রশ্ন, বাংলা ভাষা কি আগে যতটা পারত আজও ততখানি খেতে দিতে পারে বাঙালিকে? ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, চিনা, কোরিয়ান, পর্তুগিজ, হিন্দি, তামিল, তেলুগু যতখানি খেতে দেয়, ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়!
বাংলাদেশে খেতে দেয়। কিন্তু ভারত দেশের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্রমশ খেতে দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলা ভাষা। দিনে দিনে কমছে পত্রপত্রিকার সংখ্যা, কমছে সংবাদপত্রের পাঠক। জলশায় নিখাদ বাংলা গানের শিল্পীর ডাক পড়ছে কম। ডাক পড়লেও তাঁদের দক্ষিণা হিন্দি শিল্পীর তুলনায় অতি সামান্য। এবং বাংলা ভাষা জানলে চাকরি পাওয়া যাবে, এমন বাক্য আর ভাবাই যাচ্ছে না! ফলে কবির ছেলেও সাহেব হওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছে ছোট্ট থেকে। কবিই ঠেলে দিচ্ছেন ট্রেনিংয়ে। কঠিন সত্যি হল, যে ভাষা খেতে-পরতে দেওয়ার ক্ষমতা হারায় তাকে পাত্তা দেয় না সেই ভাষাভাষী মানুষও। তাহলে ভাষার প্রতি ভালবাসা বলে কি কিছু নেই!
মাতৃভাষার প্রতি ভালাবাসা চলে গিয়েছে প্রবাসে। দেশ, রাজ্য, ভাষা থেকে দূরে গিয়ে মনে পড়ে পাড়ার কাঁঠালগাছের ছায়াশান্তির কথা, আশিতলার ব্যালকনি, একা চেয়ার চোখের জল ফেলে থেকে থেকে! সজনে ফুলের গন্ধ মনে পড়ে! এই পর্যায়ে বাংলা গালাগালও সুমিষ্ট বলে মনে হয়। অস্তিত্ব কী এবং তা রক্ষার প্রয়োজন কেন, এইসব হিসেবও স্পষ্ট হয় বয়স যত বাড়ে। ফলে ইউরোপ থেকে আমেরিকা, সবখানে আছে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন বা ক্লাব।বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয় হাজারও পত্রিকা। অন্তর্জালের যুগে যা বেড়েই চলেছে। তেমন একটি পত্রিকা অগ্রবীজ। এই অ্যাকাডেমিক বাংলা পত্রিকাটি এক সময় খেতে দিয়েছিল এই প্রতিবেদককে। কাগজটি বের হত (এখন অনিয়মিত) একযোগে ভারত, বাংলাদেশ ও আমেরিকা থেকে। কেন? কারণ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকদের কেউ কেউ থাকতেন আমেরিকায়, একজন কানাডায়, একজন অস্ট্রেলিয়ায়। বলা বাহুল্য সকলেই বাঙালি, সকলেই বিদেশে গিয়ে মাতৃভাষার টান বেশি করে টের পান। এবং বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
দু’বছর হায়দরাবাদে থেকে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির টান বাড়িয়ে নিয়েছিল এই প্রতিবেদকও। তেলুগু, হিন্দি, ইংরেজি পিছলে হঠাৎ বাংলার দেখা পেলে মনে হত, এই তো আয়না, নিজের সঙ্গে দেখা হল, খানিক সংস্কৃতি আঁচড়ে নিই! এই কারণেই হায়দরাবাদ বাঙালি সমিতির এত ঘ্যাম। বিরাট দুর্গাপুজো করে সমিতি। করোনাকালে পুজোর সময়ে যাতে করে কম লোক হয়, সেকথা ভেবে মোটা অংকের অনুদানের নিদান ঘোষণা করেছিল। কিন্তু পকেট খসিয়ে সেই টাকা দিয়েও লোকে বাঙালি সমিতির পুজো দেখতে গেছিল। আসলে তো গিয়েছিল হাওয়া-বাতাসে বাংলা অক্ষর উড়ছে… এমন এক পৃথিবীতে খানিক সময় কাটাবে বলে। পুজো মণ্ডপের উলটো দিকেই ছিল মঞ্চ। সেখানে গান গাইলেন একজন বাঙালি গায়ক। নাম বলা ঠিক হবে না, তবে তিনি সেদিন খানিক বেসুরো। যদিও সেই গানও সুরে বাজছিল বাঙালি শ্রোতার কানে! তার চেয়ে বড় কথা, যে গায়ক কলকাতা থেকে হায়দরাবাদে গিয়ে প্রবাসী বাঙালিদের মনোরঞ্জন করলেন, তাঁকে খেতে দিচ্ছে বাংলা ভাষা!
এই ব্যাপারটা যতদিন থাকবে, যতটুকু থাকবে ততটুকুই বাংলা ভাষার বাঁচা। বাঁচা কাগজওলার, বৈঠকখানা স্ট্রিটের বাইন্ডার ছেলেটির ঘাম ফেলা রুজির, আর কতও ছোট বড় টিকে থাকা! নচেত সারা বছর হিন্দি ও ইংরেজি সংস্কৃতির বাণিজ্য বাড়িয়ে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি সেজে কিছু লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে বাঙালি কবির স্বপ্নই সত্যি হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.