অর্থের প্রাচুর্য দেখেই বোঝা যায়, কতটা বদলে গিয়েছে ক্রিকেট। ১৯৮৩ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জয়, উদারীকরণের ফলে স্যাটেলাইট টিভিতে বিপ্লব, এবং আইপিএল-এর উল্কাসম উত্থান– এই তিন পদক্ষেপ ভারতীয় ক্রিকেটকে করে তুলেছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। কিন্তু এর দাপটে ক্রিকেট সংস্কৃতি গোল্লায় যাচ্ছে না তো? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া’ ওরফে ‘বিসিসিআই’ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জয়ী দলকে ১২৫ কোটি টাকা উপহার দেবে, এই খবরটুকুই যথেষ্ট বোঝার জন্য যে, দেশের ক্রীড়া-মানচিত্র কতটা বদলে গিয়েছে। ভাবুন তো, সেই পঁাচ-ছয়ের দশকের কথা, যখন ভারতীয় টেস্ট খেলোয়াড়রা ম্যাচ-বাবদ পেতেন ২৫০ টাকা। এমনকী, যেবার ভারত নিউজিল্যান্ডকে তিনদিনের মাথায় হারায়, সেবারও ক্রিকেটারদের বিস্মিত করেছিল মাথাপিছু ১৫০ টাকা পারিশ্রমিক। কেন ১০০ টাকা কম পেয়েছিলেন তঁারা? কারণ, বোর্ড দিনমজুরির হিসাবে তঁাদের সাম্মানিক দিয়েছিল। পঁাচ দিনের টেস্ট তঁারা দুর্ভাগ্যবশত দু’দিন আগে শেষ করে ফেলেছিলেন কিনা!
১৯৭১ সালে, যখন ভারত সমুদ্রপারের খেলায় প্রথমবার ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করল, তখন যে-জনসমুদ্র খেলোয়াড়দের বরণ করেছিল, তা এই রোহিত শর্মার নীল জার্সির সেনাদের ঘিরে থাকা উত্তেজিত ভক্তকুলের থেকে সংখ্যায়, আয়তনে ছিল বড়। কিন্তু সেখানেও, তেমন অর্থকরী সুযোগসুবিধা পাননি খেলোয়াড়রা। কারও কারও হয়তো স্মৃতিতে আছে যে, সে-সময় খেলোয়াড়দের কোনও একটি টেক্সটাইল কোম্পানির তরফে সুট পিস উপহার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে মাইলফলক রচিত হল, কপিল দেবের দল যখন প্রথম বিশ্বকাপ জিতল, শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে আশ্চর্যজনকভাবে পরাস্ত করে। সেই বিশ্বজয়ী দলের খেলোয়াড়রা প্রত্যেকে ২০,০০০ টাকা করে পেয়েছিলেন। কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর তখন একটি সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করলেন, সেই অনুষ্ঠানের লভ্যাংশ পেলেন খেলোয়াড়রা। অঙ্কটা নেহাত কম নয়, জনপিছু এক লক্ষ টাকা। কিন্তু টাকার মূল্যবৃদ্ধির নিরিখেও তা কোনওভাবেই এই ১০০ কোটির বেশি অর্থের কাছাকাছি আসে না, যা এবারের বিশ্বজয়ী দলের খেলোয়াড় আর দলের সঙ্গে জড়িত সদস্যরা পাচ্ছেন এখন।
এই অর্থের ছররাটাই, দৃশ্যত, ভারতীয় ক্রিকেটের একাল ও সেকালের পার্থক্য সূচিত করছে। কোটি কোটি টাকার চুক্তি ও অন্যান্য অগুনতি সুবিধা আন্তর্জাতিক স্তরের খেলোয়াড়রা তো পাচ্ছেনই, এমনকী, আঞ্চলিক খেলোয়াড়রাও এখন সচ্ছল জীবনযাপন করেন খেলার সুবাদে। রঞ্জি ট্রফির কথাই ধরা যাক। বিসিসিআই ইদানীন্তনে প্রতিদিনে ৪০,০০০ থেকে ৬০,০০০ টাকা দেয় ম্যাচ ফি হিসাবে। যেসব আঞ্চলিক ক্রিকেটার গোটা সিজন খেলেন, তঁারা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন। এবার যদি ছয়ের দশকের রঞ্জি খেলোয়াড়দের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে চমৎকৃতই হতে হবে। তঁারা পেতেন ম্যাচ প্রতি মাত্র ১০ টাকা! সেই প্রজন্মের অনেকের কাছেই ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বা টাটা জাতীয় উদার বেসরকারি সংস্থায় চাকরি ছিল প্রাণভোমরার শামিল।
কিন্তু তিনটি যুগান্তকারী মুহূর্ত ভারতীয় ক্রিকেটকে করে তুলল কোটিপতিদের রাজত্ব। নিঃসন্দেহে প্রথম সোপানটা বিশ্বকাপ জয়। এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল এই অর্জন, যে, একটা গোটা প্রজন্ম স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা পেয়েছিল। এর ঠিক চার বছর পর, বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডের গণ্ডি পেরিয়ে বেরিয়ে এল। সেই প্রথম ভারতে বিশ্বকাপ খেলা হল। নব্বইয়ের গোড়ায় এল দ্বিতীয় বঁাক বদল। যখন অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং পণ্যসভ্যতার বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গেই এল ‘ওপেন স্কাই’ পলিসি বা ‘মুক্ত আকাশ’ নীতি, যা স্যাটেলাইট-নির্ভর দূরদর্শনে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল। খেলোয়াড়দের নিজস্ব ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ আবিষ্কারের সেই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। বিশেষ করে শচীন তেন্ডুলকর হয়ে উঠলেন টেলিভিশনের পর্দায় বিবিধ পণ্য বিপণনের প্রধান মুখ। তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় এল, যখন ২০০৮ সালে দুনিয়া কঁাপিয়ে শুরু হল ‘ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ’ ওরফে ‘আইপিএল’। আচমকাই, ক্রিকেট কেবলই ভারতীয়দের কাছে বিনোদন রইল না, বরং হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক ক্রীড়া। প্রায় প্রতিটি আইপিএল টিমের মূল্য এখন কোটি-কোটি টাকায় নির্ধারিত।
খোদ আইপিএল হয়ে উঠেছে আবিশ্ব সম্পদশালী টুর্নামেন্টগুলির দ্বিতীয়, প্রতি ম্যাচের মূল্যের ভিত্তিতে মার্কিন মুলুকের ন্যাশনাল ফুটবল লিগের ঠিক পরেই। স্বেচ্ছা নির্বাসনে বসে আইপিএলের আদত কান্ডারি ললিত মোদি নিশ্চয়ই বিস্মিত হন ভেবে যে, কোন রঙের তাস তিনি ক্রিকেট-বিশ্বর কাছে উন্মোচিত করেছেন।
এসবই অতি উত্তম বিষয়। খেলাধুলো আকাঙ্ক্ষাকে লালন করে, প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটায়। লক্ষ কোটি ভারতীয়র স্বপ্ন চরিতার্থ করে। পাশাপাশি আশ্বাসের যা, ক্রিকেটের এই বিপুল ঐশ্বর্য ধীরে-ধীরে সব খেলার উপর অভিঘাত সৃষ্টি করছে। যেমন, ২০২৪ সালের প্যারিসে আমাদের যে-অলিম্পিয়ানরা যাবেন, তঁারা পারিশ্রমিক আগের চেয়ে ঢের বেশি পাবেন, প্রশিক্ষণও পাবেন সর্বকালের সেরা। ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন থেকে শুরু করে বর্শা নিক্ষেপের খেলার অবিশ্বাস্য নায়ক নীরজ চোপড়া– ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা এখন বিশ্বসেরাদের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সব স্পোর্টস ফেডারেশনের মানসিকতায় পেশাদারিত্ব নেই। এই অভাবটুকুই ভারতীয় অলিম্পিকের ক্রীড়াগুলিকে আরও বড় প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে।
এখানেই বিসিসিআইয়ের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। যারা দেশের ধনীতম ক্রীড়া সংস্থা, আবার জনমানসে সবচেয়ে অস্বচ্ছ বলে পরিচিতও।
জয় শাহর নেতৃত্বাধীন বিসিসিআই নিয়ে গর্ব করার অনেক পরিসর আছে বটে, বিশেষত যেভাবে মহিলা ক্রিকেটের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে বিগত ক’-বছরে, তা অবশ্যই উল্লেখ্য। মহিলা ক্রিকেটারদের সমান সাম্মানিক দেওয়া ও মহিলাদের জন্য একটা প্রিমিয়ার লিগের সূত্রপাত ঘটানোর প্রশংসা তো করতেই হবে। খেলাধুলোকে প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন করে তুলতে লিঙ্গবৈষম্যের দেওয়ালগুলো ভাঙতেই হত।
কিন্তু প্রভূত প্রশস্তিসূচক কর্মযজ্ঞ নেওয়ার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায় বিসিসিআই-কে নিয়ে। রাজনৈতিক নানা সেতুবন্ধনে পোক্ত, বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্রে অস্বস্তিকর রকমের প্রভাবশালী ও দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় কঁাধ-ঝঁাকানো কিছু কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এই বোর্ড। সততই যতটা অসীম শক্তিধর হয়ে উঠেছে ভারতীয় ক্রিকেট, তাতে তার কঁাধে দায়িত্বের ভারও প্রবল হয়ে ওঠে। মাথায় রাখার, বিসিসিআই কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের তত্ত্বাবধায়ক, মালিক নয় মোটেই। ক্রিকেট বোর্ড তো আইপিএলের মতো কোনও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নয়, যেখানে নিলামে কেনা ক্রিকেটারদের ঝলমলে প্রদর্শনী হবে। বিসিসিআইয়ের বরং দায়িত্ব, খেলার ঐতিহ্যকে আরও শক্তিশালী করে তোলা। তার জন্য প্রথমেই খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের অবস্থানের পৃথকীকরণ প্রয়োজন। এই সূক্ষ্ম ভেদরেখাটা সম্পূর্ণ মুছে যায়, যখন ‘ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন’ লেখা টি-শার্ট পরে বোর্ডের হর্তাকর্তারা খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছাদখোলা বাসে উঠে পড়েন, জনস্রোতের দিকে এমনভাবে হাত নাড়ান, যেন তঁারাও এই জয়ের অংশীদার। এমনকী, ট্রফি হাতে তুলে ছবি তোলাতেও দ্বিধা করেন না। এই বিরক্তিকর পরিস্থিতিটা এড়িয়ে যাওয়া যেত না কি?
আর কয়েক মাসে জয় শাহ হয়ে উঠবেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স’ বা আইসিসি-র পরবর্তী সভাপতি। ৩৫ বছর বয়সি জয় শাহের ক্রিকেট-বিশ্বের সর্বময় কর্তা হিসাবে উল্কাসম উত্তরণের আরও একটি বড় ধাপ এটি। তঁার নিন্দুকরা তঁাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর পুত্র হিসাবেই দেখবে, স্বজনপোষণের অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি। তঁার শিরোপায় পালকও নেহাত কম নেই। কিন্তু তঁার এবং অন্যান্য বোর্ড-কর্তাদের বোঝা প্রয়োজন, ট্রফি জেতার জন্য উদ্দীপনা-উত্তেজনা ভাল, তবে তারও ঊর্ধ্বে প্রয়োজন ক্রিকেট-সংস্কৃতিকে বঁাচিয়ে রাখা, যেখানে প্রতিপন্ন হবে এই সত্য– কর্মকর্তারা ক্রিকেটের অভিভাবক, কোনও সিংহাসনে আসীন সম্রাট নন।
পুনশ্চ এবারের উইম্বলডন আবারও দেখিয়ে দিল, কেন একটি ক্রীড়া-পার্বণ হিসাবে তা অভিনব। রয়্যাল বক্সে যে বিশেষ অতিথিরা বসে, তঁারা প্রত্যেকে ক্রীড়াজগতের নানা ক্ষেত্রের তারকা। তঁাদের মধ্যে আমাদের প্রিয়, ভারতরত্ন শচীন তেন্ডুলকরও আছেন। কর্মকর্তা বা হোমরাচোমরা কর্পোরেটরা মঞ্চে অনুপস্থিত। ভারতীয় ক্রিকেট ম্যাচে কিন্তু এর উলটো ছবিটাই দেখা যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.