গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি কংগ্রেস যখন জনপ্রিয়তার শিখরে, সেই সময় কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা এবং ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’– আর হালে, সেই লক্ষণই প্রকট হয়ে উঠেছে বিজেপির ক্ষেত্রে, এবং তা প্রযুক্ত হচ্ছে নির্বাচনী কর্মসূচিতেও। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
৫৪৩টি আসন, ১০ লক্ষেরও বেশি বুথ, ২৮টি রাজ্য এবং ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিস্তৃত ৯৬ কোটিরও বেশি ভোটার– বিশ্বের এহেন বৃহত্তম গণতন্ত্রের একটি নির্বাচনের লড়াই সাধিত হচ্ছে কেবল একটিমাত্র নামে: নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। ক্ষমতাসীন বিজেপির পরিচালনায় ও প্ররোচনায় ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন হয়ে উঠেছে সংসদীয় গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে চূড়ান্ত প্রেসিডেন্ট-সুলভ লড়াই। কেরলের কথা বাদ দিন, কারণ এখানের খেলা দেশের নির্বাচনী তরজার চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। অন্ধ্রপ্রদেশেও আঞ্চলিক নেতাদের মধে্যই সেই সাবেক স্টাইলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। আর বাকি প্রতিটি রাজ্যে, শুধুমাত্র একজন প্রার্থীই মূলত, যিনি এই নির্বাচনকে তঁার নেতৃত্বের উপর গণভোট হিসাবে প্রতিপন্ন করে ফেলেছেন।
এমনকী, বিজেপির ইস্তেহারেও প্রায় সম্পূর্ণরূপে একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় প্রতিশ্রুতির ছর্রা।
‘মোদি কি গ্যারান্টি’– এই সেই ক্যাচলাইন, যা প্রধানমন্ত্রীর ছবি-সহ ইস্তেহারের প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিশ্রুতির বন্যার সঙ্গে। বিপুল এক ব্যক্তিত্বের কাল্ট আবহে বিজেপি দলটি ‘এক জাতি, এক নেতা’ দামামায় পর্যবসিত হয়েছে যে, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি কংগ্রেস যখন জনপ্রিয়তার শিখরে, সেই সময় কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া বুক বাজিয়ে বলেছিলেন ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা এবং ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া।’ আর হালে, সেই লক্ষণই প্রকট হয়ে উঠেছে বিজেপির ক্ষেত্রে, এবং তা প্রযুক্ত হচ্ছে নির্বাচনী কর্মসূচিতেও। ২০১৪-র নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, তা সম্ভব হয়েছিল জনমানসের আশ্বাসে, ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি নিয়ে। ২০১৯-এর নির্বাচনে নেতৃত্বের তরজা আকার নিল সীমান্ত সমস্যায়। পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলা এবং বালাকোট প্রতিক্রিয়াকে ঘিরে একটি বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী আবেদনের প্রেক্ষাপটে।
এবারের ভোটেও– চাকরি, মুদ্রাস্ফীতি বা আয়-বৈষম্যকে কেন্দ্র করে ইস্যুভিত্তিক নির্বাচন করার কোনও লক্ষণ নেই। আর, গত দশ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে তর্ক তোলার কথা তো কল্পনাতীত। এমনকী, হিন্দুত্ববাদও মূল বিজেপি ভোটারদের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘বিকশিত ভারত’ আখ্যানটি মোটামুটি জনমানসে একদম একরোখা বিশ্বাস হয়ে গেড়ে বসেছে, এবং সঙ্গে এই আস্থাও যে, কেবলমাত্র একজন নেতাই পারবেন ভারতকে ‘সুন্দর ভবিষ্যৎ’ দেখাতে। এমনকী, ২০৩৬ সালে দেশে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের প্রতিশ্রুতিও প্রধানমন্ত্রী মোদির কার্যকালে স্থায়িত্বের আভা তৈরি করে ফেলেছে। ২০২২ সালের মধ্যে ‘নতুন ভারত’-এর স্বপ্নে দেশবাসীকে ঘোরানো হয়ে গিয়েছে, এখন কার্যক্রম উন্নীত হয়েছে ২০৪৭-এ, সুচারুভাবে। ধরেই নেওয়া হয়েছে, নরেন্দ্র মোদিই থাকবেন, এবং তঁার কথামতো এই সময়কাল হতে চলেছে স্বাধীন ভারতের ‘অমৃতকাল’।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বকে ঘিরে ২০২০ সালে আম আদমি পার্টি দিল্লিতে যে প্রচারাভিযান চালিয়েছিল, সেখানেই প্রথম ‘গ্যারান্টি’ শব্দটির আবির্ভাব ঘটে নির্বাচনী প্রচারে। পরে হিমাচল এবং কর্নাটকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে কংগ্রেসও এই তরজমা ব্যবহার করে। আর এখন, এই তরজমাই প্রধানমন্ত্রীর ইউএসপি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভোটাররা সাধারণত তাদের স্থানীয় নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে বলেও, বৃহত্তর দেশজোড়া নেতৃত্বের বেলায় মোদির মতো ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তিই বেছে নেয়, তা সেখানে ‘গ্যারান্টি’ যতই প্রকৃত ফলের তুলনায় আশাবাদে মাখা মেওয়া হোক না কেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই, প্রধানমন্ত্রী নিজেও যখন কোনও বড়সড় গ্যারান্টির দাবি করেন, নিজেকে সম্বোধন করে ফেলেন ‘মোদিই পারবে’, ‘মোদিই করবে’, ‘মোদির গ্যারান্টি’ বলে– ব্যাপারটা যেন এমন, তিনি নিজেও তঁার অধীনস্থ।
কর্নাটক এক্ষেত্রে মোক্ষম দৃষ্টান্ত, যেখানে তাকালে বোঝা যাবে, কী পরিমাণে অহংচালিত রাজনীতি কায়েম হয়েছে। বিত্তশালী, দলত্যাগী এবং অভিজাত– কর্নাটকের ‘নব্য’ বিজেপির নেতার সারি দেখলে প্রতিফলিত হয়, আদর্শ দেহ রেখেছে, এখন এই মোদি-কেন্দ্রিক নির্বাচনী যন্ত্রের কাছে যেভাবেই হোক, জয় হস্তগত করাটাই শেষ কথা। বর্তমান অর্ধেক সংখ্যক সাংসদকে প্রায় বাদ দেওয়া হয়েছে– যঁাদের মধ্যে অনেকেই বেশ বরিষ্ঠ
এবং অনুগত ‘কার্যকর্তা’। বিজেপি এখানে এখন এইচ. ডি. দেবগৌড়ার জেডি(এস)-এর সঙ্গে জোটমত্ত। মাত্র একবছর আগের কথা, বিজেপি রাজ্য নির্বাচনে জেডি(এস)-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালিয়েছিল এই অভিযোগে যে, দলটি পিতা-পুত্র প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। কেন্দ্রে, দিল্লিতে ‘পরিবারবাদ-বিরোধী’, ‘দুর্নীতি-বিরোধী’ তরজা, দক্ষিণ কর্নাটকের সবুজ প্রান্তরে এসে একেবারে ফঁাপা হয়ে গিয়েছে। কারণ, এখানে বিজেপি এবং জেডি(এস) মিলেমিশে নির্বাচনী প্রচারে তদবির।
দক্ষিণ বেঙ্গালুরুতে, বিজেপির স্পষ্টবাদী তরুণ সাংসদ, তেজস্বী সূর্য প্রতি রবিবার সকালে ‘Run for NaMo’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ-সম্বলিত টি-শার্ট এবং মুখোশ ভিড়ের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে, মানুষদের উজ্জীবিত করার জন্য। ‘জয় শ্রীরাম’ এবং ‘ভারতমাতা কি জয়’ স্লোগানের মধ্যে, ‘মোদি মোদি’ চিৎকারে ফেটে যাচ্ছে চারদিক। অথচ এই আসন, বিজেপির নিরাপদ সাকিনগুলির মধ্যে একটি। তা হলেই বা! সাংসদ নিজেই স্বীকার করছেন যে, এবারের নির্বাচন ‘ব্র্যান্ড মোদি’-র নামে লড়াই!
এক অর্থে, বিজেপির মোদি নামগান বোধগম্য। প্রধানমন্ত্রীর অনস্বীকার্য জনপ্রিয়তা এবং গণসংযোগ যখন তাদের কাছে তুরুপ হয়েই আছে, তখন কেন গর্বের সঙ্গে তাকে ব্যবহার করা হবে না? ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে কংগ্রেস যদি ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে ইন্দিরার ‘মা দুর্গা’ ভাবমূর্তি বানিয়ে নির্বাচনী কৌশল তৈরি করতে পারে, বিজেপি কেন তাদের শালপ্রাংশু এবং বিশ্বস্ত নেতাকে ঘিরে এই প্রদর্শনীটি করবে না? তবে, নির্বাচনের দিক থেকে যা অর্থবহ হতে পারে, তা বৈচিত্রময় বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর না-ও হতে পারে! সবচেয়ে গূঢ় অর্থটি এই, অন্য সমস্ত নেতা এবং দলকে ভোটারদের পছন্দের কাছে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা চলছে এই কার্যকারণের মধ্য দিয়ে।
হাস্যকরভাবে, সংঘ পরিবার, তথা আরএসএস-ই প্রায়শই ‘ব্যক্তি’-র ঊর্ধ্বে ‘সংগঠন’-এ গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে। মনে করুন, কীভাবে আরএসএস, বিজেপির ১৯৯৯ এবং ২০০৪-এর প্রচারাভিযানগুলিতে ভ্রুকুটি নিক্ষেপ করেছিল, যেখানে অটলবিহারী বাজপেয়ীর ‘সেই নেতা, যঁার অপেক্ষায় ভারত’ স্লোগানে কাট-আউটগুলি ছেয়ে গিয়েছিল শহরে-নগরে। এখন, আরএসএস নীরবে ‘আয়েগা তো মোদি হি’ প্রোপাগান্ডার রগড় মেনে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। হয়তো এই ভেবে, যে, নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় ধারাবাহিক জয় বিশ্বস্ততার সঙ্গে গেরুয়া ভ্রাতৃত্বের মূল আদর্শিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত করবে! বাজপেয়ীর মতো জোট-যুগের প্রধানমন্ত্রীকে ন্যূনতম কর্মসূচির সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছিল। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপ, রামমন্দির নির্মাণ এবং এখন ‘অভিন্ন নাগরিক আইন’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
সাংসদ প্রার্থীরা এখন হয়ে উঠেছেন মুখবিহীন, অস্তিত্বহীন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কার্যনির্বাহী ফরমান জারির বিশ্বস্ত বাস্তবায়নকারী কর্মী, আমলারা হয়ে উঠেছেন কর্তব্যপরায়ণ ‘জো হুজুর’ সেবক। বিরোধীদের তো আগাগোড়া খুইয়েছে। এবং মিডিয়া হয়ে উঠেছে তোষামোদের মঞ্চ। শেষত, নির্বাচন হয়ে দঁাড়িয়েছে মোদি এবং এককভাবে মোদিরই ক্ষমতায় ফিরে আসার মহান আয়োজন! মোদ্দা কথা, এ এক সুচারু কৌশল, যা বিভক্ত এবং হতাশ বিরোধীদের সঙ্গে দুয়ে দুয়ে চার করলে, বিজেপির কেল্লা ফতে। যার ফলে, দীর্ঘমেয়াদে অনিবার্য প্রশ্নটি উঠবেই: ‘মোদির পর কে-ই বা আর?’
পুনশ্চ কর্নাটকের প্রত্যন্ত প্রান্তে একটা বাসে যেতে যেতে, আমি একদল মহিলাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “আপনারা ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ আর কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ ইস্তেহার শুনেছেন?” চোখের পলকে প্রায় সকলেই প্রথম তরজমাটির সঙ্গে পরিচিত বলে সহমত হলেন, কিন্তু কেউই ‘ন্যায়’ সম্পর্কে পরিচিত নন। অথচ, ভাগে্যর কী পরিহাস, বাসে নিঃশুল্ক যাত্রা উপভোগ করছিলেন তঁারা, যা কিনা এই রাজে্য সিদ্দারামাইয়া শাসিত কংগ্রেস সরকারের শাসনকালে কংগ্রেসের পঁাচটি প্রতিশ্রুতির অন্যতম!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.