সুতীর্থ চক্রবর্তী: পরপর দু’টি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট দেশজুড়ে উৎসবের মরশুম শুরু হওয়ার আগে ভারতকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার তথা আইএমএফ-এর ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান আর্থিক বছরে ভারতের মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন তথা জিডিপি বাংলাদেশের (Bangladesh) পিছনে চলে যাবে। আইএমএফ-এর এই রিপোর্টের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এল ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ তথা ক্ষুধার সূচক। তাতেও বাংলাদেশের অনেক পিছনে ভারত। এই সূচকে শুধু বাংলাদেশ কেন, প্রতিবেশী পাকিস্তান, নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা– প্রত্যেকে ভারতের আগে।
দু’টি রিপোর্টই আমাদের হতবাক করেছে। তাহলে সত্যিই কি আমাদের অর্থনীতির হাল এত খারাপ? ২০১৭ থেকে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে। তার আগে বলা হত, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার পৃথিবীর মদ্যে সবচেয়ে বেশি। চিনেরও আগে আমরা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘জি ৭’-এর মতো দুনিয়ার সবচেয়ে শিল্পোন্নত ও বড়লোক সাত দেশের জোটের বৈঠকে আমন্ত্রিত হন। অথচ আমরা কিনা মাথাপিছু জিডিপি-তে বাংলাদেশের পিছনে চলে যাচ্ছি, ক্ষুধার সূচকে আমরা বাংলাদেশ, নেপালেরও তলায়!
অস্বস্তি কাটাতে কেন্দ্র সরকারের তরফে জিডিপি হিসাবের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের তুলনায় দশগুণ বড়। ভারতের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় আটগুণ। দু’দেশের নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা সমান করে যদি দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে, ভারত অনেক এগিয়ে বাংলাদেশের তুলনায়। কেন্দ্র যে যুক্তিগুলি হাজির করেছে, সেগুলি সবই সঠিক। আইএমএফ-এর ওই একই রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী বছর ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ৮.৮ শতাংশ। যা আবার চিনের চেয়ে বেশি। তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারত ফের মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশকে টপকে যাবে।
আইএমএফ-এর রিপোর্টে ভারতের (India) অস্বস্তি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকলেও, ক্ষুধার সূচক নিয়ে সাফাই দেওয়ার কিছু নেই। জন্মানোর পর থেকে ভারতের ১৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। সূচকে এটাই ভারতকে তলানিতে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে জিডিপি কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে, লকডাউনের তিনমাসে অর্থনীতির প্রায় ২৪ শতাংশ সংকোচন ঘটেছে– ইত্যাদি নানাদিক থেকে যখন কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতি পরিচালনার প্রশ্নে সমালোচনার মুখে পড়ছে, তখন ক্ষুধার সূচক অস্বস্তি আরও বাড়াল। দারিদ্র না কমলে যে এভাবেই বারেবারে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতকে বেআব্রু হতে হবে, সংশয় নেই।
মাথাপিছু জিডিপি-তে বাংলাদেশ কীভাবে ভারতকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে, তার নানারকম ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রগতির মূলে যে সেদেশের বস্ত্রশিল্প, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক চলবে না। বস্ত্র রফতানিতে এক অভূতপূর্ব উন্নতি করতে পেরেছে তারা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মহিলা শ্রমিকের দক্ষতা একটি বাড়তি সুযোগ এনে দিয়েছে। চিন যেমন অন্যান্য পণে্যর ক্ষেত্রে বিশ্বের বাজার ধরেছে, বাংলাদেশও তেমন সস্তার জামাকাপড়ে পৃথিবীর বাজার ধরে ফেলেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অান্তর্জাতিক বাজারে আমাদের এমন কোনও পণ্য নেই। আর্থিক সংস্কারের এত বছর পরেও আমরা বিশ্ববাজারে কোনও পণ্যের ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে পারিনি। কোনও ‘ভারতীয় ব্র্যান্ড’ আজ পর্যন্ত দুনিয়ার নজর কাড়তে পারেনি।
বাংলাদেশের অগ্রগতি দেশের পক্ষে যেমন অস্বস্তির, তেমন স্বস্তিরও। যদি সত্যিই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা একজন গড় ভারতীয়র চেয়ে ভাল হয়, তাহলে অনুপ্রবেশের সমস্যা অনেকটাই কমে। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের মূলে যে অর্থনৈতিক কারণ, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ভারতে আসা বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর সিংহভাগ আসেন আর্থিক কারণে। এই মানুষগুলোর বাংলাদেশে কাজ নেই, খাদ্য নেই। এঁরাই ভারতে এসে আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ তৈরি করেন। এই চাপের বড়টাই আমাদের রাজ্যের উপর। সুতরাং প্রতিবেশী বাংলাদেশ যদি ধনী ও সমৃদ্ধ হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় লাভ আমাদের। আর্থিক কারণে অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে। আমাদের উপর আর্থিক চাপ কমবে। বাংলাদেশের বেহাল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সেদেশে জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধির নেপথ্যেও দারিদ্রের ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে দারিদ্র কমলে, জঙ্গি কার্যকলাপ কমলে, আইনশৃঙ্খলা ভাল হলে, প্রতিবেশী হিসেবে উপকৃত হব আমরাই। তাই সূচকে পিছিয়ে পড়ার জন্য অস্বস্তিতে না থেকে বাংলাদেশের এই আর্থিক অগ্রগতিকে সবার আগে স্বাগত জানানো উচিত আমাদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.