সত্যজিৎ রায়ের 'শাখাপ্রশাখা' ছবির একটি দৃশ্য
ভারতে মধ্যবিত্ত এখন ৩১ শতাংশ। স্বাধীনতার শতক-পূর্তিতে তা আরও বাড়বে। কিন্তু মধ্যবিত্তর বৈশিষ্ট্যগুলি সব এক আছে, এবং থাকবে?
উটের পাকস্থলীতে জল থাকে না। কুঁজে সঞ্চিত মেদকে অক্সিডাইজ করে উট জলের চাহিদা মিটিয়ে নেয়। ফেলুদার এই বিজ্ঞাননিষ্ঠ বিশ্লেষণ ‘জটায়ু’-কে শুধু অবাক করেনি, মধ্যবিত্ত বাঙালির সযত্নলালিত একখানি ভ্রমকে কাচের বাসনের মতো ভেঙে টুকরো-টুকরো করেও দিয়েছিল। উটকে মধ্যবিত্ত বাঙালি ‘মরুভূমির জাহাজ’ বলে অভিহিত করে এসেছে। মুখে-মুখে এই ধারণা অতিরঞ্জিত প্রসার পেয়েছে যে, উট পাকস্থলীতে জল ধরে রাখে। অথচ এর সঙ্গে শারীরবিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক নেই। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা অমন নির্বোধ বিশ্বাসের ভীমরুল চাকে ঢিল মেরে তাই দুধ আর জলকে আলাদা করতে চেয়েছিল।
ফেলুদা, বাঙালি বটে, তবে উচ্চমেধার, উচ্চকোটির। আর, জটায়ুর ঠাঁই বিপরীতে কিনারে। তিনি মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যমেধা ও মধ্যচিত্তের প্রতিনিধি। সুযোগ পেলেই তাই সত্যজিৎ রায় মধ্যবিত্ত (Middle Class) বাঙালির সার্বিক অমনোযোগ, গ্যাদগ্যাদে আবেগ এবং অনুসন্ধান-বিমুখ মানসিকতাকে কশাঘাত করেছেন– ফেলুদার মাধ্যমে। মনের জানলা খুলে রাখলে যে অনেক সূক্ষ্ম জিনিস চোখে পড়ে, সেই শিক্ষাও দিতে চেয়েছেন। সত্যজিতের জটায়ু চেহারায় আনইম্প্রেসিভ, এদিকে আপন গোয়েন্দা-নায়ক প্রখর রুদ্রকে গড়েছেন নায়কোচিত ঔজ্জ্বল্যে। তঁার লেখা হট কেকের মতো বিক্রি হয়। এডিশনের-পর-এডিশন ফুরিয়ে যায়। অথচ কত ধরনের তথ্যগত প্রমাদ যে থাকে, বলার নয়। বিপদে পড়লে জটায়ু নার্ভ ফেল করেন, উটের পিঠে চেপে হকচকিয়ে যান, বিদেশে গিয়ে ‘মোমোর রেসিপি কী’ এটা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করতে চোখের জলে, নাকের জলে হন। সব মিলিয়ে, জটায়ুর মধ্যে চরম সীমাবদ্ধতা আছে। বিশেষত, ফেলুদার (Feluda) শার্প উপস্থিতির পাশে জটায়ুকে মাঝে মাঝেই লঘু ও ফিকে লাগে।
‘আ হেলদি মিডল ক্লাস ইজ নেসেসারি টু হ্যাভ আ হেলদি পলিটিক্যাল ডেমোক্রেসি। আ সোসাইটি মেড আপ অফ রিচ অ্যান্ড পুওর হ্যাজ নো মিডিয়েটিং গ্রুপ আইদার পলিটিক্যালি অর ইকোনমিক্যালি।’ সমাজে ‘স্বাস্থ্যবান’ মধ্যবিত্তর দরকার, তা না হলে রাজনৈতিকভাবে গণতন্ত্র পরিপুষ্ট হয় না। উচ্চ ও নিম্ন– দু’টি সামাজিক স্তরের সংযোগ সেতু হয়ে কাজ করে মধ্যবিত্ত এবং উভয়ের রাজনীতি ও অর্থনীতিক ভাবনার সম্মিলন ঘটায়।
লেস্টার থরু-র এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে, এই মুহূর্তে, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিসংখ্যানগত অবস্থানটি জানতে ইচ্ছা করে। ১৯৯৫ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রতি বছরে শতকরা ৬.৩ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে এখন ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ৩১ শতাংশের বেশি। ২০৩১ সালে তা বেড়ে হবে ৩৮ শতাংশ। এবং ২০৪৭, মানে স্বাধীনতার শতবর্ষ-পূর্তিতে, তা হবে মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। কিন্তু ‘মধ্যবিত্ত’ বলতে যে মূল্যবোধ ও মাথাচাড়া দেওয়া শক্তিকে বোঝায়, তার অন্তর-রসায়ন কতখানি বদলেছে নয়ের দশক থেকে? জটায়ুকে এখনও আমরা অব্যর্থ মধ্যবিত্ত-মুখ বলব তো?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.