‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর রিপোর্ট বলছে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪৭.৭ ঘণ্টা কাজ করে ভারতীয়রা, কিন্তু মাথাপিছু জিডিপিতে পিছিয়ে। দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজের অভ্যাস ও আবহ তৈরি করা হচ্ছে। ফলদায়ী হবে? মে দিবস উপলক্ষে বিশেষ লেখা। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
বেকারত্বের অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে দেশে। যাদের চাকরি আছে, সেটাও হারানোর শঙ্কায় অনেকে দিন কাটাচ্ছে। যার সুযোগ নিচ্ছে মালিকপক্ষ। বিশেষত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরির নিরাপত্তার অভাবে শ্রমিকদের দিয়ে ১২-১৪ ঘণ্টা খাটিয়ে নেওয়া বিরল কিছু নয়। এদিকে, নিয়মবিধি মেনে চলে বলে দাবি করা সংগঠিত ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে মোটামুটি দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেই পরিস্থিতিও ক্রমশ বদলে যেতে চলেছে কি? বাধার মুখে পড়লেও কেন্দ্রের পাশাপাশি কিছু রাজ্য সেই পথে হঁাটতে চাইছে। ‘ইনফোসিস’-এর প্রতিষ্ঠাতা এন. আর. নারায়ণমূর্তি ইতিমধ্যে বলেছেন– তরুণ প্রজন্মকে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করতে। উৎপাদনশীলতার নিরিখে অন্য দেশের তুলনায় ভারত পিছিয়ে থাকায়– প্রতিযোগিতার বাজারে উন্নত দেশের সঙ্গে লড়তে অসুবিধা হচ্ছে।
তবে এন আর নারায়ণমূর্তি (N. R. Narayana Murthy) যা-ই বলুন, ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর (আইএলও) রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলছে। বিশ্বের দশটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে, গড়ে ভারতের সাপ্তাহিক কাজের সময় সবচেয়ে দীর্ঘ। ‘আইএলও’ (ILO) রিপোর্ট অনুসারে, সমৃদ্ধি এবং সাপ্তাহিক কাজের সময়ের সম্পর্কটা বিপরীতমুখী। অর্থাৎ যেসব দেশে কাজের সময় কম, তাদের মাথাপিছু জিডিপি বেশি। শীর্ষ ১০টি অর্থনীতির মধ্যে ভারতে সাপ্তাহিক কাজের সময় সবচেয়ে বেশি, এবং মাথাপিছু জিডিপি (GDP) সবচেয়ে কম।
এদের মধ্যে ফ্রান্স সবচেয়ে কম সাপ্তাহিক কাজ করে ৩০.১ ঘণ্টা, অথচ মাথাপিছু জিডিপির নিরিখে অন্যতম সর্বোচ্চ– ৫৫,৪৯৩ ডলার। প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪৭.৭ ঘণ্টা কাজ করে ভারতীয়রা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কাজ করা দেশের তালিকায় সপ্তম। ২০১৮ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন রিপোর্ট’ অনুসারে– কাতার, কঙ্গো, লেসোথো, ভুটান, গাম্বিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ‘গড়’ কাজের ঘণ্টা ভারতের চেয়ে বেশি।
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি মার্কিন মুলুকেও সে-দেশের কর্মীদের বদলে এ-দেশের কর্মীদের নিতে চায় কেন? নিশ্চয়ই দয়াপরবশে নয়, বরং উৎপাদনশীলতার অঙ্কটা কষেই এমন সিদ্ধান্ত– যেহেতু ভারতীদের কম পয়সায় খাটানো যায়। ভারতের কর্পোরেট জগতের প্রচলিত অভ্যাস, নানা অছিলায় কর্মীদের আরও একটু অফিসে থাকতে বলে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া। যার জন্য অন্তত বস যতক্ষণ অফিসে আছে, ততক্ষণ কোনওভাবেই অধস্তনের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াটা সমীচীন নয়। তাছাড়া, সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনেও অফিসের ফোন আসা ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরা হয়। কিন্তু, ইউরোপের কর্মসংস্কৃতিতে, বেশ কিছু দেশে, কাজের সময়ের পরে, বা সপ্তাহান্তে কাজের কারণে, কর্মচারীকে ফোন করা বা কাজে ডাকা অত সহজ নয়।
চাকরি থাকাকালীন নিজেকে ‘দক্ষ’ মনে করা লোকেরা ইউনিয়নকে নিচু চোখে দেখে এসেছে। অথচ, ম্যানেজমেন্টের অত্যাচার থেকে ইউনিয়ন-ই কর্মীদের বঁাচায়। যৌথ দরাদরির মাধ্যমে ইউনিয়ন কর্মীদের দাবি আদায়ে সক্ষম হয়। তবুও ইউনিয়নের একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে অনেকের কাছে। কারণ, ইউনিয়নের দাবিদাওয়ার বিষয় যতটা নেতিবাচক প্রচারে আসে, ম্যানেজমেন্টের চাপের কথা সেভাবে আসে না। উল্টে, ওই কাজের চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসাবে প্রচার করা হয়। এমন প্রচারের কারণ সম্ভবত প্রকাশ্যেই ইউনিয়নের ম্যানেজমেন্টকে হুমকি দেওয়ার প্রবণতা– যেটা সহজেই জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু কোনও কর্মীর প্রতি ম্যানেজমেন্টের হুমকি অনেকটাই চুপিসারে ঘটে। জানলেও চাকরি হারানোর ভয়ে সে-কথা প্রকাশ করতে সাহস পায় না অন্যান্য সহকর্মীরা। ফলে, তা প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা কম থাকে। কখনও কখনও ম্যানেজমেন্টের সেই হুমকি (ইমেল বা ভিডিও) সংস্থার বাইরে বেরিয়ে এলে সমাজমাধ্যমে তোলপাড় হয়। কর্মসংস্কৃতি কলুষিত করার জন্য মূলত আঙুল ওঠে কর্মীদের দিকেই। একটা সময় ইউনিয়নের জঙ্গি আচরণ শিল্প পরিবেশকে নষ্ট করেছিল ঠিকই। তবে ম্যানেজমেন্ট কোনও কালেই ধোয়া তুলসীপাতা নয়।
কয়েক মাস আগে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ আধিকারিককে তার অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে মিটিং করার সময় চরম দুর্ব্যবহারের ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়েছিল। যা দেখে ‘গেল-গেল’ রব উঠলেও এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কর্মীদের বোঝানো হয়– তুমি দক্ষ হলে তোমার চাকরি থাকবে। মন দিয়ে কাজ করো, সংস্থা তোমাকে দেখবে। অথচ কিছু দিন আগেই তো মেটা, টুইটার-সহ বেশ কিছু বড় নামী সংস্থার কর্মী সংকোচন হল। সেই ছঁাটাই পরিস্থিতির জন্য শীর্ষকর্তাদের ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী বলে পরে দেখা গিয়েছিল। যা দেখে দুনিয়াজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে– দক্ষতার দাম কোথায়? পাশাপাশি, সংস্থার প্রতি কর্মীদের দায়বদ্ধতার প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিগত কয়েক বছর ধরে এ-দেশে রাষ্ট্রীয় আইনে শ্রমিকদের সুরক্ষা কমেছে ও শ্রমিক সংগঠন দুর্বল হয়েছে। প্রচার করা হচ্ছে ছঁাটাইয়ের সুযোগ রাখা, চাকরির শর্ত অলিখিত রাখা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব করার মাধ্যমে আরও বেশি নিয়োগ সৃষ্টি করা সম্ভব, দক্ষ শ্রমিককে আরও বেশি মজুরি দেওয়া সম্ভব।
কথাটা কতটা সত্যি? কার্যত নিয়োগ বৃদ্ধি হচ্ছে কতটা? সার্বিকভাবে প্রকৃত মজুরি কতটা বাড়ছে? সর্বনিম্ন মজুরি সারা দেশে কতটা মানা হচ্ছে? চাকরির অভাবে তো অনেকেই ন্যূনতম মজুরির দাবি না-করে কম বেতনে কাজে যোগ দিচ্ছেন। এ-দেশ বলে নয়, বিশ্বজুড়ে দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজের কথা বলা হচ্ছে। যদিও দিনের শুরুতে কর্মীর ‘কর্মক্ষমতা’ যতটা থাকে, বেলা গড়ালে, ক্লান্তির দরুন ততটা থাকে না। ফলে আটের বেশি ঘণ্টা কাজ করালে ক্লান্তিজনিত কারণে উৎপাদনশীলতা কমতেই পারে। আট ঘণ্টার কাজের দাবি যখন উঠেছিল, বাকি সময়, বাড়ির অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ঘুমনো বা বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে, বিশ্রাম না-নিয়ে অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করলে শরীর ভেঙে গেলে, ওসব শ্রমিক বা কর্মীর পক্ষে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা সম্ভব হবে তো? দৈনিক আটের বদলে ১২ ঘণ্টা কাজের দিকে শ্রমিকদের ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে– কারণ, কর্পোরেট জগৎ এটা চাইছে। দেশের শ্রমের বাজারটা এমনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে– যাতে শ্রমিকদের কর্পোরেট ক্রীতদাসে পরিণত করা যায়।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.