সুতীর্থ চক্রবর্তী: লকডাউনের (Lockdown) পর বর্তমান অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আর্থিক সংকোচন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সরকারিভাবে আগামী শুক্রবারই জানা যাবে। এখনও পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে যা খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে আর্থিক সংকোচন ৯.৫ শতাংশ হতে পারে। প্রথম ত্রৈমাসিকে তথা এপ্রিল থেকে জুনে অর্থনীতির সংকোচন ঘটেছিল ২৩.৯ শতাংশ। এপ্রিল, মে, জুন মাস ধরে লকডাউন চলেছিল। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। অক্টোবরে উৎসবের মরশুম শুরু হওয়ার পর অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে যে আর্থিক সংকোচন ঘটবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। পরপর দু’টি ত্রৈমাসিকে আর্থিক সংকোচন ঘটলে মন্দা বলা হয়। সেই মন্দার মুখে সরকারিভাবেই আমরা দাঁড়িয়ে।
অক্টোবরে উৎসব মরশুম শুরু হওয়ার পর অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলা হলেও, অর্থনীতিবিদরা এখনই খুব একটা আশার আলো দেখছেন না। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ২০২০ থেকে ’২৫ পর্যন্ত ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গড় হার দাঁড়াবে ৪.৫ শতাংশ। এই অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, বর্তমান অর্থবর্ষ তথা ২০২০-’২১ সালে ভারতীয় অর্থনীতির (Indian Economy) সংকোচন হবে প্রায় ১০ শতাংশ। মন্দা কাটাতে আর্থিক বৃদ্ধির হার অন্ততপক্ষে ৭-৮ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। যদি আগামী ৫ বছরে আর্থিক বৃদ্ধির গড় হার গিয়ে ৪.৫ শতাংশে দাঁড়ায়, তাহলে এই বিশাল আর্থিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার কোনও লক্ষণই দেখা যাবে না। এটা বিশেষভাবে উদ্বেগের।
কোভিড অতিমারী এবং লকডাউনের জেরে আমরা অর্থনীতির এক ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করছি। বেকারত্ব এক চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দেশে নতুন লগ্নি নেই। লকডাউন পর্বে অসংখ্য কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেশের কর্মীবাহিনীর ৪৫ শতাংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, কৃষিতে আয় যৎসামান্য। শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে আয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হলেও কর্মসংস্থান ক্রমশ কমছে। লকডাউনের আগে থেকেই অর্থনীতিতে একটা ঝিমুনি ভাব ছিল। লকডাউন যে তাকে অনেক তীব্র করেছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। লকডাউনে যে অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে, যে অসংখ্য মানুষের আয় কমে গিয়েছে, তার প্রভাব সরাসরি এসে বাজারে পড়েছে। লকডাউনের আগে বাজারে যে চাহিদার অভাব ছিল, লকডাউন পরবর্তী পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই তীব্র হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে দফায় দফায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তিন দফায় আত্মনির্ভর অভিযান প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। শেষ দফার প্যাকেজ ঘোষণার সময় তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্র দফায় দফায় মোট ৩০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ দিচ্ছে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। এই ৩০ লক্ষ কোটি টাকা হল ভারতের জাতীয় আয়ের ১২ শতাংশ। কিন্তু, অর্থনীতিবিদদের বড় অংশই কেন্দ্রের এই প্যাকেজের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। প্রথমত, তাঁদের বক্তব্য প্যাকেজে যে পরিমাণ আর্থিক ঘোষণা রয়েছে, তার সিংহভাগ ব্যাংকয়ের নগদ জোগানের সমস্যা মেটাতে ব্যয় হয়েছে। সরাসরি মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনও অর্থ নেই। অক্সফোর্ডের একদল অর্থনীতিবিদ অতিসম্প্রতি ভারতের অর্থনীতি নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, তাতেও তাঁরা মন্তব্য করেছেন, লকডাউন পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের প্যাকেজ অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। এমন কিছু প্যাকেজের প্রয়োজন ছিল, যা সরাসরি মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেবে। মানুষ হাতে টাকা পেলে তবেই বাজারে গিয়ে চাহিদা তৈরি করতে পারত। যার সুফল অর্থনীতিতে এসে লাগত।
প্যাকেজের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার এই কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে বেশ কিছু আর্থিক সংস্কারের পদক্ষেপও করেছে। সেই পদক্ষেপগুলি আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কতখানি সহায়ক, সেই বিতর্কও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে জারি রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই সময়কালে যে আর্থিক সংস্কার করেছে, তার উল্লেখযোগ্য হল, কৃষিক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের সংশোধন এবং শ্রম আইনের ক্ষেত্রে কিছু সংশোধন। এই দুই সংস্কার অর্থনীতিতে কতটা গতিদান করবে, তা এখনও দেখার সময় আসেনি। তবে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ঊর্ধ্বেও যেটির কথা বলা জরুরি, তা হল, এই লকডাউনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর আত্মনির্ভর অভিযানের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এই কর্মসূচির মূলে রয়েছে আমদানির ‘বিকল্প নীতি’ তথা ‘ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন’। যদিও অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ এই ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশনের নীতিতে ভর করে আর্থিক বৃদ্ধির উচ্চহারে ভরসা পাচ্ছে না।
সাম্প্রতিককালে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির সবচেয়ে উজ্জ্বল ছবি ইউপিএ জমানায়। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দশ বছরে গড়ে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে ৭.৭ শতাংশ হারে। তার আগে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় এটা ছিল ৫.৯ শতাংশ। তারও আগে নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে গড় আর্থিক বৃদ্ধি ছিল ৫.১ শতাংশ। মোদির প্রথম পাঁচ বছরে আর্থিক বৃদ্ধি ৬.৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের পর এই গড় কোথায় দাঁড়াবে, তা খুবই অস্পষ্ট। কিন্তু, আর্থিক বৃদ্ধিকে ৭-৮ শতাংশে পৌঁছতে হলে ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন কতটা কার্যকর, সেই প্রশ্ন অর্থনীতিবিদদের মহলে ঘুরছে। ২০০২-’১০ ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির স্বর্ণযুগে রপ্তানি বৃদ্ধির হার থেকেছে ১৮ শতাংশ। ফলে রফতানি বাড়িয়ে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটানোর পক্ষে সওয়াল জোরদার হচ্ছে। রপ্তানি বাড়াতে জরুরি হল ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশন নীতি থেকে সরে দাঁড়ানো। আমদানির উপর চড়া হারে শুল্ক চাপানোর নীতি থেকে সরে দাঁড়ানো। মুক্ত বাণিজ্য গড়ে তোলার জন্য সার্বিকভাবে উৎসাহ দান।
কয়েক দিন আগেই ‘রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’ তথা ‘আরসেপ’-এ অংশ নেওয়ার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করার বিষয়টি স্থগিত রেখেছে ভারত। ১৫ দেশের এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য ভারতের উপর বেশ কিছুদিন ধরে চাপ রয়েছে। ব্যাঙ্ককে ‘আরসেপ’-এর তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলনেও মোদি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ভারত এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অংশীদার হবে? ভারতের আশঙ্কা, ‘আরসেপ’-এ অংশ নিলে চিনা পণ্য আরও অবাধে ভারতের বাজার দখল করবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতীয় শিল্প ও পরিষেবা। বিশেষ করে ভারতের ডেয়ারি শিল্প বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। কিন্তু যাঁরা ইমপোর্ট সাবস্টিটিউশনের বিরুদ্ধে সওয়াল করছেন এবং বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ৭-৮ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি নির্ভর আর্থিক বৃদ্ধি জরুরি, তাঁরা কীভাবে ভারতের ‘আরসেপ’-এ অংশ না-নেওয়াকে সমর্থন করতে পারেন? ভারতকে যদি ৭-৮ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধি অর্জন করতে হয় এবং রপ্তানি বাড়াতে হয়, তাহলে মুক্ত বাণিজ্য নীতিকে দু’হাত তুলে সমর্থন করতে হবে। একদিকে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি চাইব, এবং অন্যদিকে মুক্ত বাণিজ্যের সহায়ক ভূমিকা নেব না– এই দুই পরস্পরবিরোধী নীতি একসঙ্গে চলবে কীভাবে? অদ্ভুত এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভারতের নীতি-নির্ধারকরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.