দীপঙ্কর দাশগুপ্ত: ঠিক দু’সপ্তাহ আগে এই কলামে যা লিখেছিলাম, তা ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। উপায় নেই, কারণ তখনও পর্যন্ত করোনার চরিত্র সঠিক বোঝা যায়নি। এখনও যে তাকে চেনা গিয়েছে, এমন নয়। তবে এটুকু উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে যে, তার রূপ যাই হোক না কেন, সেটা শুভংকর নয়। আবার ঠিক ভয়ংকরও পুরোপুরি নয়। মানে, হিরোসিমা বা নাগাসাকিতে যে আণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল তার তুলনায় নোভেল করোনা অনেকটাই শান্ত একটি জীব। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ (হু)-র হিসাব অনুযায়ী ১৮ মার্চ অবধি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ, এবং আক্রান্তদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা সামান্য, ৭ হাজার ৮০৭ জন। জানুয়ারি থেকে এখনও অবধি মৃত্যুর হার ৩.৯ শতাংশ। হিরোসিমার তুলনায় তো শিশু!
তাহলে ভয়ের কারণটা কোথায়? ভয়ের কারণ হল আণবিক বোমা ব্যাপারটা কী, আমরা খুব ভাল করে জানতাম। আর নোভেল করোনাভাইরাস বস্তুটা যে কী, তা এখনও পর্যন্ত বোঝাই যায়নি। চিকিৎসার ওষুধ কী, টিকা আদৌ তৈরি করা যাবে কি না, কেউই জানে না। কেবল বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন যে, টিকা তৈরি করতে অন্তত ১৬ মাস সময় লাগবে। তবে তা আদৌ তৈরি করা যাবে কি না, কারও জানা নেই। ফলে জানা নেই এই ১৬ মাসে কী হতে চলেছে!
অথচ সকলেই বুঝতে পারছে যে, ব্যাপারটা ছড়াচ্ছে। যে রোগের ওষুধ নেই, সেই রোগ যদি দেশের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে, তবে সকলেই আতঙ্কিত বোধ করে। রোগের প্রকোপ যত বাড়বে, তত ভয় বাড়বে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। ছোঁয়াচে রোগের আক্রমণে কলকারখানা, সরকারি-বেসরকারি আপিস সবই বিপদে পড়বে। আক্রান্ত কর্মীরা কাজে না গেলে আপিস চলবে না। আবার আপিসে গেলে সুস্থ কর্মীরা বিপদে পড়বে। এককথায় অর্থনীতি অচল হতে শুরু করবে।
এই পরিস্থিতিতে সকলেই ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। বিশেষ করে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীরা। যদি কলকারখানা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তবে মুনাফা কমবে, ডিভিডেন্ড কমবে। তাই শেয়ার কারবারিরা শেয়ার ধরে রাখতে উৎসাহী হবে না। এবং তারা শেয়ার বেচতে শুরু করলে শেয়ার বাজার নিম্নমুখী হবে। তবে আশার কথা, এটা বিশ্বায়নের যুগ। কোনও একটি দেশে রোগের ভয়ে অর্থনীতিতে অশনি সংকেত দেখা দিয়ে শেয়ার বাজারে ধস নামতেই পারে। কিন্তু কম্পিউটারের ক্লিকের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে এক দেশে শেয়ার বেচে অন্য দেশে শেয়ার কেনা যায়। করোনা যখন প্রথম দেখা দেয়, তখন চিনে এই জাতীয় কিছু ঘটনাই ঘটেছিল বলে অনুমান।
ধরা যাক, চিন থেকে শেয়ার কারবারিরা ইতালিতে ছুটল। প্রথমে ইতালির শেয়ার বাজার কিছুটা চাঙ্গা হবে। কিন্তু বিশ্বায়ন তো কেবলমাত্র শেয়ার বাজারকে ঘিরে না। বিশ্বায়নের ফলে মানুষের আয় বেড়েছে, মধ্যবিত্তদের আয় বেড়েছে। বেড়েছে তাদের নানা চাহিদা। একটা বড় চাহিদা হল পর্যটন। কাজেই বিশ্বে দেশ-বিদেশের লোকজন ছেয়ে গিয়েছে। আর এই ছেয়ে থাকা মানুষের মধ্যে কার কী রোগ আছে কে জানে? কাজেই এমন হতেই পারে যে, চুপি চুপি কোনও অবসরে এই করোনা দু’-একজনের শরীরে লুকিয়ে বসেছিল। কেউ কেউ হয়তো মারা যাচ্ছিল। কিন্তু সেটা তেমন বোঝা যায়নি।
চিনের অর্থনীতিতে যখন সর্বনাশের সম্ভাবনা দেখা দিল, তখন কিন্তু করোনা বেশ গেঁড়ে বসেছে। তাই অনুমান করা যায়, চিন থেকে মানুষও অন্য দেশে পালাতে শুরু করে। আর এদের সংখ্যা যদি প্রচুর হয়ে থাকে এবং এদের অনেকেই যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে ইতালিতেও চিনের পূর্ববর্ণিত সমস্যা সৃষ্টি হবে। তখন ইতালির শেয়ার বাজারে ধস নামবে। এরপর টাকা ছুটবে অন্য দেশে, সঙ্গে মানুষও। এমনটা চলতে থাকলে ক্রমেই পৃথিবীময় শেয়ার বাজারের সমস্যা দেখা দেবে। আর সেই সঙ্গে দেখা দেবে এই অজানা রোগের ভয়।
আর ঠিক সেই জায়গাটাতেই আপাতত আমরা এসে দাঁড়িয়েছে। এ এক বিচিত্র সংক্রামক রোগ যাকে বাগে রাখার উপায় সকলকে বাড়ির ভিতর আটকে রাখা। কর্মীরা কাজে যেতে পারবে না, পড়ুয়ারা পড়তে যেতে পারবে না। অর্থনীতির চাকায় পড়বে বাধা। আর অর্থনীতি চালু রাখতে গেলে লোকজনকে করোনা ঘাড়ে ঘুরতে হবে। মানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ আর কী! কাজেই যতদিন না ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার হচ্ছে ততদিন মানুষকে ঘরবন্দি থাকতে হবে। ফলে অর্থনীতির কী বেহাল অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমেয়। কার্যত একটা বিশ্বব্যাপী মহামন্দা নেমে আসবে, বাজারে চাহিদার অভাবে যে মন্দার সৃষ্টি হয়নি। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মন্দা, যেখানে চাহিদা থাকলেও জোগান থাকবে না।
এই অবস্থাটা সম্পূর্ণ বিশ্বায়নের উলটো ছবি। যদি ওষুধ আবিষ্কার না হয়, তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমরা কীরকম পৃথিবীতে বাস করব? বাজার বলতে প্রায় কিছুই থাকবে না। সিনেমা হল অদৃশ্য হবে। হোটেল নেই। খেলার মাঠ ফাঁকা। ঘরে ঘরে কিছু মানুষ বসে আছে শুধু। আর পৃথিবীটা ঘুরছে সূর্যের চারপাশে, কেন কেউ জানে না। যদি করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করা না যায়, তবে আমরা যেদিকে হাঁটছি সেরকম অবস্থা বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও আসেনি। আমরা মধ্যযুগের প্লেগের গল্প শুনেছি। সেই প্লেগও এমন ভয়াবহ ছিল না, কারণ পৃথিবীতে বিশ্বায়নের কথা কেউ ভাবেনি। তাই প্লেগ ছড়ায়নি বেশি। যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখে আমরা এসে দাঁড়িয়ে, তাতে রক্ষা নেই কারও। আর্তনাদ করছে সমগ্র পৃথিবীই। বেশিদিন না। দুই কি তিনমাসের মধ্যেই আমরা জানতে পারব ঠিক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। এখনও পর্যন্ত আশার কোনও আলোই দেখা যাচ্ছে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.