২৩ জুলাই, পেশ হবে ২০২৪ সালের বাজেট। যতই উত্তর-কোভিড সময়ে দেশের প্রায় শতকরা ৮ ভাগ আর্থিক বৃদ্ধির জয়গাথা তুলে ধরা হোক, তাতে কিন্তু প্রকৃত অর্থনীতির বাস্তবতা ধরা পড়ে না। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
দিল্লির নর্থ ব্লকে বিশাল-বিশাল কড়াইতে হালুয়া রান্না করা হল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজোর দিন এই হালুয়া রন্ধনে হাত লাগালেন অর্থসচিব ও শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে। হাতে বিরাট খুন্তি নিয়ে ছবি তুললেন। এই হালুয়া রান্নার ফোটো সেশন দীর্ঘ দিনের একটি পার্বণ রীতি। ‘হালুয়া রেডি’– মানে এ বছরের বাজেট তৈরি। আগামী ২৩ জুলাই, মঙ্গলবার ২০২৪ সালের বাজেট পেশ করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
শিল্পপতি থেকে সাংবাদিক, মধ্যবিত্ত থেকে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী– প্রত্যেকে অপেক্ষা করছে নিজ-নিজ স্বার্থ, কৌতূহল, জিজ্ঞাসা নিয়ে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক হাল নিয়ে যে উচ্চকিত আহ্লাদ প্রকাশের কোনও অবকাশ নেই সে-কথা তারা প্রত্যেকে একবাকে্য স্বীকার করবে। হতে পারে, বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ভারত পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। এ হল এগ্রিগেট স্তরে। কিন্তু মাথাপিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক মূল্যায়নে ভারত এখন ১৪০তম। গত ১০০ বছরে এত বেশি অসাম্য ভারতে কখনও হয়নি। ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডেটা বেস’ ২০২৪ সালে এ-তথ্য দিয়েছে। ‘বিবিসি’ এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কাজেই দুনিয়ায় নানা দেশে উত্তর-কোভিড সংকটজনক অর্থনীতির মধে্যও ভারতের প্রায় শতকরা ৮ ভাগ আর্থিক বৃদ্ধির জয়গাথা যতই তুলে ধরা হোক, তাতে এ-দেশের প্রকৃত অর্থনীতির বাস্তব ধরা পড়ে না।
এমনকী, আইআইটি-র মতো নামী প্রতিষ্ঠানে পাস করার পরও প্লেসমেন্ট হচ্ছে না। ‘গ্লোবাল আইআইটি অ্যালুমনি সাপোর্ট গ্রুপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ধীরজ সিং বলেছেন, গত দু’-বছরে আইআইটি থেকে পাস করা নতুন ছাত্রদের প্লেসমেন্ট মানে চাকরি না-পাওয়ার সংখ্যা শতকরা ২.৩ ভাগ বেড়ে গিয়েছে। ২০২২ সালে ৩,৪০০ জন ছাত্র পাস করেও চাকরি পায়নি, ২০২৪-এ সে-সংখ্যা এসে দঁাড়িয়েছে ৮০০০-এ। ’২২ সালে ছিল শতকরা ১৯ ভাগ, আর ২০২৪ সালে হয়েছে বেকারত্বের হার শতকরা ৩৮।
‘নীতি আয়োগ’ তাই যখন ‘বিকশিত ভারত’-এর গর্বে বলীয়ান হয়ে নতুন পথচলা শুরুর জন্য শীর্ষ বৈঠক ডাকে, তখন এই আমজনতার মনে প্রশ্ন ওঠে– ভারত যদি এতই উন্নত, এতই বিকশিত, দারিদ্র যখন ভারতে এতই কমতির দিকে– তাহলে এখনও এত মানুষকে নানা ধরনের খাদ্য সংক্রান্ত সহযোগিতা কেন করে যেতে হচ্ছে? কেন এত অদক্ষ শ্রমিক? কেন এত অসংগঠিত শ্রমিক?
মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’-কেও। বড়লোক আরও বড়লোক হয়েছে, ব্যাঙ্কগুলির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, শেয়ার বাজার কখনও কখনও ডুবলেও সাধারণভাবে স্টক মার্কেটে ‘ফিল গুড’ ছিল দশ বছর। কিন্তু আলু-পেঁয়াজ আর টমেটোর খাদ্য অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের
বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেকে বলছে, জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন এই বিপর্যয়ের এক বড় কারণ।
সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির মধে্য খাদ্য মুদ্রাস্ফীতিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও অবজ্ঞা করতে পারে না। কারণ সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির মধে্য শতকরা ৪০ ভাগ খাদ্য উপভোক্তার ঝুড়ি থেকেই আসে। তার মধে্য আলু-পেঁয়াজ ও টমেটোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ঋতু বিপর্যয়, বর্ষা ও গ্রীষ্মের চরিত্র বদল এই খাদ্য উৎপাদনে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ ছিল চরম গরমের রেকর্ড-বর্ষ। অকালবর্ষণ ও অতিবর্ষণ খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি শতকরা
১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে ২০২৩-’২৪ সালে। জুন মাসে সাধারণ বর্ষার তুলনায় শতকরা ১১ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।
এবার তাই বাজেটে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আর্থিক ব্যবস্থা নিতেই হবে। ফোড়েদের দৌরাত্ম্য কমেনি। চাষিরা আরও গরিব হয়েছে। ন্যায্য মূল্য থেকে এখনও তারা বঞ্চিত। চাষির ছেলে চাষ করতে চাইছে না, কারখানায় এসে অস্থায়ী শ্রমিক হতে চাইছে। আইআইটি ইঞ্জিনিয়ররা পাস করে চাকরি পাচ্ছে না। সরকারি ক্ষেত্রে ক্রমশ চাকরি কমছে তো কমছেই। শূন্যপদ ভর্তি করা হচ্ছে না। বেসরকারি ক্ষেত্রেও অস্থায়ী নিয়োগ বাড়ছে। মাথা ভারী সংগঠনের চরিত্র বদলে কম লোক নিয়োগ করে, বেশি কাজ করানো হচ্ছে।
এদিকে বাজারে চাহিদা এবং জোগানের ভারসাম্যহীনতা। ব্যাঙ্কে ঋণের সুদ কমিয়ে উপভোক্তা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। তবু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সে-অনুপাতে বাড়ছে না। ফলে বাজারে পণ্য থাকলেও বাজার তেজি নয়। বাজার সক্রিয় নয়।
টাকার সংবহন বাজারে বাড়াতে গেলে চাই কর্মসংস্থান। সুষ্ঠু চাকরি। মানুষের আয় না বাড়লে তার ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে কী করে! অতি ধনীর বাজার আছে কিন্তু সে তো প্লুটোক্রেসি বা অতি ধনীতন্ত্র। ধনীরা সঞ্চয় না করে আমজনতার জন্য খরচ করলে, জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য তা হিতকর।
মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়ে থেকে সর্বজনীন দুর্গোৎসব– কোটি কোটি টাকা খরচ নান্দনিক কি নান্দনিক নয় তা নিয়ে বিতর্ক যাই হোক, এসব ইভেন্ট বাজারকে তেজি রাখে। উপভোক্তাবাদকে বঁাচিয়ে রাখে। ধনী কৃপণ হলে গরিবের আরও কষ্ট। এর মধে্য ঢুকে পড়ে রাজনীতি। দেশীয় অর্থনীতি বা রাজে্যর বেহাল অর্থনীতির দায় শুধুমাত্র কোনও একটি রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির উপর বর্তায়– এমনটা ভাবতে আমি রাজি নই। অনেক সময় দলমত নির্বিশেষে রাজনেতাদের গরিব মানুষ-সাধারণ মানুষের জন্য ভরতুকি দিতে হয়। ভরতুকি বন্ধ করে কঠোর অার্থিক সংস্কারের পথে হঁাটা ভারত কেন, গোটা পৃথিবীতেই কোনও দলের পক্ষে সম্ভব নয়।
যারা প্রান্তিক, গরিব, ‘হ্যাভ নট’, তাদের ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ গোষ্ঠীতে আনার চেষ্টা করতে হবে, যাতে দেশের প্রতিটি নাগরিক একটা প্রাথমিক রোজগারের সুযোগ পায়। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ থেকে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প তাই জনপ্রিয়। তাতে মানুষের কল্যাণ হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদিও কেন্দ্রীয় স্তরে এ ধরনের জনমুখী প্রকল্প ঘোষণা করছেন। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সরকার এ ধরনের নাগরিক ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। যা জনকল্যাণকর তো বটেই আবার নির্বাচনী কৌশলও। কিন্তু মূল প্রশ্নটি আরও গভীরে।
নরেন্দ্র মোদির সরকার দেশের বেকারত্ব, দারিদ্রমোচনে সুনির্দিষ্ট কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? এবার বাজেটে মোদির সামনে সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বেকারত্ব দূর করে এ-দেশে সুষ্ঠু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে গেলে প্রয়োজন উৎপাদন শিল্পের বিকাশ। চিন যেমন শ্রমনির্ভর উৎপাদন কৌশলে চলে গিয়েছে বহু দিন আগেই। ইজরায়েল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অন্য দেশ থেকে ৭০ হাজার শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে আছে ১০ হাজার ভারতীয়। উদ্দেশ্য–নির্মাণশিল্পের উন্নতি। হামাস আক্রমণের পর সে-দেশে ৮০ হাজার প্যালেস্তিনীয় শ্রমিক গিয়েছে। কাজ না-পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয়রাও কাজ করতে চলে যাচ্ছে। এদিকে, এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে উৎপাদনের কৌশলের অভাব নেই নাকি। স্টার্ট-আপ ব্যবসাকেও আরও জোর দিতে হবে বাজেটে। কোথায় এই স্টার্ট-আপ ব্যবসার বিনিয়োগ প্রয়োজন? ডিজিটাল ও আবাসন পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে।
তাই শুধু বৃদ্ধির হার আর বিকশিত ভারতের কাহিনি শোনালে হবে না। প্রয়োজন অসাম্য ও কর্মহীনতা দূর
করা। দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি, আমদানির উপর অতি-নির্ভরতা, পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে চাই দল-মত নিরপেক্ষভাবে অভিযান। শুধুমাত্র সিবিআই ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের অভিযান দিয়ে বিকশিত ভারত
গঠন অসম্ভব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.