‘জি-২০’ বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরব হবেন, প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আশার মশালে আর আগুন জ্বলল কই! একদিকে আমেরিকা, অন্যদিকে রাশিয়া-চিন অক্ষ। নতুন বিশ্বক্ষমতার রাজনীতিতে নিরপেক্ষ থাকার কঠিন ব্রত ভারতের। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
ভারতের অধিনায়কত্বে ‘জি-২০’ সম্মেলন এখনও পর্যন্ত কোনও আশার আলো দেখল না। সম্মেলনে প্রধান স্লোগান ছিল- এক বিশ্ব, এক পরিবার ও এক ভবিষ্যৎ। ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো’-র এহেন স্বপ্নবিলাস সদ্য-হয়ে-যাওয়া জি২০ বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে ভেঙে চুরমার। নয়াদিল্লিতে সে সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে গৃহকর্তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী খোদ নরেন্দ্র মোদিই প্রকাশ্যে বললেন- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্ব প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ। সরাসরি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথাটা বলা হয়নি। তবে আমজনতার প্রত্যাশা ছিল, পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতারা এই যুদ্ধ এখনই থামাতে না পারলেও, অন্তত যুদ্ধের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে একটা অবস্থান নেবেন। একটা যৌথ বিবৃতি গৃহীত হবে।
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত শেষ জি-২০ বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজে হাজির না-হলেও তাঁর বিদেশমন্ত্রী গিয়েছিলেন। একটি যৌথ ঘোষণা হয়েছিল, যেখানে শান্তির ললিত বাণী শোনা গিয়েছিল। এবার মোদি এবং তাঁর যোগ্য সেনাপতি বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি, তা সত্ত্বেও ভারত এই দৌত্যে সফল নয়। মোদি নিজেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পৃথিবীতে বহুপাক্ষিকতার কূটনীতি কাজ করছে না। ‘মাল্টিল্যাটারালিজম ইজ ইন আ ক্রাইসিস’। উলটে ইউরোপের বহু দেশ তো ভারতকেই দুষছে। ইউক্রেন যুদ্ধই যখন জি২০ সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি ছায়া ফেলেছে, জলবায়ু থেকে অর্থনীতি সব বিষয় ম্লান হয়ে যাচ্ছে, তখন অধিনায়ক দেশ ভারতের উচিত ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুরনো অবস্থান বদলে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া। এবার যুদ্ধবিরোধী অনুচ্ছেদ নিয়ে মূলত রাশিয়া ও চিনের বিরোধিতায় প্রস্তাব সর্বসম্মত হতে পারেনি। ওদের তোয়াক্কা না-করে আমেরিকা-ইউরোপের পাশে ভারত থাকলে প্রস্তাব রাশিয়া-চিনকে বাদ দিয়ে গৃহীত হত।
ভারত এ যুক্তি মানতে রাজি নয়। মনে হয়, এই মুহূর্তে ভারতের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ৯ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লির প্রগতি ময়দানে জি-২০ রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠক হবে। সে সমাপ্তি বৈঠকে যুদ্ধবিরোধী ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার একটা শেষ চেষ্টা ভারত করবে, কিন্তু কাজটা সহজ নয়। ভারত যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। যুদ্ধ থামানোর জন্য সর্বস্তরে দৌত্যর পক্ষে। পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে কড়া ভাষায় যুদ্ধ-বিরোধী বক্তব্য মোদি প্রকাশ্যেই রেখেছেন। কিন্তু, তিনি আমেরিকা তথা বাইডেনের ‘ন্যাটো’-র অঙ্গুলিহেলনে পুতিনকে বয়কট করতেও চাইছেন না। এতদিন সাংবাদিকতা করে এটা ঢের বুঝেছি যে, সবচেয়ে কঠিন কাজ হল, নিরপেক্ষ থাকা। নিরপেক্ষ থাকার চেয়ে কোনও ছাতার তলায় যাওয়া বোধহয় সবসময়ই খুব সহজ কাজ।
একদিকে আমেরিকা, আর অন্যদিকে রাশিয়া-চিন অক্ষ। এই নতুন বিশ্বক্ষমতার ভারসাম্যের রাজনীতিতে নিরপেক্ষ থাকার কঠিন ব্রত ভারতের। আর-একটি বিশ্বযুদ্ধ কখনওই কারও জন্যই কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রাক্তন ‘কেজিবি’ বস পুতিন যেভাবে যুদ্ধবাজ আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে এক নয়া সম্প্রসারণবাদের জন্ম দিয়েছেন, তা ভারত সমর্থন করে না। কিন্তু ইউক্রেনকে ন্যাটো যেভাবে অস্ত্র সরবরাহ করছে, রাশিয়াকে পালটা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাতেও মার্কিনি সমরবাদের সাবেক অর্থনীতির কায়েমি স্বার্থ জড়িয়ে আছে। ভারত তাকেই-বা সমর্থন করে কী করে? পাকিস্তানের মতো ভারত কি ন্যাটো-র সদস্য হয়ে যাবে?
চিনের বিদেশমন্ত্রী সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। চিন ও রাশিয়া যৌথভাবে পশ্চিমি দুনিয়াকে দায়ী করছে যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান না-পাওয়ার জন্য। যেমন- ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে যে ‘কোয়াড’ নামক গোষ্ঠী, জি২০ সম্মেলনের সময়ে তাদের পৃথক বৈঠক হয়েছে। কোয়াডের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা সন্ত্রাসদমনে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করবে। জয়শংকর এই কোয়াড-বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে পৌরোহিত্য করেছেন। কিন্তু চিনের সঙ্গে সম্পর্কটা তলানিতে এসে ঠেকুক, যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাক- এটাও কি ভারতের জন্য কাম্য? রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী বললেন, চিন ও ভারত, এই দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের খুব ভাল সম্পর্ক। আমরা চাই চিন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা ভাল হোক।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারত কেন সরাসরি শত্রুতায় যেতে চাইছে না? মার্কিন চাপ যতই থাকুক, রাশিয়ার সঙ্গে সাবেক ঐতিহাসিক সম্পর্কটি ছিন্ন করা ভারতের সার্বভৌম জাতীয় স্বার্থ নয়। তাছাড়া, জ্বালানি সংগ্রহের প্রশ্নেও ভারতের রুশ নির্ভরশীলতা যথেষ্ট। ভারতের ৮০ ভাগ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি হয়। রাশিয়া ছাড়া অন্যান্য দেশ থেকেও ভারত এই জ্বালানি নিচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া ভারতকে অনেক সস্তায় এই জ্বালানি দেয়। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা মানে অন্য দেশের কাছ থেকে বেশি দামে জ্বালানি নেওয়া। তাতে ভারতের অর্থনীতির উপর চাপ বাড়বে।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও গত পাঁচ বছর ধরে রাশিয়া ভারতকে আমদানির শতকরা ৪৬ ভাগ সরবরাহ করে। ভারত এই প্রতিরক্ষা আমদানির প্রশ্নে ধীরে ধীরে রুশ নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে। ইজরায়েল, ফ্রান্স ও আমেরিকার কাছ থেকেও অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার কিনছে, কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে যেসব পুরনো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে সেগুলো ভারত আচমকা ছিন্ন করে কোনও বিপরীত বার্তাও দিতে চাইছে না। ইউরোপের যে এক্তিয়ার, তা সত্যি কথা বলতে কী তুরস্কে এসে থেমে যায়, তারপর কাজাখস্তান থেকে এক দীর্ঘ এলাকায় রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ বেশি। তাই ভারতের ‘কন্টিনেন্টাল’ বিদেশনীতিতে রাশিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর এই প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে বই কমেনি। বিদেশনীতি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গেও বিশেষভাবে যুক্ত থাকে। কোনও দেশেরই বিদেশনীতি কোনও নিরালম্ব বিষয় নয়। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারাকে অবলুপ্ত করার বিষয়টি যখন রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পর্যন্ত পৌঁছয়, তখন রাশিয়া ভারতের পাশে ছিল।
অন্যদিকে রাশিয়া-চিন সখ্য যা-ই হোক, ভারত সীমান্তে চিনের আগ্রাসন বাড়ছে। মার্কিন গোয়েন্দাদের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে চিন-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা, এমনকী পরমাণু শক্তির ব্যবহারের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার মাধ্যমে চিনের সঙ্গে বোঝাপড়ার পথে যাওয়াটাই কি উচিত কাজ নয়? যেমন, রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে ভারত যেভাবে আফগানিস্তানে নয়া তালিবান সরকারের ভয়ংকর বৈরিতাকে সামলাতে পেরেছে, উলটে পাকিস্তানকেই একঘরে করে দিতেও সক্ষম হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শুধু তো ভারতের জন্য নয়, পৃথিবীর জন্যও। আর্থিক সংকট চরমে। বিশ্বজুড়ে কর্মহীনতা। জলবায়ুর সংকট। এ অবস্থায় জি২০ অর্থমন্ত্রীদের বেঙ্গালুরু বৈঠকেও সম্প্রীতির ছবি দেখা গেল না। ভারতের চ্যালেঞ্জ মস্ত বড়- একদিকে চিনের সঙ্গে শত্রুতাকে ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’-এ না নিয়ে গিয়ে আলোচনার নতুন আবহ তৈরি করা। আবার, প্রতিবেশী চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য আঙ্কল স্যামের সঙ্গেও সম্পর্কে চিড় ধরালে চলবে না। রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করেও ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিম দুনিয়া তথা ইউরোপের পাশে থাকতে হবে।
কূটনীতির এই ট্রাপিজের খেলা এক কঠিন প্রচেষ্টা। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন হাঙ্গেরিকে আক্রমণ করে, জওহরলাল নেহরু তখন বিশ্বনেতাদের বলেছিলেন- যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার, একটা দেশের বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক প্রস্তাব নিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। নেহরু সেদিনের কূটনীতিকে বলেছিলেন- ‘প্র্যাগম্যাটিক নিউট্রালিটি’। এখন ২০২৩ সালে মোদির জন্য এই বাস্তববাদী নিরপেক্ষতা রক্ষা আরও কঠিন কাজ।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.