১৯৬২-তে ইন্দো-চিন যুদ্ধে ইজরায়েলের অস্ত্র ভারত ব্যবহার করেছে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধেও। বর্তমানে, গাজায় যে-আক্রমণ আকাশপথে চলছে, ইজরায়েল তাতে ভারতে তৈরি অস্ত্র প্রয়োগ করছে! এবং ইতিহাস ছেনে দেখা যাচ্ছে, প্যালেস্তাইন বিতর্কে ভারত বরাবরই নীরব। লিখছেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
মিউনিখ অলিম্পিক্স, ১৯৭২। সদ্য কাগজ পড়তে শেখা বালকটির মনে তোলপাড় তুলল ক্রীড়াঙ্গনে ইজরায়েলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের হত্যার সংবাদ। আরব-ইজরায়েলের সংঘাতের ব্যাপারটা সেই প্রথম সে শুনল বড়দের মুখে, তাঁরা বললেন, বড় হয়ে ওসব বুঝবে, একতরফা কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। হ্যাঁ, আমাদের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে সমস্যা ও সংঘাত শতাব্দীপ্রাচীন হতে চলল, আশু নিরসনের সম্ভাবনা এখনও অনেক দূর!
অতীতের কথা তো অনেকেরই জানা। ২০১৫-য় প্রকাশিত, নিকলাস ব্লারেলের বই– “দ্য ইভোলিউশন অফ ইন্ডিয়া’স ইজরায়েল পলিসি: কন্টিনিউটি, চেঞ্জ অ্যান্ড কম্প্রোমাইজ সিন্স ১৯২২” আলোকপাত করেছে স্বল্প আলোচিত কিছু বিষয়ে। ভারতে প্রকাশ্যে ও আড়ালে ঘটে যাওয়া নানা ব্যাপারে। ১৯৩৮ সালে বলা গান্ধীজির কথা বহুচর্চিত– প্যালেস্তাইনের পুণ্যভূমি তো আরব উৎসের মানুষজনেরই– যেমন ইংল্যান্ড ইংরেজদের, ফ্রান্সের উপর ফরাসিদের অধিকার! হারম্যান ক্যালেনবাখ, হেনরি পোলক, আরও কিছু সহচরদের প্রভাবেই হয়তো বলেছিলেন অমন কথা। ১৯৪৬ সালে, ইঙ্গ-ইহুদি উৎসের পার্লামেন্ট সভ্য সিডনি সিলভারম্যানের প্রভাব তঁাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়– ওই ভূখণ্ডে ইহুদিদের অধিকার অনেক আগে থেকেই…।
আমাদের দেশটা ভাগ করেছে যারা, তারা-ই যখন প্যালেস্তাইন ভাগ করে, দুঃস্থ দেশ কোন মুখে আপত্তি জানাবে? উদ্বাস্তু ইহুদিদের জন্য ইজরায়েল বানিয়ে দিলাম, এবার ভারত ভেঙে পাকিস্তান বানাব– এমন পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল হয়তো। দক্ষিণ এশিয়ার আমরা অনেকেই ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়িয়েছি, কিন্তু ইহুদিরা যে ব্রিটিশ বা পাশ্চাত্য প্রভাবের পাশেই ছিল সেই সময়ে!
ছোট-ছোট নানা রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত প্যালেস্তাইনে, ১৯৬৪ সালে তৈরি হল ‘পিএলও’, মানে ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন’। মিশরের অধীনে বহু দিন থেকে, ১৯৬৭ নাগাদ ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে যুদ্ধে জিতে, প্যালেস্তাইন তখন উদীয়মান শক্তি। বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য ভারতকে তো তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবেই! ইরান বা তুরস্ক– মুসলিমপ্রধান দু’টি দেশ তত দিনে রাষ্ট্র সংঘর সভ্য ইজরায়েল-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। সোভিয়েত মুলুক দিয়েছে সবার আগে, সুতরাং এ-দেশের বামপন্থীরাও নেহরুকে কোনও বাধা দেয়নি স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে। উদ্বাস্তুদের উপর অল্প সমবেদনাবশত নেহরু ১৯৫৫-র বান্দুং সম্মেলনে ইজরায়েলকে আমন্ত্রণ করবেন ভাবছিলেন। ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য কিছু দেশের সায় থাকলেও প্রবল আপত্তি জানাল পাকিস্তান। ওদিকে, গামাল আবদুল নাসের ১৯৫২ সালে মিশরে ক্ষমতাসীন হয়েছেন, নেহরুর সঙ্গে তঁার সুসম্পর্ক। আরব মুলুকের নানা দেশকে নিয়ে উদার জাতীয়তাবাদী একটা ব্যবস্থা নেহরুর সমর্থনেই তিনি গড়ে তুলতে চান।
গামাল অস্বীকার করতে চান ইরাক-ইরান, পাকিস্তান-তুরস্ক ও ব্রিটিশদের একসূত্রে বঁাধা ‘বাগদাদ চুক্তি’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাদাভাবে চুক্তি সেরে ফেলেছে। মিশর ও ভারতের বন্ধুত্বের চুক্তি হল ১৯৫৫ সালে। এদিকে, ১৯৫৬ নাগাদ গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েল একযোগে সুয়েজ খাল আক্রমণ করেছে। এমন অবস্থায় বন্ধুতা হবে কীভাবে? এমন পরিস্থিতিতে, দেখা গেল ১৯৬২-তে ইন্দো-চিন যুদ্ধে ইজরায়েলের অস্ত্র ভারত ব্যবহার করেছে। ১৯৬৫ ও ’৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধেও। ১৯৬৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘মোসাদ’-এর সাহায্যে গোপনে এই দেশের নিজস্ব গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড আনালিসিস উইং) গড়ে তুলেছেন। এটা বেশি কেউ না-জানলেও অধিক প্রচার পেল ১৯৭৪ সালে ‘পিএলও’-কে স্বীকৃতিদান। রাষ্ট্র সংঘের ৩৩৭৯ সংখ্যক সিদ্ধান্তে ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল, ইহুদি জাতিসত্তাকে যেখানে অস্বীকার করা হয়েছে। দ্বিচারিতার সীমা কত দূর– ১৯৯১ সালে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই ভারত ভোট দিচ্ছে! ইন্দিরা গান্ধী এবং মনমোহন সিংহও বলেছেন, মোশে দয়ান (তৎকালীন ইজরায়েল সুরক্ষা মন্ত্রী) নাকি ১৯৭৭-’৭৯-এর মধ্যে বেশ কয়েকবার গোপনে ভারতে এসে মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন! ১৯৮৫-র ১ অক্টোবর আকাশপথে ইজরায়েল আক্রমণ হানল ‘পিএলও’-র হেড কোয়ার্টারে। রাষ্ট্রসংঘ-সহ নিন্দা করল বিশ্বের নানা দেশ, কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেই মাসেই রাষ্ট্র সংঘর ৪০তম উদ্যাপন অনুষ্ঠানে এসে গোপনে দেখা করেছিলেন ইজরায়েলের রাষ্ট্রপ্রধান সাইমন পেরেসের সঙ্গে।
বর্তমানে আমরা দেখছি, ২০২৩ সালে যেই যুদ্ধ ফের চাগিয়ে উঠল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি সরাসরি ইজরায়েলের পক্ষে কথা বললেন। গাজায় যে-আক্রমণ আকাশপথে চলছে, তাতে ভারতে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে! আদানি যে ‘এলবিট অ্যাডভান্সড সিস্টেমস’ সংস্থার অংশীদার, এ তো আমরা অনেকেই জেনে গিয়েছি। ২০১৪ সালেও যখন ইজরায়েল গাজায় আক্রমণ শানিয়েছিল, সদ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া মোদি তখন সংসদে বিরোধীদের নিন্দাপ্রস্তাব আনার পথ রুদ্ধ করেছিলেন। ইজরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হাইফা, তার উন্নয়নের টেন্ডার পেয়েছেন গৌতম আদানি, সে-ও অনেকের জানা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক নানা সংকট ও বাধ্যতার খবর আমরা রাখি কি?
চিন এশিয়ায় এখন অগ্রগণ্য শক্তি, এবং ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কে নানা উচ্চাবচ উত্তেজনা আছে। রাশিয়া চিনের বন্ধু দেশ, কিন্তু গুরুতর সংকট গজিয়ে উঠলে, পুরনো সহযোগী ভারতের পাশে রাশিয়া কতখানি দঁাড়াবে? কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেল আভিভকে তৈলমর্দন করার এই সাম্প্রতিক প্রবণতা সহজবোধ্য। ২০০৯ থেকে ২০১৩ অবধি– ভারতের রাশিয়া থেকে আনা অস্ত্র, আমদানিকৃত সমস্ত অস্ত্রভাণ্ডারের মধ্যে ছিল তিন-চতুর্থাংশ। গত পঁাচ বছরে সেটা এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে। তালিকায় রাশিয়া এখনও শীর্ষে, তবে ইজরায়েল এবং মার্কিন মুলুক থেকে এখন অস্ত্র আসছে ৪৪ শতাংশের বেশি। ফ্রান্স থেকেও অস্ত্র আমদানি হচ্ছে।
কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসা প্যালেস্তাইন সমস্যার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থনে, অন্তত ১০টি দেশ কঠোর শাস্তি চাইছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। সমস্ত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এতকাল রুখে দঁাড়ানো ভারত এখন এই বিষয়ে নীরব। অস্ত্র আমদানির বাধ্যতা এতখানিই? সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাশ্মীরে বিনিয়োগে আগ্রহী, শোনা গিয়েছিল। ইজরায়েল যেভাবে বেদুইনদের জমি কেড়ে নিয়েছে নিজেদের সীমানা বাড়াতে, কাশ্মীর নিয়েও কি অমন খেলা খেলতে চায় কেউ? ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি কি সেসব আন্তর্জাতিক চাপেই? উত্তর-সতে্যর কালে রাজনীতি আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব একই পয়সার দুটো পিঠ, তাই সময়ই বলবে সব!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.