শেষ দশ বছরে ভারত হয়তো একটিও আইসিসি ট্রফি জেতেনি, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, এই একটি দেশ থেকেই ৮০ শতাংশ রাজস্ব আসে। ক্রিকেটের ভবিষ্যতের পক্ষে সেটা মোটেই সুখবর নয়। কেন ব্রডকাস্টাররা ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে ১৪-র বদলে ১০টি দলের টুর্নামেন্ট চেয়েছে, তা স্পষ্ট। ভারতের খেলা ছাড়া অন্য দলের খেলা বাণিজ্য দেয় না। লিখলেন বোরিয়া মজুমদার।
২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর্শক দেখেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত ছয় সপ্তাহে ১২,৫০,৩০৭ জন দর্শক এসেছেন স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে। বিশ্বজুড়ে ফাইনাল ম্যাচ দেখেছেন ৫ কোটি ৩০ লক্ষরও বেশি দর্শক। এই সংখ্যাতত্ত্ব আমাদের অনেকটাই আশাবাদী করে– ওয়ান ডে ফরম্যাটের ক্রিকেটীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভেবে দেখুন, ৫ কোটি মানুষ, যা কিনা একটি বড়সড় ইউরোপীয় দেশের জনসংখ্যার সমান, একটি খেলা দেখছেন, একসঙ্গে। তাছাড়া, ভারতের সব কটি খেলার দর্শক সংখ্যাই ছিল চমকে দেওয়ার মতো। কিন্তু ‘ভারতের খেলা’– এ-কথাটার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সমস্যার বীজ।
আমরা না হয় সব মিলিয়ে দর্শক-সংখ্যার অঙ্কটা দেখছি, কিন্তু ভারত ছাড়া অন্য দেশের খেলার দর্শক-সংখ্যার দিকে কি আমাদের ততটা নজর আছে? আদৌ খেলা দেখেছেন কতজন, আর কতজন উগ্র জাতীয়তাবাদের হজমি গিলেছেন খেলার নামে? আমরা কি সত্যিই ভাল খেলা দেখছি, নাকি এর সঙ্গে গা-জোয়ারি দেশপ্রেমের ঝাঁজও জড়িয়ে আছে? কিছুই না, ভারত-নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনালের দর্শকসংখ্যা দেখুন, আর অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালের দর্শকসংখ্যা দেখুন– হিসাব পরিষ্কার। বিশেষ করে যেখানে দ্বিতীয় খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমজমাট হয়ে উঠেছিল, সেখানে বিষয়টা চিন্তার ভাঁজ আরও বাড়ায় বইকি।
ভারতের হারের পর প্রতিক্রিয়া দেখলেই দর্শকদের এই আচরণের ব্যাকরণ খোলসা হবে। এই একটা ম্যাচে হেরে যেন সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল! যে দশটা ম্যাচে টানা অপরাজিত থেকে ভারত ফাইনালে পৌঁছল, তার আর কোনও গুরুত্বই রইল না। ঠিক এক সপ্তাহ আগেই যে-খেলোয়াড়দের মাথায় তুলে রাখা হয়েছিল, তাদের ‘ট্রোল’ করা, যাচ্ছেতাই গালমন্দ করাটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠল যেন। যেন বিশ্বকাপটা হয়েছেই ভারত জিতবে বলে– এই খেলার অন্য কোনও পরিণতি যেন মেনে নেওয়াই যাবে না।
এখানেই উদ্বেগ হয় ক্রিকেটের জন্য। বেশ বুঝতে পারছি, কেন ব্রডকাস্টাররা ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে ১০টি দলের টুর্নামেন্ট চেয়েছে, ১৪টি দলের খেলার প্রবল জাঁকজমক নয়। তারা তো ব্যবসাটাই দেখবে আগে, কোনও সমাজসেবা করতে তো তারা আসেনি। ভারতের খেলা ছাড়া দর্শক-ই হবে না, বিপুল লোকসানের মুখোমুখি হতে হবে তাদের, এ-কথা যখন তারা জানে– তখন শুধু শুধু ঝুঁকি নিতে যাবে কেন তারা? কোটি কোটি ডলার দিয়ে ব্রডকাস্টের রাইটস কিনে প্রত্যেকেই তো চাইবে লাভের অঙ্কটা বুঝে নিতে। ভারতের খেলা ছাড়া বাদ বাকি খেলার দর্শক-সংখ্যা দেখে তারা কঠিন বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।
অথচ, একা আমাদের দেশ তো একটা খেলা চালাতে পারে না। ক্রিকেটের পুঁজি নিয়ে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। শেষ দশ বছরে ভারত হয়তো একটিও আইসিসি ট্রফি জেতেনি, কিন্তু এ-কথাও সতি্য যে, এই একটি দেশ থেকেই ৮০ শতাংশ রাজস্ব আসে। ক্রিকেটের ভবিষ্যতের পক্ষে এটা গুরুতর প্রশ্ন তোলে। শুধু ভারতের খেলা-ই বিকোয়, বাকি সব ফাউ– এমন ব্যবসায়িক ঘূর্ণিপাকে কে পড়তে চায়? এর মানে দাঁড়ায় এই আমরা, ভারতীয়রা আদৌ ক্রিকেট ভালবাসি না। আমরা কেবল একটা জাতীয়তাবাদী প্রদর্শনীতে বিশ্বাসী, যার শেষে ভারত জিতে যাবে।
আইপিএল বিশ্বকাপের চেয়ে বেশি নিরাপদ বিনিয়োগ কেন? ক্রিকেটের সর্বোচ্চ শিরোপার লড়াইকে একটি দেশীয় প্রতিযোগিতা কীভাবে ছাপিয়ে যেতে পারে? সহজ কারণ, আইপিএলে ভারত প্রতি রাতই জেতে। সে চেন্নাই, মুম্বই, কলকাতা– যে-দলই জিতুক, দিনের শেষে সেটা তো ভারতেরই জয়! দর্শকরাও দিব্যি খুশি মনে বাড়ি যায়। ব্রডকাস্টাররা এই সার সত্য বোঝে বলেই আইপিএলে বিনিয়োগে দ্বিধা করে না। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া যেভাবে ভারতের স্বপ্ন দুরমুশ করে দিল– তেমন কিছু তো আর আইপিএলে ঘটবে না।
এই প্রবণতার বাইরে ক্রিকেটকে বেরতে হবে। আইপিএল বিশ্বের ক্রিকেট-পুঁজির নিরিখে প্রথম সারির, এই কথা জেনে যতই আনন্দ আমরা পাই না কেন, খোদ বিশ্বকাপ অর্থনীতির জোরে পিছিয়ে রয়েছে– এই তথ্য মোটেই স্বস্তি দেয় না। ‘ফিফা’ বা ‘আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি’-র (আইওসি) কাছে এসব কোনও সমস্যাই নয়। আইওসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রডকাস্টের টাকার উপর নির্ভরশীল, কিন্তু ক্রিকেটের মতো তা সুতোর উপর দঁাড়িয়ে নেই। কে জিতল, কে হারল– সেটা বড় কথা নয়, ক্রিকেটকে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে গেলে এই ভারসাম্য ঠিক রাখতেই হবে। আমাদের প্রয়োজন আরও অনেক গ্লোবাল সুপারস্টার; কেবল রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলি নয়, যাঁদের সামাজিক মাধ্যমের উপস্থিতি বাকি সকলকে খাটো করে দেয়। নতুন ‘সুপারস্টার’ তৈরি করার মাধ্যমেই ক্রিকেটকে বঁাচাতে হবে।
এবারের বিশ্বকাপের সাফল্য চোখ-ধঁাধানো। খেলার আগামীর জন্য কী প্রয়োজন– তা বোঝার জন্য এই বিশ্বকাপ একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে। বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট নিয়ে আলোড়ন প্রয়োজন। শুধুই উগ্র জাতীয়তাবাদী ভারতীয় ক্রিকেট-ভক্ত আমাদের প্রয়োজন নেই, যারা শুধু নিজের দেশ জিতল কি জিতল না– তাছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এখানেই ভারতীয় ক্রিকেট নিজের উন্নতি ঘটাতে পারে।
(মতামত নিজস্ব)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.