প্রতীকী ছবি।
‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক’-এর তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। এই তালিকানুসারে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১১১তম স্থানে। আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, দেখব, ক্রমিক অবনমনের দিকে এগিয়ে চলেছে দেশ। লিখছেন মতিউর রহমান
সম্প্রতি চঁাদে সফল অবতরণ করেছে চন্দ্রযান-৩। বিশ্বে প্রথম চঁাদের দক্ষিণ মেরুতে নেমে ইতিহাস গড়েছে এ-দেশ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতির অাভাস মিলেছে। ‘আইএমএফ’-এর পর্যবেক্ষণ: আর পঁাচ বছরের মধে্য ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এসব কিছুর মধে্য দেশের পশ্চাদ্গতির ছবিও সম্প্রতি সামনে এসেছে। কিছু দিন আগে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এই তালিকা অনুসারে ১২৫টি দেশের মধে্য ভারত রয়েছে ১১১তম স্থানে। আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, দেখব, ক্রমিক অবনমনের দিকে ঝেঁাক।
আয়ারল্যান্ড ও জার্মানির দু’টি এনজিও, যথাক্রমে ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’ এবং ‘ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফ’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’-এর যে-রিপোর্ট, তাতে পরিষ্কার, অন্তহীন ক্ষুধার অন্ধকারে ডুবছে আমাদের দেশ। বর্তমান প্রতিবেদন অনুসারে, ১২৫টি দেশের মধে্য ১১১তম স্থানে রয়েছে ভারত। গত বছর অর্থাৎ ২০২২-এ ভারতের স্থান ছিল ১০৭ নম্বরে, অর্থাৎ এ-বছর ক্ষুধার নিরিখে দেশের অবনমন ঘটেছে আরও ৪ ধাপ। প্রতিবেশী নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পরে রয়েছে আমাদের দেশ। শ্রীলঙ্কা রয়েছে ৬০তম স্থানে, নেপাল ৬৯, বাংলাদেশ ৮১ এবং পাকিস্তান রয়েছে ১০২তম স্থানে। এ-দৃশ্য ভারতের কাছে সতি্যই বড় অস্বস্তি ও লজ্জার।
ভারত এগিয়ে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, ইয়েমেন, হাইতি, সুদান, বুরুন্ডি, সোমালিয়ার মতো কয়েকটি দেশের চেয়ে। আমরা যদি ২০২১ সালের পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, দেখব, ভারতের স্থান ছিল ১০১-এ। ২০২০ সালের রিপোর্টে ভারত ছিল ৯৪ নম্বরে। সুতরাং একটা জিনিস স্পষ্ট, বৈশ্বিক ক্ষুধার সূচকে ক্রমশ পিছচ্ছে আমাদের দেশ। ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুসারে ক্ষুধার নিরিখে ভারতের স্থান ছিল ৫৫-য়। এই ৯ বছরে ৫৬ ধাপ পিছিয়ে দেশের স্থান হয়েছে ১১১ নম্বরে! প্রশ্ন স্বাভাবিক, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত কি কেবল পিছতেই থাকবে?
‘বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক’ মূলত চারটি বিষয়কে বিবেচনা করে প্রস্তুত করা হয়– অপুষ্টি, পঁাচ বছরের নিচে শিশু-মৃতু্যর হার, কমবয়সি শিশুদের উচ্চতা ও ওজন। ভারত সরকার এই প্রতিবেদনকে অস্বীকার করেছে। দেশের মহিলা ও শিশু মন্ত্রক এই রিপোর্টকে ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছে। যে-মাপকাঠিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, তা দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ‘সূচক’ হতে পারে না বলে তাদের মত। শাসকের বদনাম বা ক্ষতিসাধনের উদ্দেশে্য এই ধরনের প্রতিবেদন বলেই তাদের অভিমত!
কিন্তু নিজেদের অযোগ্যতা ও অপদার্থতাকে আড়াল করতে প্রতি বছরের মতো এ-বছরও এহেন অজুহাত খাড়া করা? পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশ কি ক্ষুধাসূচক, কি গণতন্ত্রর সূচক, কি মানবসূচক– প্রতিটি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট, শাসক শিবিরের দাবি সম্পূর্ণ অসার ও অযৌক্তিক।
ক্ষুধা, দারিদ্র, অপুষ্টি ভারতের মতো উন্নয়শীল দেশের পক্ষে একটা বড় সমস্যা। এ-সমস্যা দিন-কে-দিন গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। বাড়ছে উদ্বেগ। এ-সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকারের কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। গলদ রয়েছে গণবণ্টন ব্যবস্থায়। একদিকে সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষুধায় ধুঁকছে মানুষ। গণবণ্টন ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর হলে এ দুরবস্থা দেখতে হত না। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও রয়েছে নিষ্ক্রিয়তা। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে ভুগে মারা যাচ্ছে। ৭৬ বছর পেরিয়ে গেল আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও সবার মুখে দু’বেলা দু’-মুঠো অন্ন জুটছে না– এই ঘটনা কি চরম দুর্ভাগ্য ও লজ্জার নয়? আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণে নানা পদক্ষেপ করেছিল এবং তার সুফলই মিলেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে শাসকের সদিচ্ছা ও ধারাবাহিকতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪২ কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যা নিঃসন্দেহে একটা চ্যালেঞ্জ। ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণে জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তবে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে আন্তরিক হলে ক্ষুধা ও দারিদ্রের প্রকোপ কমানো যায়। ভারতের থেকে সামান্য কিছু কম জনসংখ্যার দেশ চিন যদি তা করে দেখাতে পারে, আমরা তা পারব না কেন?
আর এখানেই সামনে আসে শাসকের ভূমিকা। ১০ বছর হতে চলল বিজেপি দেশের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে। মুখে তারা প্রগতির অনেক গালগল্প শোনালেও দেশের মানুষের যন্ত্রণা লাঘবে তারা তেমন কিছু করেছে কি? যে-যে জনমোহিনী প্রকল্পর ছর্রা কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে, সেগুলি আদৌ কি পৌঁছচ্ছে না কি সবই নির্বাচন-পূর্ববর্তী আলেয়া? বরং, স্পষ্ট যা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, একের-পর-এক রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি তারা জলের দরে বিক্রি করে দিয়েছে। ধনী কর্পোরেটদের দিয়েছে বিপুল ছাড় আর গরিব মানুষের উপর চাপিয়েছে করের বোঝা। একের-পর-এক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছে।
সমরাস্ত্র কিনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। নতুন সংসদ ভবন তৈরি করতে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারল সরকার, অথচ দেশের মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণে অর্থ ব্যয়ে তাদের যত কার্পণ্য। আসলে এই সরকার কর্পোরেট ভজনাকারী, দরিদ্র দেশবাসীর জন্য তাদের কোনও দয়ামায়া নেই। দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়নে তাদের সদিচ্ছার অভাব প্রকট।
দেশে ক্ষমতাসীন বর্তমান শাসক সবসময় মূল সমস্যার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে সদা সচেষ্ট থেকেছে। দেশের অর্থব্যবস্থা মজবুত বোঝাতে পঁাচ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির গল্প শুনিয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্বের মতো মূল সমস্যাগুলোকে তারা সবসময় আড়াল করতে চেয়েছে। কতকগুলো গৌণ বিষয়কে তারা সামনে এনেছে। কখনও এনআরসি-সিএএ, কখনও লাভ জিহাদ, আবার কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজন, বা উগ্র জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছে। আর এভাবে যে সত্যকে আড়াল করা যায় না, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক। এক্ষেত্রে ভারতের ক্রমিক অবনমন বড়ই বিড়ম্বনার।
তবে এ বিড়ম্বনাকে আর বাড়তে দিলে চলবে না। শাসককে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গৌণ ভাবনা নয়, মৌল ভাবনায় মন দিতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র নিয়ন্ত্রণে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। আগামী দিনে দেশের শাসক সে-পথে হেঁটে দেশকে সামনের সারিতে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই আমাদের আশা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.