ইমরান খান ও নভজ্যোৎ সিং সিধু। দু’জনেই ক্রিকেট থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু ক্রিকেটের জ্ঞানগম্যি দিয়ে যে রাজনীতির বৈতরণি পেরনো যায় না, তা এঁদের দেখলেই বোঝা যায়। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
ভারতীয় উপমহাদেশে, ক্রিকেট দুনিয়া থেকে আসা নেতাদের, সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছে না। পাকিস্তানে ইমরান খান-কে (Imran Khan) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে প্রায় টেনে নামানো হল। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে এই হাল হল তাঁর। আর ভারতে, সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে পাঞ্জাবে কংগ্রেসের লজ্জাজনক হারের পর পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিলেন নভজ্যোৎ সিং সিধু।
বলা বাহুল্য, পাকিস্তান ও পাঞ্জাবের রাজনৈতিক পটভূমিতে বিস্তর ফারাক, তা সত্ত্বেও অদ্ভুত কিছু মিল ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে। এই মিল নেতৃত্বের উত্থান ও পতনে। যেখান থেকে ক্রিকেটের বাউন্ডারি পেরিয়ে গণ-পরিসরে আসার জন্য উচ্চাভিলাষী ক্রিকেটারদের মোটামুটি শিক্ষা হয়ে যাবে, কী করা উচিত আর কী অনুচিত। ইমরান খানকেই প্রথমে ধরা যাক।
২০১৮ সালে ক্যারিশম্যাটিক ও অনুপ্রেরণাময় এক নায়ক রূপে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আবির্ভূত হলেন তিনি। দেশের সাম্রাজ্যবাদী ও দুর্নীতিপূর্ণ অভিজাত সম্প্রদায়ের একাধিপত্য ভেঙে সেই নায়ক ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ে তোলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। গড়পড়তা রাজনীতিকদের বোলচালে ক্লান্ত নাগরিকদের সামনে সম্ভাব্য ‘গেম-চেঞ্জার’ রূপে রীতিমতো আশার পাহাড় খাড়া করেছিলেন খান সাহেব। এর সঙ্গে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীরও তুমুল সমর্থন পেলেন। বলে রাখা ভাল, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সৈন্যদলের ক্ষমতা বিপুল। তা এমনই এক প্রেক্ষাপটে যে, ইমরান খানের আবেশ তৈরি করা আরও সহজ হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে কোনওরকম কাঁপুনি বা ঝাকুনি ছাড়াই পাকিস্তানের উর্দিবাহী সৈন্যদল ক্ষমতার গর্ভে ছড়ি ঘোরাতে লাগল। দেখে মনে হল, পাকিস্তানের (Pakistan) ক্ষমতার লড়াইয়ে যে দু’টি ব্যাপার মূল- জনতার ভালবাসা ও সেনার সমর্থন- সে দুটোই ইমরান খান পেয়ে গিয়েছেন।
অন্যদিকে, পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসেও সভাপতি রূপে নির্বাচিত হলেন নভজ্যোৎ সিং সিধু, যার-তার সমর্থনে নয়, একেবারে কংগ্রেসের গান্ধী পরিবারের হাত রইল তাঁর কাঁধে। গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাঁর এহেন যোগাযোগের অর্থ দাঁড়াল যে, পাঞ্জাবে কংগ্রেসের এই নৌকাডুবিতে উদ্ধারকর্তা হয়ে নিশ্চিত দাঁড়াবেন তিনি, যেখানে কিনা কিছুদিন আগেই দীর্ঘকালীন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিংকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমন সময়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে সিধুর ছবি বেশ তুরীয় মেজাজে ছড়াচ্ছে, যা থেকে বোঝাই যাচ্ছিল, সিধুর উত্তরণ অবশ্যম্ভাবী। ইমরানের মতোই, সিধুও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার স্বরে রগ ফোলানো প্রতিনায়ক হিসাবে উঠে আসছিলেন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিলেন পাঞ্জাবের এতদিনের পরিবারকেন্দ্রিক, ভুঁইফোঁড়, অর্থ-সর্বস্ব রাজনীতিকে। এমনিতেই জনগণকে আকর্ষণ করায় তাঁর জুড়ি নেই। ফলে, ভবিষ্যতের মুখ হিসাবে এই কয়েক মাস আগেও সিধুর উত্থান ছিল অপ্রতিরোধ্য, নাটকীয়তায় ঠাসা।
তাহলে কী হল? যে, এমন তারকা-গুণ, এমন দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হওয়া দুই ক্রিকেটার, ইমরান এবং সিধু রাজনীতিতে তাঁদের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটাতে পারলেন না? উত্তরটা ছোট করে বললে এটাই বলতে হয়- ক্রিকেটের পিচ আর রাজনীতির ময়দানের মধে্য ঢের তফাত। এখানে কোনও সমীকরণ দিয়েই মুহূর্তকে বাগে আনা যায় না। ক্রিকেটে একজন ক্রিকেটার বা তারকা সম্মুখসমরে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে কিংবা নিজের কারিকুরি, ব্যক্তিগত উদ্যম দেখিয়ে দলগতভাবে খেলায় একটা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু রাজনীতি আরও অনেক বেশি জটিল! এখানে একজনকেই একাধিক দায়িত্ব নিতে হয়, দোস্তি করতে হয় বিভিন্ন ধরনের লোকের সঙ্গে। সমষ্টিগত শক্তি গড়ে তুলতে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক জোর আনতে হয়। ব্যক্তিগত গরজ দিয়ে সেখানে কাজ হয় না। আর, নিজস্ব উচ্চাশা সরিয়ে রাখতে হয় একপাশে।
একদিক দিয়ে দেখলে, ইমরান খান এবং নভজ্যোৎ সিং সিধু- দু’জনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘরানার রাজনীতিবিদ, ওই ঐক্যনাশী রাজনীতি বলতে যা বোঝায়। এই ঘরানার ধরন হল, নেতৃত্বের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তি। এবং এই আবেশে তাঁরা নিজের মধ্যেই বুঁদ, ফলে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আত্ম-দাসত্বই বড়।
১৯৯৬ সালে ইমরান খান তাঁর ‘তেহরিক-ই-ইনসাফ’ দলের প্রতিষ্ঠা করলেন যখন, তখন পাকিস্তান ইমরানে মাতোয়ারা! মাত্র ক’টা বছর গড়িয়েছে, পাকিস্তানকে একমাত্র ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ জিতিয়ে এনেছেন তিনি, নেতৃত্ব দিয়ে। এর সঙ্গে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকেই সমাজ সংস্কারমূলক বিভিন্ন রকম কাজ, ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা- এসব কর্মকাণ্ডে তিনি হয়ে উঠলেন আরওই জনপ্রিয়। এসব মিলিয়েই ইমরান খান নিজেকে পাকিস্তানের ভাগ্যনির্ধারক ভাবতে শুরু করলেন। ভাবলেন, পাকিস্তানের এই ঘোলাজলের রাজনীতি ও বাধাবিপত্তি কোনওভাবেই তাঁকে ঘিরে ধরতে পারবে না। তিনি থাকবেন এসবের ঊর্ধ্বে।
সিধু যদিও ইমরানের মতো ক্রিকেটারও নন, নেতাও নন। ইমরান খান তাঁর দলকে গড়ে তুলতে যথেষ্ট কসরত করেছিলেন বছরের পর বছর। সেখানে সিধুর জীবন অনেকটাই কপালের ফের। বিজেপি থেকে মসৃণভাবে কংগ্রেসে ঝুপ করে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু অনর্গল বাক্যবাগীশ এই সর্দারের ভাবমূর্তি হয়ে দাঁড়াল এমন, যেন অতিমানব হয়ে তিনি এসেছেন। এসেছেন তিনি ঈশ্বরের আদেশে। বিশৃঙ্খল পাঞ্জাবকে তিনি উন্নততর ভবিষ্যৎ দেবেন! আর এই কথাটি তিনি ভাষণ থেকে শুরু করে সাক্ষাৎকার- সর্বত্র আওড়াতে লাগলেন।
সিধুর কাছে কংগ্রেস পার্টির সংগঠন হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিতান্ত ঘটনামাত্র। ভিতরের কাঠামো, দায়িত্বটায়িত্ব তিনি যখন-তখন টপকে যাচ্ছেন, এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর অফিসকেও তোয়াক্কা করছেন না- ভাবখানা এমন যে, তিনিই পাঞ্জাবের চূড়ান্ত উদ্ধারকর্তা। পার্টির মধ্যে বার্ধক্যের স্থবিরতার জুমলা তুলে তিনি যেভাবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের মুখ ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের গদি ওল্টালেন, তাতে মনে হতে শুরু করল, সময় এসে গিয়েছে- সিধু ছাড়া আবার কে!
গণতান্ত্রিক কাঠামো সংঘবদ্ধতার আশ্বাস ছাড়া যে চলে না, সেখানে যে একনায়কত্বের একরোখা অহং চলে না- তা ভুলে গিয়েছিলেন ইমরান ও সিধু। ঠিক যেমন ওয়াশিংটনে ভুলে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প জনগণকে উসকেছিলেন নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা চালানোর জন্য। যা কিনা গত বছরের জানুয়ারি মাসে ক্যাপিটল হিলে ঘটেছিল। অরাজকতা তৈরির ব্যাপারে সাম্প্রতিকের এই হল চরম নমুনা। একইভাবে ইমরান খানও দেশের নাগরিকদের এককাট্টা হয়ে তঁার বিরোধীদের প্রতিরোধের আহ্বান করলেন এই বক্তব্যে যে, বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে বিরোধীরা নাকি গদি ওল্টাতে চায়। এমনকী, রাস্তাতেও নামতে বললেন। এবং অনুরূপভাবে, সিধুও গোমড়ামুখো হয়ে নির্বাচনের আগে আগে তঁার দাবি না মেটানো হলে পদ থেকে ইস্তফা দেবেন বলে ভয় দেখাতে শুরু করলেন!
এই করতে গিয়ে তাঁদের বাতুলতা এমন চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছল যে, সেখান থেকে আর ফিরে আসার উপায় রইল না। হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে ট্রাম্প জিততে জিততে রয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির সমর্থন ছাড়া তো উত্থান সম্ভব হত না তাঁর। হতে পারেন ইমরান পাকিস্তানের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি, কিন্তু দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে যে সেনাবাহিনীর গণ্ডি বা সীমার বাইরে যাওয়া চলবে না, তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। আর, সিধুর এটা বোঝা উচিত ছিল, তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণত দলের ভবিষ্যতের উপর নির্ভরশীল। নিজের পার্টির মুখ্যমন্ত্রীকে সর্বসমক্ষে বারবার অপদস্থ করে আসলে নিজেরই বিপদ ডেকে আনছিলেন তিনি।
ঠিক এই কারণেই একরোখা ব্যক্তিমূলক রাজনীতির ধরনধারণ সমঝে চলে উচিত, বুঝে নেওয়া উচিত তার মতিগতি। কারণ, বেশিরভাগ সময়েই এখানে গণতান্ত্রিক ভাবনা ধুয়েমুছে যায় এবং ব্যক্তিগত আবেদনের দিকে মনোনিবেশ চলতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় নেতাদের উত্থানের ফলে অনেকরকম চরিত্রের আমদানি ঘটেছে এবং রাজনৈতিকতার ধারায় একটা বেশ তাজা হাওয়া এসেছে বটে। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত প্রয়াস যদি প্রশাসনিকভাবে ফলপ্রসূ না হতে পারে, যদি প্রতিশ্রুতি বারবার ভুল প্রমাণিত হতে থাকে, তখন এই ব্যর্থতা গণতন্ত্রকে আরও খাদের দিকে ঠেলে দেয়। কারণ, মানুষের বিশ্বাসটাই চলে যায় এই পলিটিক্যাল ক্লাসের থেকে। যে পর্যায়েই হোক না কেন, কোনও রাজনীতিককেই অস্বীকার করা যায় না পুরোপুরি। কিন্তু যেভাবে ইমরান এবং সিধু তাঁদের ভুল পদক্ষেপের জন্য রাজনীতির ময়দানে বোল্ড আউট হলেন, তাতে ভবিষ্যতে কোনও খেলোয়াড়ের পক্ষে রাজনীতির ময়দানে নামা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এবং এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, দুই দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন এক গুম হাওয়া ভেসে বেড়াচ্ছে, যেখানে নতুন মুখ, নতুন চেতনার একান্তই প্রয়োজন।
পুনশ্চ ইমরানের বহু ঘটনার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ঘটনাটি হল, ক্যাপ্টেন হিসাবে ম্যাচ-ফিক্সিংয়ের অভিযোগকে একদম উড়িয়ে দেওয়া। ১৯৮০-র শেষদিকের কথা। সেই সময় শারজায় ফাইনাল ম্যাচে ফিক্সিংয়ের গুজব ভাসছে, পাকিস্তানের বেশ কিছু খেলোয়াড় নাকি টাকা খেয়েছেন! ইমরান খান ঝটপট মিটিং ডাকলেন ড্রেসিং রুমে এবং বললেন- যাবতীয় প্রাইজ মানি আমি বাজি লাগিয়েছি এই ম্যাচটা জেতার জন্য, এবার বলো! বলা বাহুল্য, ম্যাচটা তাঁর দল জিতেছিল, তিনিও জয়ী হলেন। কিন্তু হায়, রাজনৈতিক পাওয়ারপ্লে যদি ক্রিকেট ম্যাচের মতো এতই সহজ হত!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.