কর্পোরেট করে ছাড় যেমন বেসরকারি লগ্নি বাড়ায়নি, তেমনই বিপুল টাকা মূলধনী খাতে খরচের ঘোষণাও বেসরকারি লগ্নি টানতে পারেনি। বিকল্প পথ হিসাবে সংঘ পরিবার চাপ দিচ্ছে আয়কর কমানোর জন্য। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কোন পথে হাঁটবেন? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
বাজেটের আগে এবারও ধুয়ো উঠেছে আয়করের ঊর্ধ্বসীমা কমার। এ-বছরটা সে-অর্থে ভোটের বছর নয়। বাজেটের পরে পরেই দিল্লির বিধানসভা ভোট। বছরের শেষের দিকে বিহারে বিধানসভা ভোট। ভোটের বছর না-হলে সচরাচর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে আয়করের বড় রকমের ছাড় দেখা যায় না। কিন্তু এবার সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ এসেছে আয়কর কমানোর। ফলত ১ ফেব্রুয়ারির আগে বলা যাচ্ছে না কী ঘটবে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কোন পথে হাঁটবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। গত কয়েক বছর তিনি সরকারের মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধির পথে হেঁটেছেন। কিন্তু তাতে যে বিরাট সুরাহা হয়েছে, এমনটা বলার সুযোগ নেই। বাজেটে যে-পরিমাণ অর্থ মূলধনী খাতে ব্যয় হবে বলে বলা হয়, বাস্তবে তা হয়নি। সরকারের মূলধনী লগ্নি বেসরকারি লগ্নিকেও উৎসাহিত করতে পারেনি। বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে বলে বাজেটের আগে আর্থিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস কম করা হয়েছে। কোভিড-পরবর্তী এই সময় ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে কোনওভাবেই ৭ শতাংশের কম আর্থিক বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের শেষে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশর বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হচ্ছে। এই কমের প্রধান কারণ হল, উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম।
এইচএমপিভি ভাইরাসের কারণে চিনের বাজার আগামী দিনে কিছুটা খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। সেটা হলে ভারতের ইস্পাত রফতানি ধাক্কা খাবে। ভারত এমন অনেক দেশকে ইস্পাত রফতানি করে, যারা ওই ইস্পাতের উপর মূল্য সংযোজন করে তা চিনে বিক্রি করে। সুতরাং, কোভিডের মতো এইচএমপিভি ভাইরাস চিনের অর্থনীতিকে ধাক্কা দিলে তার ঢেউ ভারতে এসে পড়বে। এতে দেশের উৎপাদন শিল্পের সংকট আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে এমন কোনও পদক্ষেপের কথা ভাবতেই হবে, যাতে দেশের বাজারে চাহিদা বাড়িয়ে উৎপাদন ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করা যায়।
গত বছরের বাজেটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন মূলধনী খাতে সরকার এক বছরে খরচ করবে ১১ লক্ষ ১১ হাজার ১১১ কোটি টাকা। ২০২৪-এর এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধে্য সরকার তার লক্ষে্যর মাত্র ৪৬.২ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছে। এই সময়ের মধে্য খরচ হয়েছে মাত্র ৫ লক্ষ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছে যে পৌঁছনো সম্ভব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০০৪-’০৫ থেকে ২০১৩-’১৪ ইউপিএ অামলের দশ বছর গড় অার্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশ, বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ভোগব্যয় বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ছিল। উল্টোদিকে, এনডিএ আমলের প্রথম পঁাচ বছরে ২০১৪-’১৫ থেকে ২০১৯-’২০-র মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির হার গড়ে ৬.৮ শতাংশ থাকলেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার কমে ৬.৩ শতাংশ এবং বেসরকারি ভোগব্যয় বৃদ্ধির হার সামান্য বেড়ে ৬.৮ শতাংশ হয়। ২০১৯-’২০-র পর দু’বছর কোভিডের জন্য সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়।
২০২২-’২৩ ও ২০২৩-’২৪-এ বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার কিছুটা বেড়ে ৭.২ শতাংশ ও বেসরকারি ভোগব্যয় কিছুটা কমে ৬ শতাংশ হয়ে যায়। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে এনডিএ অামলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার ইউপিএ অামলের চেয়ে কমে গিয়েছে (সূত্র: ‘ডিকোডিং ইন্ডিয়াস গ্রোথ স্লোডাউন’, প্রসেনজিৎ বোস ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস, ‘দ্য হিন্দু’)।
এটা ঘটনা যে, ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরে কর্পোরেট করে ছাড় যেমন বেসরকারি লগ্নি বাড়ায়নি, তেমনই নির্মলা সীতারমনের বিপুল টাকা মূলধনী খাতে খরচের ঘোষণাও বিনিয়োগ অাকর্ষণ করতে পারেনি। বেসরকারি লগ্নিতে জোয়ার আসবে এমন স্বপ্ন নরেন্দ্র মোদি সরকারের অামলে অধরাই থেকে গেল। এবার ‘বিকল্প পথ’ হিসাবে সংঘ পরিবার চাপ দিচ্ছে আয়কর কমানোর পথে হাঁটার জন্য। ভাবা হচ্ছে আয়কর কমলে মধ্যবিত্তর হাতে কিছু বাড়তি টাকা থাকবে বাজারে চাহিদা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু জোগান-নির্ভর অর্থনীতি থেকে চাহিদা-নির্ভর অর্থনীতির দিকে নির্মলা হাঁটবেন কি না তা এখন বাজেটের মুখে লাখ টাকার প্রশ্ন।
গত এক দশক ধরে মোদি সরকার চাহিদা বাড়ানোর পথে হাঁটার চেষ্টা করেনি। ব্যবসায়ীদের নানারকম ছাড় দিয়ে জোগান শৃঙ্খলা মসৃণ রাখার চেষ্টা করে যাওয়া হয়েছে। তাতে শেয়ার বাজার চড়া হওয়া ছাড়া লাভের লাভ কিছু হয়নি বলে বিরোধীদের অভিযোগ। চাহিদা বাড়িয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে জোর না-দেওয়ায় বেকারত্ব বেড়েছে। গত কয়েক বছরে কৃষিতে উৎপাদন ভাল হচ্ছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির ভাল হার অর্থনীতিকে এখনও ধরে রেখেছে। দেশের ভিতর ব্যবসায়ীরা যেমন বিশেষ বিনিয়োগ বাড়াননি, তেমনই গত কয়েক বছর ধরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগও কমছে। ভারতের শেয়ার বাজারে বিদেশি সংস্থার যে-লগ্নি থাকে সেটা বৃদ্ধির হার কমছে। টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন থেকে স্পষ্ট বিদেশি মুদ্রার জোগানে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করার একমাত্র পথ কি অায়করে ছাড়?
সংঘ পরিবার কেন অায়করে ছাড়ের জন্য এবার অর্থমন্ত্রীর উপর চাপ বাড়াচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এ-বছর দিল্লি ও বিহার ছাড়া কোথাও ভোট না থাকলেও ২০২৬ সালে একাধিক বড় রাজ্যে ভোট রয়েছে। সেটা মাথায় রেখেই কি এখন থেকে অর্থনীতিতে কিছুটা মেরামত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে সংঘ পরিবারের তরফ থেকে? বস্তুত, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে এবারই কিছু পদক্ষেপ করা প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সরকারের। শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ সামাজিক প্রকল্পগুলিতেও লগ্নি বাড়ানোর দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পেও বরাদ্দ বৃদ্ধির। পিএম কিষানেও অনুদানের পরিমাণ বাড়াতে চাপ বাড়ছে। এত ধরনের চাপের মধে্য নির্মলার বাজেট নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.