ছবি: প্রতীকী
‘ডেটা’ নিয়ে উত্তেজনা হঠাৎ আকাশ থেকে পড়া প্রসঙ্গ নয়। বহুকাল ধরে বিভিন্ন দেশে অ্যাক্টিভিস্টরা ‘ডেটা প্রিভেসি’ নিয়ে সরব; ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার যাতে না হয়, তাঁরা অনেক দিনই সতর্ক করছেন আমাদের। মানুষের স্বাধীনতা রক্ষা এবং তথ্য অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, এই দুই বিপুল অ্যাজেন্ডা জনপরিসরে এখন প্রবলভাবে উপস্থিত। ‘পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন বিল ২০১৯’ প্রত্যাহার সেই অস্থিরতাকে আরও উসকে দিল। লিখছেন নীলাঞ্জন দে
ছবিটা মুহূর্তে বদলে দিলেন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। ‘পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন বিল ২০১৯’ তো প্রত্যাহার করলেনই, সঙ্গে প্রিভেসি-সংক্রান্ত নতুন আইন আনার ইঙ্গিতও দিলেন। আপাতত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ডেটা অ্যাক্টিভিস্টরা, দেশ ও দশের সুরক্ষা নিয়ে যাঁরা চিন্তিত। তাঁরাও মনে করলেন এ-যাত্রায় পার পাওয়া গেল!
পার পাওয়া যে আদৌ সম্ভব নয়, তা নিয়েই লিখছি। এক, সংশ্লিষ্ট নীতিটি এখনও সেই অধরা-ই রইল, পরবর্তী পদক্ষেপ আরও একটু পিছিয়ে গেল। দুই, ডিজিটাল ইন্ডিয়া যে সুবিধাগুলো পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল, তা হাতের বাইরে থাকল। সম্ভাব্য ‘ডেটা প্রোটেকশন অথরিটি’ গঠনের দিকে যাওয়ার রাস্তায় বাধা পড়ল। আর বৃহৎ ইন্টারনেট কোম্পানি ঠিক কীভাবে দেশজ ডেটা ব্যবহার করতে পারবে, তার হদিশ পাওয়া গেল না এখনও। প্রসঙ্গত মেটা, গুগ্ল, অ্যামাজন জাতীয় বিপুলায়তন সংস্থা ইতিমধ্যে তথ্য-ব্যবহার সংক্রান্ত জটিলতার মাঝে পড়ে অনেকের নজরে।
বিলটির মূলে যে-প্রয়াস প্রচ্ছন্ন, তা এই ধরনের কোম্পানিগুলোকে একটি অভিন্ন আইনবিধির মধ্যে নিয়ে আসা, যাতে ব্যক্তিগত তথ্যসমূহের অপপ্রয়োগ না হয়, তা নিশ্চিত করা। নিরবচ্ছিন্ন ট্রোলিং, হ্যাকিং, ডেটা থেফ্ট (তথ্যচুরি) ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে এমন বিধি যে একান্তভাবে প্রয়োজনীয়, তা আর আলাদাভাবে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। ‘ডেটা লোকালাইজেশন’ অর্থাৎ তথ্যের উৎস যেখানে, সেখানেই তা সীমিত রাখা, নিশ্চিত করার তাগিদও সুস্পষ্ট। ভারতীয় ডেটা ব্যবহারকারীর হাত ছাড়িয়ে তা যেন অন্যত্র চলে না যায় অনায়াসে, সরকারের মনোবাঞ্ছা তেমনই। বলা বাহুল্য, বহুজাতিক আন্তর্জাল—কেন্দ্রিক সংস্থার তাতে সায় না-থাকাই স্বাভাবিক।
এছাড়া ‘ডেটা মাফিয়া’ যাতে আপনার-আমার অনুমতি ছাড়া (‘হাতিয়ে’-র মতো চটুল শব্দ ব্যবহার করতে চাই না) আমাদের তথ্য নিজস্ব ব্যবসার কাজে না-লাগাতে পারে, তা দেখাও দরকার বলে সকলে মনে করেন। তাই সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জটি মাপে-বহরে কম নয়- বিশেষত, যেখানে ‘রাইট টু প্রিভেসি’ নিয়ে বাজার সরগরম করে রেখেছে নানা শ্রেণির অধিকারবোধ-সম্পন্ন মানুষ। অন্যদিকে এ-ও মনে রাখতে হবে, এই অধিকার-মনস্কতায় হাত পড়ায় কিছু বিতর্কিত ঘটনা ইতিমধ্যেই ঘটেছে। অজানা-অচেনা ডেটা মাফিয়াই যে এর মূলে, তা নয়। বরঞ্চ নেপথ্যে বিরাজমান বহুল-পরিচিত নাম- যেমন মেটা বা হোয়াটসঅ্যাপ বা টুইটার বা তাদেরই মতো টেক-দৈত্য।
সংক্ষেপে বলা যাক। মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ‘টুইটার’ সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে কোর্টে লড়েছে কনটেন্ট ‘ব্লক’ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে। হোয়াটসঅ্যাপ আবার এক কাঠি উপরে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে চ্যাটের উৎস খোঁজার পরিকল্পনা আটকাতে। খেয়াল করে দেখবেন, এই দুই অতি বৃহৎ কোম্পানিতেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ নয়। সামগ্রিকভাবে ডিজিটাল প্লেয়ারদের অনেকেই সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তার কারণ তাদের ব্যবসার উপর আইনি চাপের সম্ভাবনা, যার অনেকাংশই ‘প্রিভেসি’ সম্বন্ধীয়। ডিজিটাল সেক্টরে এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটি প্রবলভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ, তা ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ সংক্রান্ত। পুলিশ
তথা অন্য অনুসন্ধান করার এজেন্সি যদি গ্রাহকের পার্সোনাল ডেটা তলব করে, তখন তাদের কী করণীয়?
মনে করা যাক, কোনও সিকিউরিটি এজেন্সি আজ আপনার ট্যাক্স সংক্রান্ত রেকর্ড চেয়ে নিল। সার্বিক সরকারি পরিকাঠামোর মধ্যেই তথ্য অন্যত্র গেল, আপনি তখনই কিছু জানতে পারলেন না, পরে তার ফল অনুভূত হল। এ হল এক ধরনের ব্যবহার। অন্যদিকে ধরে নিন, আপনারই করা পেমেন্ট সংক্রান্ত ডেটা, যা বেসরকারি কোনও নির্দিষ্ট সংস্থাই কেবল জানে, ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি নেওয়ার চেষ্টা করল। তখন কি সেই সংস্থা না-জানিয়ে গোপন-থাকা তথ্য বণ্টন করতে পারবে? তা কি অধিকার লঙ্ঘনের সমান হবে? না কি বিশেষ ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে থাকা সত্যান্বেষীদের স্বার্থে আপনার তথ্য সহজলভ্য করে রাখার চেষ্টাই বড় হবে? এখানেই চলে আসে প্রোটেকশন এবং সেই সম্বন্ধীয় বিধি-নিষেধের কথা। চার বছর ধরে চেষ্টা করেও, সরকারি সর্বোচ্চ স্তরের চিন্তাভাবনা থমকে গিয়েছে। নতুন উদ্যমে নীতি তাই বলবৎ করতে হবে এবার।
এমনিতেই ডেটা নিয়ে উত্তেজনা কোনও হঠাৎ আকাশ থেকে পড়া প্রসঙ্গ নয়। বহুকাল ধরে বিভিন্ন দেশে অ্যাক্টিভিস্টরা প্রিভেসি নিয়ে সরব; অসাধু শ্রেণির দ্বারা ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার যাতে না হয়, সে-ব্যাপারে তাঁরা অনেক দিনই সতর্ক করছেন আমাদের। মানুষের স্বাধীনতা-রক্ষা এবং তথ্য অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, এই দুই বিপুল অ্যাজেন্ডা জনপরিসরে এখন প্রবলভাবে উপস্থিত।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সেই বহু-চর্চিত (বিতর্কিত তো বটেই) ‘টিকটক’-এর কথা। আমেরিকান কংগ্রেস পর্যন্ত এই চিনা সংস্থার তথ্য আহরণ এবং বণ্টনের ব্যাপারে সবিশেষ চিন্তিত। বিতর্কের কেন্দ্রে একটি নালিশ। টিকটক নাকি মার্কিন কনজিউমারদের ব্যক্তিগত তথ্য চিনে পাঠিয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক হ্যাঁ, সত্যিই তা ঘটেছে, নালিশটির সংগত কারণ আছে। যদি সামান্য কনজিউমার প্রেফারেন্স জাতীয় ডেটা হয়ে থাকে, তাহলেও রক্ষা ছিল। তবে যদি সেই তথ্যের মধ্যে আপনার ব্যাংকের খুঁটিনাটি থাকে, তাহলে? আপনি কি চাইবেন অন্য কোনও দেশের সরকার আপনার প্রত্যেকটি আর্থিক লেনদেনের হদিশ পেয়ে যাক? বা আপনি কোথায়, কোন ব্যবসা চালানোর জন্য কাকে টাকা দিচ্ছেন, তা বিদেশি শক্তি বুঝে ফেলুক।
আমরা সাইবার সিকিউরিটির অভাব বোধ করলে টেলিভিশনে তর্কাতর্কি জুড়ি বা হয়তো পার্লামেন্টে প্রশ্নও করি। আসলে, প্রসঙ্গটির বিস্তার এসব বাহি্যক ক্ষেত্রের বহু ঊর্ধ্বে। খোদ গণতন্ত্রের উপর আঘাত আসতে পারে যদি তথে্যর নিয়মনীতি ভাঙা হয়। আজ এমনই বলতে চাইছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। যেমন ধরুন ‘ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন’। তাদের মতে নতুন বিধি অনুযায়ী, সরকারি সংস্থা তো ছাড় পাবেই, ক্ষমতাশালী বেসরকারি ব্যবসাও কিছু ক্ষেত্রে উপরি সুবিধা ভোগ করবে। ভুগবে ছোট ব্যবসা তথা সাধারণ গ্রাহক। এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন আরও অনেক ডিজিটাল অধিকার সুরক্ষিত রাখার চ্যাম্পিয়নরা।
আপনি যদি ছোট ব্যবসাদার হন বা নিদেনপক্ষে সাধারণ মানুষ, তাহলে প্রিভেসির বিষয়টি ভাল করে অনুধাবন করুন। আপনার ব্যবসা বা অন্য কার্যকলাপ হয়তো সামাজিক মাধ্যম-নির্ভর বা অনলাইনে তথ্য আদানপ্রদান ভিত্তিক। প্রতিদিন, প্রায় নিয়ম করে যে ওয়েবসাইটগুলো দেখেন, সেখানে ‘Cookies’ দেখতে পান নিশ্চয়ই। আপনি কি জানেন এই কুকিজ ব্যবহার করে আপনার পরিচয় জানার চেষ্টা করা যেতে পারে? আপনি কী প্রেফার করেন, গ্রাহক হিসাবে কী ধরনের পরিষেবা আপনার মনঃপূত, মায় কিছু ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই অন্যের হাতে পড়তে পারে। আশঙ্কা হল, এই কুকিজে থাকা তথ্য কি আইনগতভাবে সুরক্ষিত? না হলে আপনার ডেটা প্রোফাইল অন্যের কাছে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়।
হ্যাঁ, কুকিজের সপক্ষে বলার মানুষও আছেন, মানতেই হবে। তাঁদের বক্তব্য পরিষ্কার- এর মাধ্যমে আপনার অভিজ্ঞতা হবে অনেক পার্সোনালাইজ্ড, সময়ও বাঁচবে তার সঙ্গে সঙ্গে। ইন্টারনেট সহজেই চিনতে পারবে আপনাকে। জগৎজোড়া জালের মধ্যে আমরা কোনও না কোনওভাবে আটকে। ভবিষ্যতে ডেটার পাহাড়ের চূড়ায় বসে থাকবে কতিপয় সংস্থা, পরাক্রমী কিছু ব্যক্তি। ‘ডেটা হ্যাভ’ এবং ‘ডেটা হ্যাভ নট’- এই দুই শ্রেণির যুদ্ধ চলবে নিরন্তর। তারই মধ্যে সলতে উসকে দেবে স্বার্থসন্ধানী এক জাতীয় মানুষ বা কর্পোরেট অর্গানাইজেশন। আর এ সমস্তর কেন্দ্রে থাকবে সর্বশেষ প্রশ্নটি- আমরা কি সত্যিই টুইটার-সহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম আটকাতে পারছি?
উল্লেখ্য, গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কনটেন্ট ব্লকিং নিয়ে জলঘোলা হয়েছে, দেশে আরও শক্তপোক্ত সাইবার সিকিউরিটি নীতি আনার ব্যাপারে গলা ছেড়েছেন অনেকে। তথ্যমন্ত্রক চেয়েছে, সমস্ত প্লেয়ার যেন ভারতের মধ্যে অভিন্ন নিয়ম মেনে চলে, তা তারা যে দেশেরই হোক না কেন। টুইটার বা ওই ধরনের প্ল্যাটফর্মের মতে, যথাযথ ডেটা প্রোটেকশনের আইন নেই আজও, তাই তাদের নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত থাকছে না। মাঝখানে পড়ে রয়েছেন অগণিত ‘কমন ম্যান’। এঁরা প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন, ইউটিউবে ব্যাকুল হয়ে পড়েন, অফিসে-কাছারিতে বসে ইমেল করে গূঢ় তথ্য সর্বত্র পাঠান। জলখাবার খেতে খেতে হ্যাকিং না হয়, সে বিষয়ে চিন্তাও করেন। কিন্তু আদপে যে তাঁরা কতখানি অসুরক্ষিত, তা বুঝেও বোঝেন না। যেখানে রেস্তেরঁায় একটি খাবার অর্ডার দিলে অন্যটি ফ্রি পাওয়া যাবে- এমন পোস্টের প্রলোভনের জন্য হ্যাকিংয়ের শিকার হন মানুষ, সেখানে প্রতিদিন সাইবার ক্রাইম হয়ে চলে। ‘ফিশিং’ সম্বন্ধে রেগুলেটরদের হাজার সতর্কবাণী কাজে লাগে না, অজানা অ্যাপ ডাউনলোড এবং ভুল লিঙ্কে আঙুল ছোঁয়ানো, দুই-ই সমানভাবে চলে। সামাজিক মাধ্যমে শুধুমাত্র আপনার জন্যই যেন কাস্টমাইজ্ড হোটেলের বিজ্ঞাপন আসছে- এমন আষাঢ়ে ব্যাপার দেখেও আপনি যদি না দেখেন, তাহলে দোষ কার? ঠিক সেভাবেই, কেন বর্ষীয়ান অভিনেতা ট্রোল্ড হোন কিংবা উদীয়মান রাজনৈতিক তারকা কেন হেট পোস্টের কেন্দ্রে থাকেন, সেসবও বুঝতে হবে ঠিক করে। নিজেকে অনুশাসিত রাখা যেমন জরুরি, দেশকে সুরক্ষার বলয়ের মধ্যে ফেলাও একইভাবে আবশ্যিক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.