পঞ্চমবার শিবির বদল করে এবং নবমবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিয়ে নীতীশ কুমার প্রতিজ্ঞা করেছেন, আর তিনি জোট বদলাবেন না। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যে কিছু হয় না, সেটা নীতীশ নিজেই বারবার প্রমাণ করে চলেছেন। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
গত দু’-দশকে বিহারে পাঁচবার সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী থেকে গিয়েছেন নীতীশ কুমারই (Nitish Kumar)। ভারতীয় রাজনীতিতে এটা একটা বিরল ঘটনা। মাঝে অল্প কয়েক মাসের জন্য জিতনরাম মাঝি পাটনার মসনদে বসতে পারলেও পাঁচটি সরকারের মাথাই থেকে গিয়েছেন নীতীশ। এর মধ্যে দু’টি সরকার বিজেপি-বিরোধী মহাজোটের এবং তিনটি সরকার এনডিএ-র, যার অন্যতম শরিক বিজেপি। নীতীশ কুমার ক্ষমতায় টিকে থাকার এই অনবদ্য কৌশলটি কীভাবে রপ্ত করেছেন, তা নিয়ে বিস্তর চর্চা শুরু হয়েছে ভারতীয় রাজনীতিতে।
সার্কাসে যাঁরা ট্রাপিজের খেলা দেখান, তাঁদের মতোই দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন নীতীশ। ২০ বছর ধরে একটি ডাল থেকে আরেকটি ডালে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর পতন হয়নি। এইরকম ট্রাপিজের খেলা দেখিয়ে আরও কত দিন নীতীশ পাটনার কুর্সিতে থাকতে সক্ষম হবেন, তা নিয়েও চলছে জল্পনা।
সাতের দশকে ‘জরুরি অবস্থা’-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিহারের রাজনীতিতে লালুপ্রসাদ যাদবের সঙ্গেই উত্থান নীতীশের। গোড়ায় বিহার রাজনীতিতে লালু-নীতীশ ছিলেন লালু-ভুলুর মতোই একটা জুড়ি। লালু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নীতীশের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়ে। একটা সময় লালু ও নীতীশ বিহার রাজনীতির দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান। নীতীশ যোগ দেন জর্জ ফার্নান্ডেজের সমতা পার্টিতে। সেসময় প্রাক্তন সমাজবাদী নীতীশের মূল লক্ষ্যই ছিল বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে কোনও উপায়ে লালুকে বিহারের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা।
লালুর আমলে যে-বিহারে ‘জঙ্গল রাজ’ প্রতিষ্ঠিত ছিল, সে-কথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হয় না। যাদব-সহ কয়েকটি নিম্নবর্গের গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ছাড়া লালু যাদবের আমলে বিহারে কোনও ইতিবাচক কাজ কিছু হয়েছে বলে কোনও সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন না। লালুর আমলে গোটা বিহার জুড়ে সড়ক বলে কিছু ছিল না। পাটনার বাইরে অন্যত্র বিদ্যুৎ ছিল না-থাকার মতোই। সন্ধের পর গোটা রাজ্যে লো-ভোল্টেজে টিমটিম করে আলো জ্বলত। বড় বড় রেল স্টেশনও ডুবে থাকত গভীর অন্ধকারে। আইনশৃঙ্খলার হাল ছিল ভয়াবহ। রাজধানী পাটনা শহরে বিকেলের কোনও রাস্তা নিরাপদ ছিল না। অপহরণ ছিল রোজকার ঘটনা। এর সঙ্গে ছিল লালুর দুই শ্যালকের নেতৃত্বে গুন্ডা-মাফিয়াদের অত্যাচার। লালুকন্যাদের বিয়েকে ঘিরে পাটনার অরাজক পরিস্থিতির কাহিনি এখনও গোটা বিহারে লোকের মুখে মুখে ঘোরে।
২০০৫-এ দ্বিতীয় দফার বিধানসভা নির্বাচনে নীতীশের নেতৃত্বে লালু সরকারের পতনের পর বিহার জুড়ে পরিস্থিতি বদলের প্রত্যাশা ছিল প্রবল। এ-বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে, নীতীশ বিহারবাসীর প্রত্যাশা পূরণে অনেকটাই সফল হতে পেরেছিলেন। সে-কারণে রাজ্যবাসী তাঁর নাম দিয়েছিল ‘সুশাসনবাবু’। সেসময় নীতীশের এই নামকরণে অবশ্যই কোনও অত্যুক্তি ছিল না। ২০১০-এ বিহার বিধানসভা ভোটে নীতীশকে দু’হাত উজাড় করে সমর্থন দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল বিহারবাসী। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় নীতীশের দল একাই জিতেছিল ১১৫টি আসন। সঙ্গী বিজেপি পেয়েছিল ৯১টি আসন। দুই দল মিলিয়ে জিতেছিল প্রায় ৯০ শতাংশ আসন। দেশের কোনও বড় রাজ্যেই ক্ষমতাসীন জোটের এইরকম প্রায় ৯০ শতাংশ আসন জিতে প্রত্যাবর্তনের নজির নেই।
২০১০-এর বিপুল জয় আবার বিহারে নীতীশ ও বিজেপির রসায়নেও গন্ডগোল তৈরি করে। সাফল্যটা যে শুধু ‘সুশাসনবাবু’-র, তা মানতে বিজেপির সমস্যা ছিল। নীতীশের প্রশাসনিক সাফল্যের মূলে যে তারাই, সেটা বিজেপি প্রচারে আনতে শুরু করে। অন্যদিকে গুজরাটের দাঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন নীতীশ। ২০১০-এর বিধানসভা ভোটে ওইরকম বিপুল সাফল্যের পর ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে একা লড়ে রাজ্যের ৪০টি আসনের মধ্যে মাত্র দু’টিতে জয় পায় নীতীশের দল। পরাজয়ের দায়িত্ব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে নীতীশ চেয়ারে বসান তাঁর অনুগত জিতনরাম মাঝিকে। কয়েক মাসে মধ্যেই জিতনরামকে সরিয়ে নীতীশ ফের নিজেই কুর্সিতে বসেন এবং লালুর দল আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে ২০১৫-র বিধানসভা ভোট লড়েন। ২০১৫-র বিধানসভা ভোটে লালুর দলের চেয়ে ন’টি আসন কম পায় নীতীশের জেডিইউ। তবু মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে ফের বসেন নীতীশই। ২০১৭-য় আচমকাই লালুপুত্র তেজস্বীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নীতীশ আবার বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান। এবারও পাটনার সরকারের রং বদলালেও মুখ্যমন্ত্রীর পদেই থেকে যান নীতীশ।
২০১৭-য় নীতীশের পদক্ষেপ যে খুব ভুল ছিল না, তা প্রমাণিত হয়েছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটেই। বিহারের ৪০টি আসনের মধ্যে ৩৯টি জেতে এনডিএ। কিন্তু একবছর বাদেই ২০২০-তে বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে থেকে বিহারের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়ে যান নীতীশ। এক্ষেত্রে যে মূল ভূমিকা বিজেপিরই ছিল, তা নিয়ে সংশয় নেই। নীতীশের দল বিধানসভা ভোটে যে ১২৫টি আসনে লড়েছিল, তার সবেতেই বিজেপি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র চিরাগের দলকে। চিরাগের লোক জনশক্তি পার্টি অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি আসনে ভোট কেটে নীতীশের দলের পরাজয় সুনিশ্চিত করে। জোটসঙ্গী বিজেপির বিশ্বাসঘাতকতায় তৃতীয় শক্তি তথা মাত্র ৪৩ বিধায়কের দলে পরিণত হয়েও নীতীশ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ধরে রাখেন। একই সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করতে থাকেন যে, বিজেপি তাঁকে রাজনৈতিকভাবে গিলে খেতে চাইছে। যেটা বিজেপি তার সমস্ত শরিকের সঙ্গেই করেছে। এই উপলব্ধি থেকেই ২০২২-এ হঠাৎ করেই নীতীশ ফের বিহারের সরকারের রং বদলে দেন। নীতীশের হাত ধরে ক্ষমতায় ফেরেন তেজস্বী যাদবরা। ঠিক ১৭ মাস বাদে আরও একটি লোকসভা ভোটের মুখে আবার নীতীশের রং বদল। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, তেজস্বীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার খোয়ানোর আশঙ্কা থেকেই আবার বিজেপির হাত ধরলেন নীতীশ।
পঞ্চমবার শিবির বদল করে এবং নবমবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিয়ে নীতীশ প্রতিজ্ঞা করেছেন, আর তিনি জোট বদলাবেন না। নীতীশের মুখের কথাকে আক্ষরিক অর্থে ধরার কোনও প্রয়োজনই নেই। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে যে কিছু হয় না, সেটা নীতীশ নিজেই বারবার প্রমাণ করে চলেছেন। রাজনৈতিক কৌশলীরা বলছেন, ফের বিজেপির হাত ধরে ভুল করলেন নীতীশ। কিন্তু এই বাস্তবটা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই যে, তেজস্বীর হাত থেকে কুর্সি বঁাচাতে এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে নীতীশের কাছে আর কোনও বিকল্প ছিল না। লোকসভা ভোটের ফলের পর বোঝা যাবে নীতীশ কতটা সঠিক। যদি বিজেপির হাত ধরে নীতীশ লোকসভা ভোটে প্রাসঙ্গিত থাকতে পারেন, তাহলে হয়তো তঁার এই নীতিহীন রাজনীতি নিয়ে আর প্রশ্ন উঠবে না। ক্ষমতায় থাকতে ২০২৫-এর বিধানসভা ভোটে তিনি কী কৌশল নেন, তখন সেইদিকে সবাইকে নজর দিতে হবে।
রামবিলাস পাসোয়ানকে দেশের রাজনীতি মনে রেখেছে একজন দক্ষ ‘হাওয়া মোরগ’ হিসাবে। প্রায় সারা জীবনই তিনি তঁার পাসোয়ান ভোট-ব্যাঙ্ককে পুঁজি করে বিভিন্ন সরকারে মন্ত্রী থেকে গিয়েছেন। নীতীশ কুমার বিহারের তিন শতাংশ কুরমি ভোটকে ভরসা করে রাজনীতির সার্কাসে ট্রাপিজের খেলায় যে দক্ষতা দেখাচ্ছেন, তার জন্য কিন্তু কিছু বাহবাও দাবি করেন। তঁার গায়ে শুধু ‘পাল্টি কুমার’ তকমা লাগিয়ে দিলেই সুবিচার হবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.