ফাইল চিত্র
‘পরস্পরের মধ্যে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও নিখিল ভারতীয় কাজে বাঙ্গালির নাম লুপ্ত দেখতে আমরা চাইনি।’ যুগপৎ আক্ষেপ ও আশা নিয়ে এই কথাটি লিখেছিলেন নেতাজি। সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিনে তাঁরই একটি রচনার পুনর্মুদ্রণ রইল। সৌজন্য: নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো।
আমি আজ একটা খুব বড়ো দুঃখের কথা বলবার জন্য কলম ধরেছি। এ দুঃখটা হয়তো অনেকের কাছে কাল্পনিক– কিন্তু আমার ক্ষুদ্র প্রাণের পক্ষে এ দুঃখটা সত্য ও গভীর।
গয়াতে নিখিল ভারতীয় রাষ্ট্র সমিতির অধিবেশনে কার্যকরী সমিতি (Working Committee) গঠনের কথা যখন উত্থাপিত হয়, তখন বাঙ্গলা দেশ থেকে কাকে নির্বাচন করা হবে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। পূর্বরীতি অনুসারে যে প্রদেশের লোক সভাপতি হয় সেই প্রদেশ থেকে অন্তত পক্ষে একজন সম্পাদক হবার কথা। শ্রীযুক্ত সেনগুপ্ত ও শাসমলের নাম সম্পাদক পদের জন্য প্রস্তাবিত হয়, কিন্তু তাঁরা ওই পদ গ্রহণ করতে রাজি হন না। তারপর বাঙ্গলা দেশের পরিবর্তনবিরোধীদের (No Changer) মধ্য কাহাকেও সম্পাদক করা হয় না।
পরিবর্তনবিরোধীগণও এ বিষয়ে এতদূর নিশ্চেষ্ট ও নিরপেক্ষ ছিলেন যে কার্যকরী সমিতিতে একজন বাঙ্গালিও সভ্যরূপে নির্বাচিত হন না। তার ফলে পরিবর্তনবিরোধীদের দলে নিখিল ভারতীয় কাজে বাঙ্গালির এখন কোনও স্থানই নাই। ব্যাপারটা দেখে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হই। আমাদের পরস্পরের মধ্যে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও নিখিল ভারতীয় কাজে বাঙ্গালির নাম লুপ্ত দেখতে আমরা চাইনি। বাঙ্গলা দেশে কি এমন কোনো সভ্য ছিলেন না যিনি কার্যকরী সমিতির সভ্য হবার উপযুক্ত বা যিনি ওই সমিতির সভ্য হতে পারতেন? যদি ছিলেন, তবে পরিবর্তনবিরোধীগণ তাঁকে উপেক্ষা করে নিজেদের এবং বাঙ্গালি জাতির মর্যাদাহানি ঘটালেন কেন? যদি এমন কোনো ব্যক্তি না ছিলেন, তবে এই দল কোন সাহসে দেশবন্ধুর মতো নেতার বিরুদ্ধাচারণ করে বাঙ্গলাদেশে কংগ্রেসের কাজ চালাবার ভরসা করেছিলেন? যে নিখিল ভারতীয় কার্যকরী সমিতিতে এক সময় বাঙ্গালির গৌরবময় স্থান ছিল, সেই সমিতিতে আজ একজন বাঙ্গালিও নাই। বাঙ্গালির এই অধঃপতনের জন্য কি পরিবর্তনবিরোধীগণ দায়ী নন!
ভূতপূর্ব আইন ব্যবসায়ীদের সাহায্যকল্পে শ্রীযুক্ত যমুনালাল বাজাজের টাকাতে একটা ‘ফন্ড’ করা হয়; সেই ‘ফন্ডের’ নাম দেওয়া হয় ‘বাজাজ ফন্ড’ (কংগ্রেস ফন্ড বা তিলক স্বরাজ্য ফন্ড নয়)। এই সাহায্য বিতরণের জন্য প্রত্যেক প্রদেশ থেকে একজন লোক মনোনীত হন। বাঙ্গলার ভার শ্রীযুক্ত সেনগুপ্তের উপর অর্পিত হয়। সেনগুপ্ত মহাশয় যখন ওই পদ ত্যাগ করেন, তখন পরিবর্তন-বিরোধীদের দলে এমন একজন লোক পাওয়া গেল না যিনি ওই ভার গ্রহণ করতে পারেন। প্রায় প্রত্যেক প্রদেশে লোক পাওয়া গেল কিন্তু বাঙ্গলার ভাগ্যবিধাতা হলেন শ্রীযুক্ত যমুনালাল বাজাজ। সাহায্য বিতরণের প্রণালিতে আত্মসম্মানে আঘাত লাগে বলে কয়েকজন অসহযোগী উকিল সাহায্য নেওয়া বন্ধ করলেন। কিন্তু পরের চাকরি করলে বা ইংরেজের আদালতে উকিল হলে মানুষ স্বালবম্বী হতে পারে না বলে যাঁরা একদিন অসহযোগ ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেক কর্মী শ্রীযুক্ত বাজাজের দেওয়া টাকা হাত পেতে নিলেন।
গয়া কংগ্রেসের পর পরিবর্তন-বিরোধীগণ কোমর বেঁধে কাজ আরম্ভ করেন, কিন্তু বেশিদূর অগ্রসর হতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সুদূর তামিল প্রদেশ, গুজরাট, যুক্তপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে নেতৃবর্গকে ডেকে এনে বাঙ্গলা দেশের প্রচারকার্য চালাতে হল। বোধকরি পরিবর্তন-বিরোধীদের এমন সামর্থ্য ছিল না যে তাঁরা নিজেদের শক্তির বলে কাজটা করেন। অ-বাঙ্গালি নেতারা যে টাকা তুললেন তা প্রধানত অ-বাঙ্গালিদের কাছ থেকে। বঙ্গবাসীরা এই প্রচারকার্যের প্রহসন দেখে হাসতে লাগলেন। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন– “Stands Bengal where she was?”
অধঃপতনের শেষ এখনও হয়নি। বাঙ্গালির কাছে আর কুমিল্লার তুলোর আদর নেই। বেশি দর দিয়ে দেড় টাকা সের হিসাবে ওয়ার্দা থেকে তুলো আনতে হবে, কারণ ওয়ার্দার তুলোর মালিক শ্রীযুক্ত যমুনালাল বাজাজ এখন বাঙ্গলার– শুধু বাঙ্গলার কেন, সমগ্র ভারতের ভাগ্যবিধাতা। শ্রীযুক্ত বাজাজের তুলো আমরা বেশি দাম দিয়ে ক্রয় করি– তাঁর দেওয়া টাকা আমরা দানস্বরূপ গ্রহণ করি। এরপর যদি তাঁর গুণ গাইতে আমরা আরম্ভ করি– তবে সে অপরাধ কি আমাদের?
সেদিন কাগজে দেখলাম নিখিল ভারতীয় কার্যকরী সমিতি থেকে বাঙ্গলা দেশের কয়েকটা প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা হয়েছে। আমরা এতদিন জানতাম সাহায্য বিতরণের ভার বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্র সমিতির উপর ন্যস্ত আছে। কার্যকরী সমিতি তাঁদের দেয় টাকা প্রাদেশিক সমিতির হাতে দিলে প্রাদেশিক সমিতি ওই টাকা ব্যক্তিবিশেষকে বা প্রতিষ্ঠান বিশেষকে ভাগ করে দিবেন। কিন্তু এখন দেখছি বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্র সমিতির ন্যায্য অধিকার কার্যকরী সমিতি আর মানতে চান না। কার্যকরী সমিতিতে একজন বাঙ্গালি সভ্যও নাই যে এই বিষয়ে কোনোরূপ প্রতিবাদ করেন। ফলে দাঁড়াচ্ছে এই যে পরিবর্তন-বিরোধীদের কৃপায় নিখিল ভারতে আজ বাঙ্গালির কোনো স্থান নাই।
কার্যকরী সমিতি বাঙ্গলা দেশের কর্মীদের সাহায্যের নিমিত্ত চৌদ্দ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছেন। এই টাকা বিতরণ করবেন শ্রীযুক্ত প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্র সমিতির বা ওই সমিতির সভাপতির এ বিষয়ে কোনও হাত নাই। পরিবর্তন-বিরোধীদের মধ্যে গণতন্ত্রবাদের যে সব পুরোহিত আছেন তাঁরা গণতন্ত্রের এরূপ বিচিত্র অভিনয় দেখে কী মনে করেছেন তা আমরা বলতে পারি না। এই চৌদ্দ হাজার টাকা ব্যয়ের ভার যে শ্রীযুক্ত প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের হাতে ন্যস্ত হয়েছে এবং এ বিষয়ে যে অন্য কাহারও অধিকার নাই এ কথা প্রফুল্লবাবু বরিশালে জনসভায় বলেছেন।
একদিন মনে হত শ্রীযুক্ত রাজাগোপালচারি ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট। কিন্তু সে দিন ঘুচে গেছে। অল্পদিন পূর্বে দিল্লিতে মিটমাটের একটা প্রস্তাব হয়। সেখানে শ্রীযুক্ত রাজাগোপালচারি, মোয়াজ্জেম আলি, আনসার মাহমুদ ও শ্রীযুক্তা সরোজিনী নাইডু সম্মত হয়ে বলেন যে কংগ্রেসের তরফ থেকে কাউন্সিলে প্রবেশ করা যেতে পারে। মিটমাট এক রকম হয়ে গেছল শুধু শ্রীযমুনালাল বাজাজ ও বল্লভভাই প্যাটেলের মত নেওয়া হয়নি। রাজাগোপালচারি মহাশয় বোম্বাইয়ের দিকে রওনা হলেন তাঁদের মত জানবার জন্য। কিন্তু শ্রীযুক্ত প্যাটেল ও বাজাজ রাজি হলেন না বলে মিটমাট আর সম্ভব হল না। এখন অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে তেত্রিশ কোটি নরনারীর সুখ দুঃখ নির্ভর করছে শ্রীযুক্ত বাজাজ ও প্যাটেলের উপর।
অধঃপতন আর কতদূর গড়াবে তা শুধু ভগবানই জানেন। বাঙ্গালি নিজেকে সস্তা দরে বিক্রয় করে একগালে চুন আর একগালে কালি মেখে বসে আছে। বাঙ্গালির অধঃপতন চরমে পৌঁছতে কত দেরি আছে তা আমরা জানি না। কে জানে কত দুঃখ, কত লজ্জা বাঙ্গালির কপালে আছে? তার এখনও সময় আছে, প্রতিকার করবার। বাঙ্গালির গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হবে। নিখিল ভারতীয় কাজে বাঙ্গালির যে স্থান ছিল সে স্থান ফিরে পেতে হবে। পরিবর্তন-বিরোধীরা বাঙ্গালির নাম ভারতের সম্মুখে কলঙ্কিত করেছেন, এ কলঙ্ক আমাদের ঘোচাতে হবে। ভারতকে যেমন বাঁচাতে হবে, বাঙ্গলার নামও সেরূপ চিরকালের জন্য উজ্জ্বল রাখতে হবে। বাঙ্গলার নষ্ট খ্যাতি ও লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের কাজে যিনি সহায়তা করবেন বাঙ্গালি তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
[উৎস ২৫ মে, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩০) ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত। ‘বঙ্গদর্পণ ২’ বই থেকে পুনর্মুদ্রিত। (বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত। নামকরণ সম্পাদকীয় দপ্তরের)]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.