Advertisement
Advertisement

Breaking News

Chandrayaan 3

শেষে চাঁদও কিনা হিন্দু রাষ্ট্র

আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র ছাড়াই ল্যান্ডারের চন্দ্রপৃষ্ঠ ছোঁয়ার বিন্দুটির নাম করা হয়েছে 'শিবশক্তি'।

Hindutva politics is becoming more prominent around successful Chandrayaan 3 mission। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:August 29, 2023 2:37 pm
  • Updated:August 29, 2023 2:37 pm  

আসন্ন লোকসভা ভোটে ইসরোর সফল চন্দ্রাভিযান ঘিরে হিন্দুত্বের রাজনীতি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে বিক্রম ল‌্যান্ডারের চন্দ্রপৃষ্ঠে ছোঁয়ার বিন্দুটির ‘শিবশক্তি’ নামকরণে। কিন্তু তা হল ‘ইন্টারন‌্যাশনাল অ‌্যাস্ট্রোনমিক‌্যাল ইউনিয়ন’-এর ছাড়পত্র ব্যতীত! অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের তরফে ‘শিবশক্তি পয়েন্ট’-কে চাঁদের রাজধানী ও চাঁদকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণার দাবি উঠেছে! লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

ভবিষ‌্যতে কোনও একসময় কি চাঁদে ‘শিবশক্তি পয়েন্ট’-টি ধর্মতলার মতো জনপ্রিয় হবে? হিন্দু মহাসভার নেতা ও স্বঘোষিত ধর্মগুরু চক্রপাণি অবশ‌্য দাবি করেছেন, নরেন্দ্র মোদি নামাঙ্কিত ‘শিবশক্তি পয়েন্ট’-টি হবে চঁাদের রাজধানী। ধর্মগুরুর আরও প্রস্তাব, ‘চঁাদকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে হবে।’

Advertisement

লোকসভা ভোটে ইসরো-র সফল চন্দ্রাভিযানকে যে নরেন্দ্র মোদি হাতিয়ার করবেন, তা একটি শিশুর বোধগম‌্য হলেও, সেটি যে এভাবে হিন্দুত্ব প্রচারেরও অস্ত্র হয়ে উঠবে, সাধারণের ধারণায় ছিল না। বেঙ্গালুরুতে ‘ইসরো’-র দফতরে দঁাড়িয়ে বিক্রম ল‌্যান্ডারের চন্দ্রপৃষ্ঠে স্পর্শবিন্দুটির নামকরণ করতে গিয়ে মোদির ব‌্যাখ‌্যা ছিল– ‘শিব’ মানে শুভ এবং ‘শক্তি’ হল নারীশক্তির প্রতীক। ইসরোর প্রমীলা বাহিনীকে মোদি অালাদা করে স্বীকৃতিও দেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধে‌্যই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতার বয়ানে স্পষ্ট হল, বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকেও হিন্দুত্বের মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রযানের চন্দ্রপৃষ্ঠ ছোঁয়ার আগেই দেশবাসীকে সতর্ক করে মমতা বন্দে‌্যাপাধ‌্যায় বলেছিলেন, ‘এটা বিজ্ঞানীদের সাফল‌্য হতে চলেছে। কোনও রাজনীতিবিদ যেন কৃতিত্ব না নেওয়ার চেষ্টা করেন।’ বিক্রম ল‌্যান্ডারের চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের সম্প্রচারের সময় থেকেই দেখা গেল, সামগ্রিক কৃতিত্বটা ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের শাসক দল কতটা মরিয়া।

[আরও পড়ুন: যোগীরাজ্যে নৃশংসতা! আবাসনের তরুণী রক্ষীকে গণধর্ষণ করে হত্যায় অভিযুক্ত ৩ সহকর্মী]

ইসরোর তরফে অ‌্যানিমেশনের মাধ‌্যমে চন্দ্রাবতরণের যে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, তাতে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যুক্ত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুধু ইসরোর ইউটিউব চ‌্যানেলে সেই সময় সরাসরি সম্প্রচারে যুক্ত হয়েছিলেন ৮০ লক্ষ মানুষ। কয়েক ঘণ্টার মধে‌্য ইসরোর ইউটিউব চ‌্যানেলের দর্শক সংখ‌্যা পৌঁছয় আড়াই কোটিতে। কোনও বৈজ্ঞানিক ঘটনার এত বিশাল দর্শকসংখ‌্যা স্রেফ অকল্পনীয়। এই দর্শকের সিংহভাগ যে তরুণ প্রজন্মের, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ৫৪ বছর আগে চঁাদে নিল আর্মস্ট্রংয়ের পা দেওয়ার সময় ‘অ‌্যাপোলো ১১’ মিশন ঘিরে আমেরিকায় মানুষের মধে‌্য যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল, এবারের চন্দ্রযান ঘিরে ভারতবাসীর উৎসাহ ও উদ্দীপনা তার সঙ্গে তুলনীয়। এরকম একটি ইভেন্টকে অামাদের মতো দেশে যে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব‌্যবহার করা হবে না, তা ভাবা-ই অমূলক। মোদি তঁার ভাষণ-ক্ষমতা দিয়ে সংক্ষিপ্ত ইভেন্টটিকে কাজে লাগানোর জন‌্য যা করার, তা করেছেন। ‘ব্রিকস’-এর মতো অান্তর্জাতিক মঞ্চকে পেয়ে যাওয়ায় তঁার অারও সুবিধাই হয়েছে।

গ্রিসের মাটি থেকে কাকভোরে সটান বেঙ্গালুরুর ইসরোর দফতরে হাজির হয়ে মোদি দ্বিতীয় চমকটি দেন। ‘জয় বিজ্ঞান, জয় অনুসন্ধান’ স্লোগানটি দেওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল চমক। কিন্তু সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় বিক্রম ল‌্যান্ডারের চন্দ্রপৃষ্ঠে ছোঁয়ার বিন্দুটির ‘শিবশক্তি’ নামকরণে। এই নামকরণের সঙ্গে যে হিন্দুত্বের আবেগকে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে, তা বেঅাবরু হল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতার মন্তবে‌্য। চঁাদকে ঘিরে কল্পবিজ্ঞান হয়তো ধীরে ধীরে বাস্তব হচ্ছে। অ‌্যাপোলো মিশন শেষ হওয়ার দীর্ঘ পঁাচ দশক বাদে আমেরিকা চঁাদকে ঘিরে ফের শুরু করেছে ‘আর্টেমিস মিশন’। এই মিশনে আগামী দু’-তিন বছরের মধে‌্য চঁাদে প্রথম মহিলা-সহ বহু মানুষ গিয়ে হাজির হবে। সেখানে যে গবেষণাগার নাসা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে, সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে নভশ্চররা থাকবেন।

[আরও পড়ুন: চিনের ম্যাপে অরুণাচল-আকসাই চিন, মোদি-জিনপিং বৈঠকের আগেই সংঘাতের সুর]

কালক্রমে হয়তো চঁাদ থেকে পৃথিবীতে ফেরার জন‌্য রকেট উৎক্ষেপণেরও ব‌্যবস্থা তৈরি হবে। বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, আগামী ৫০ বছরের মধে‌্য চঁাদ ও পৃথিবীর মধে‌্য নিয়মিত রকেট চলাচলও শুরু হয়ে যেতে পারে।

চঁাদ ও পৃথিবীর মধে‌্য রকেট সংযোগ স্থাপিত হলে চঁাদে যে বসতি স্থাপন হবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। সেক্ষেত্রে কে বলতে পারে যে, ‘শিবশক্তি’ পয়েন্টটি চঁাদে ধর্মতলার মতোই একটি জনপ্রিয় স্থান হয়ে যাবে না? চঁাদে জল কী রূপে রয়েছে, তা নিয়ে এখন অনুসন্ধান চলছে। ভবিষ‌্যতে চঁাদে মানববসতি গড়ে তুলতে জলের জোগান প্রয়োজন। চঁাদের বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। মানুষের জন‌্য অক্সিজেনের জোগানও দরকার। অদূরভবিষ‌্যতে বিজ্ঞান এগুলির বন্দোবস্ত করতে পারবে কি না, তা এখনই বলে দেওয়া সম্ভব নয়। বিক্রম ল‌্যান্ডারের পে-লোড প্রাথমিকভাবে চঁাদের দক্ষিণ মেরুর মাটির তাপমাত্রা সম্পর্কে যে তথ‌্য দিয়েছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের।

এই তাপমাত্রা ৭০ থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। অতএব, জল-হাওয়াহীন প্রতিকূল পরিবেশে চঁাদে যদি ভবিষ‌্যতে মানববসতি গড়ে তোলা সম্ভব না-ই হয়, তাহলে চন্দ্রযানের সাফল‌্য নিয়ে এত মাতামাতি কেন? বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতাটি যেন ভোটের আগে সেই প্রশ্ন তুলতে দিতে নারাজ। তাই আগেভাগেই বলে রেখেছেন, রাষ্ট্র সংঘে প্রস্তাব এনে চঁাদে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এখন থেকেই চালাতে হবে।

লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে, তত নরেন্দ্র মোদি ও সংঘ পরিবারের প্রচারের রণকৌশল বোঝা যাবে। কিন্তু চন্দ্রবিজয়কে ঘিরে যে মোদি বাহিনীর তরফে নানা স্তরে অাবেগের জন্ম দেওয়ার চেষ্টা হবে, সেটা ধরে নিয়ে কংগ্রেসও পাল্টা প্রচারে নেমেছে। দেশে মহাকাশ গবেষণা যে জওহরলাল নেহরুর উৎসাহে বিক্রম সারাভাই শুরু করেছিলেন, সে-কথা কংগ্রেস বারবার মনে করিয়ে দিতে চাইছে। ১৯৬২ সালে নেহরুর সহযোগিতাতেই বিক্রম সারাভাই ‘ইন্ডিয়ান ন‌্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সোশ‌্যাল মিডিয়ায় কংগ্রেসকে জবাব দিতে বিজেপির আইটি সেল ছবি দিয়ে প্রচার চালাচ্ছে, ১৯৬২ সালে জওহরলাল নেহরু যখন সরকারি বিমানে করে তঁার পোষ‌্যর চিকিৎসা করাতে যেতেন, তখন মহাকাশ গবেষণার কর্মীদের রকেটের যন্ত্রাংশ এক জায়গা থেকে অন‌্য জায়গায় নিয়ে যেতে হত সাইকেলের কেরিয়ারে চাপিয়ে। কংগ্রেসের তরফে হাতিয়ার করা হচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় রাকেশ শর্মার মহাকাশযাত্রাকে। মহাকাশযানের ভিতর থেকে রাকেশ শর্মা কথা বলছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। সেদিনের সেই ভিডিও গত কয়েক দিনে ছেয়ে গিয়েছে সোশ‌্যাল মিডিয়ায়।

একদিকে নাসার অার্টেমিস মিশন ঘিরে ক্রমবর্ধমান কৌতূহল ও উৎসাহ, অন‌্যদিকে পঁাচ দশক পর রাশিয়ার ‘লুনা’ মিশন নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা, এই অাবহে ইসরোর চন্দ্রযানের সাফল‌্য নিঃসন্দেহে তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞান সাধনায় উৎসাহ জোগাবে। এবার ভোটের অাগে তার সঙ্গে যদি সংঘ পরিবার হিন্দুত্বের মেলবন্ধন করার চেষ্টা করে, তাহলে প্রচারের এই নয়া ককটেল অন‌্য সব ইসু‌্যকে পিছনে ফেলতে পারে। চঁাদের কোনও অংশের নামকরণের ক্ষেত্রে ‘ইন্টারন‌্যাশনাল অ‌্যাস্ট্রোনমিক‌্যাল ইউনিয়ন’-এর ছাড়পত্র নিতে হয়। সেই ছাড়পত্র ছাড়াই ‘শিবশক্তি’ নামকরণ হয়েছে। ভোটের প্রচারে সেটাও বিতর্কের এক নতুন ইন্ধন জোগাবে। অার এর মধে‌্য ‘অাইএইউ’ যদি ‘শিবশক্তি’ নামে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়, তাহলে সেটাও সংঘ পরিবার প্রচারে হাতিয়ার বানাতে ছাড়বে না। সর্বশক্তিমান মোদি, হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগ– এই তিনের মিশ্রণই ভোটের আগে ভরসা সংঘ পরিবার তথা বিজেপির। চন্দ্রাভিযানের সাফল‌্য প্রচারে সেই মিশ্রণই চাইছে তারা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement