সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক চলছে। যে-কারণে হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়তে চায়, মুসলিম ধর্মস্থান বা ঐতিহাসিক স্তম্ভের নিচে হিন্দু স্থাপত্য খুঁজে বের করতে চায়, তারই সম্প্রসারণ– ওয়াকফ সম্পত্তির দখল। এর নেপথ্যে আছে ‘গৌরবময় হিন্দু অধ্যায়’ ফেরানোর সর্বান্তঃকরণ চেষ্টা। লিখছেন সৈয়দ তানভির নাসরীন।
‘গুড কনডাক্ট’ বা জেলের ভিতর ভদ্র ব্যবহারের জন্য খ্রিস্টান মিশনারি গ্রাহাম স্টেইন্স এবং তঁার পরিবারকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত মহেন্দ্র হেমব্রম যখন জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে– তখনই ভারত উত্তাল সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায়। অর্থাৎ, ইতিহাসের সমাপতনে– ভারতের সবচেয়ে বৃহৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণের অভিযোগ যখন উঠছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে– ঠিক তখনই ২৫ বছর আগে– সবচেয়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া খ্রিস্টান মিশনারি হত্যার অপরাধী জেল থেকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে!
ভারতে মোদি সরকার বা ওড়িশায় প্রথম ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকার সংখ্যালঘুদের প্রতি কী ধরনের বার্তা দিতে চায়, তা এই দু’টি ঘটনাকে পাশাপাশি রাখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
একই সঙ্গে এই সত্যিটাও মাথায় রাখতে হবে, সংসদের দুই কক্ষে বিতর্কিত ওয়াকফ বিল পাস হয়ে যাওয়ার পরই ‘আরএসএস’-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর তরফে সারা দেশে গির্জা বা অন্যান্য খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানের হাতে কত সম্পত্তি রয়েছে, সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। গ্রাহাম স্টেইন্সের খুনিদের ছাড়া পাওয়া যদি কোনও ‘সূচক’ হয়, তাহলে আরএসএসের তরফে গির্জার সম্পত্তির তালিকা পেশ করা আর-একটি ‘সূচক’ হিসাবে ধরে নিতে হবে।
নরেন্দ্র মোদির কৌশলী সরকার জানে, এবং প্যালেস্তাইনে ঘটে যাওয়া ‘গণহত্যা’-র নিরিখেও বুঝতে পারে যে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে মুসলমানদের হয়ে বলার বা একজোট হয়ে বিরোধিতা করার মানসিকতা ততটা তীব্র নয়।
তাই ওয়াকফ বিল সংসদে অনুমোদিত হয়ে যাওয়ার পর তড়িঘড়ি রাষ্ট্রপতির সই করিয়ে তাকে আইনে রূপান্তরিত করে ফেলা হয়। কিন্তু বিরোধীরা আরএসএসের প্রকাশিত গির্জার সম্পত্তির তালিকা নিয়ে হইচই করার পরই মোদি সরকার বুঝতে পারে– এটা আন্তর্জাতিক স্তরে খবর হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা মার্কিনি অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির রোষানলে পড়তে হতে পারে। দুনিয়া জুড়ে খ্রিস্টানদের সমালোচনার মুখে পড়াকে আপাতত পাশ কাটিয়ে যেতেই আরএসএস তাদের মুখপত্রের ওয়েবসাইট থেকে দ্রুত গির্জার সম্পত্তির ওই তালিকাটিকে সরিয়ে ফেলেছে।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে গেরুয়া শিবির বা আরএসএস কেন সংশোধিত ওয়াকফ আইন এনেছে বা তার মাধ্যমে তারা আসলে কী বার্তা দিতে চায়। ঠিক যে-কারণে হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়তে চায়, প্রত্যেকটি মুসলিম ধর্মস্থান বা ঐতিহাসিক স্তম্ভের নিচে কোনও হিন্দু স্থাপত্য খুঁজে পেতে, পরিষ্কার করে বললে, ‘খুঁড়ে পেতে’ উদ্গ্রীব থাকে, তারই ‘এক্সটেনশন’ বা সম্প্রসারণে– মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তির দখল নিতে চায়। ঠিক যে-কারণে ‘এনসিআরটি’-র বই থেকে মুঘল আমলকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ, ভারতে প্রায় ছ’শো বছর ধরে চলা সুলতানি-মুঘল শাসকদের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক অবদান, স্থাপত্যগত ইতিহাসকে মুছে ফেলে এই হিন্দু আধিপত্যবাদীরা সরাসরি একাদশ শতাব্দী থেকে ২০১৪-তে চলে আসতে চায়; অর্থাৎ পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরই নরেন্দ্র মোদি– মাঝে কিছু ছিল না– ঠিক সেইভাবেই বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাস করাতেও চায় মুসলমানদের ‘ওয়াকফ সম্পত্তি’ বলে কিছু হতেই পারে না।
তত্ত্বগতভাবে আমাদের বুঝতে হবে, ঠিক যেভাবে আরএসএস এবং বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন বিশ্বাস করে, তাজমহল আসলে তেজো মন্দির, এবং সেই মর্মে আদালতে মামলাও হয়– ঠিক তেমনই হিন্দু আধিপত্যবাদীরা বিশ্বাস করে ভারতে মুসলমানদের হাতে এত একরের-পর-একর সম্পত্তি থাকে কী করে? অর্থাৎ, আরএসএসের তাত্ত্বিকরা বলতে চায়, মাঝের এই কয়েকশো বছরের ইতিহাসকে আমরা মুছে দিলাম, ‘মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি বলে
কিছু নেই’– আবার আমরা একাদশ শতাব্দীর ‘গৌরবময় হিন্দু ভারত’-কে ফিরিয়ে আনছি।
আরএসএসের তাত্ত্বিক প্রবক্তারা যখন ভারতের সব মুসলমান শাসককে ‘বহিরাগত’ বলে দেগে দিতে চায়, মুঘলরা ‘আউটসাইডার’ ছিল বলে প্রচার করে, তখন তাদের ‘ন্যারেটিভ’ বা ‘নির্মাণ’-কে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
কিন্তু যেহেতু আমি ইতিহাস পড়াই এবং ‘মনুস্মৃতি’ অনেকবার পড়েছি, তাই মনে করিয়ে দিতে চাই– কারা ভারতে মুসলমান হয়েছিল! নিম্নবর্গীয়রা, ‘রমা কৈবর্ত’-রা মুসলমান হল এবং তৎকালীন মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে যে জমির অধিকার পেল, সে-ই জমিতেই মসজিদ, মক্তব, কবরখানা তৈরি করল। তাতে সেই সময়কার ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ চটেছিল, নিম্নবর্গীয়রা ধর্মান্তরিত হয়ে অধিকার আদায় করে নিতে পারায়। বর্তমানে আরএসএস কি সেই ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হয়ে ‘রিভার্স অ্যাকশন’ বা প্রতিশোধ ক্রিয়ায় মুসলমানদের অধিকার, এবং মুসলমানদের জমি ছিনিয়ে নিতে চাইছে?
আরএসএস-বর্ণিত ‘স্বর্ণযুগ’ বা প্রাক্-মুসলমান পর্বে ভারতকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বা সেই ‘ন্যারেটিভ’ নির্মাণকে না হয় বুঝলাম, তাহলে কি প্রাক্-মুসলমান পর্বের ভারতের বর্ণাশ্রম প্রথা বা নিম্নবর্গীয় সমস্ত মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা, এক ধরনের ‘দাস’ হিসাবে ব্যবহৃত হওয়াকেই আরএসএস-বিজেপি বৈধতা দিতে চাইছে? কারণ, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ভারতে যারা মুসলমান হয়েছিল, বা পরবর্তীকালে যারা খ্রিস্টানও হয়েছে, তারা তো ছিল নিম্নবর্গীয়– প্রান্তিক মানুষ। তা এখনও বহু ভারতীয় মুসলমান বা খ্রিস্টান পদবি দেখলেই বোঝা যায়। প্রশ্ন ওঠে– মুসলমান, খ্রিস্টানদের সম্পত্তি দখল করাই কি এখন আরএসএস-বিজেপির লক্ষ্য?
আমি বিজেপি সরকারের আমলেই ‘সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিল’-এর সদস্য থেকেছি, তাই মোটামুটি একটা ধারণা রয়েছে– দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু কিংবা কলকাতার মতো শহরে কত গুরুত্বপূর্ণ জমি ‘ওয়াকফ সম্পত্তি’ হিসাবে রয়েছে। নতুন বিল আসার আগে পর্যন্ত– এই ওয়াকফ সম্পত্তির উপর– অর্থাৎ তাদের মোট সম্পদ মূল্যের সাত শতাংশ বছরে রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু এই নতুন আইনে রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে পঁাচ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে। কাদের হাতে জমি তুলে দেওয়া হবে বলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হল?
১৮৪০ সালে নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার ‘ওয়েতাঙ্গি চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছিল, যে-চুক্তির বলে ব্রিটিশরা মাওরিদের ভূমি, মাওরিদের দেশের উপর শাসনের অধিকারী হয়। ব্রিটিশ শাসন থেকে পথ চলতে-চলতে নিউজিল্যান্ড বর্তমানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, কিন্তু ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য। মাত্র কিছু দিন আগে সেখানে মাওরিদের ভূমির অধিকার খর্ব করতে একটি বিল আনা হয়েছে এমন অভিযোগকে কেন্দ্র করে নিউজিল্যান্ড উত্তাল হয়ে ওঠে। সেই সময় নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে সে-দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদ হানা-রাউহিতি মাইপি ক্লার্কের প্রতিবাদ এবং পার্লামেন্টের ভিতরে বিল ছিঁড়ে নাচের দৃশ্য ‘ভাইরাল’ হয়েছিল।
ভারতে ১৯১১ সালে যখন কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়, তখন রাইসিনা গ্রামটিকে ব্রিটিশরা নেয় নতুন করে রাজধানী নির্মাণের জন্য। রাইসিনা গ্রামে যেহেতু মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তাই মুসলিম স্থাপত্য বেশি ছিল। সেসব মসজিদ, দরগাকে অপরিবর্তিত রেখেই ব্রিটিশরা ‘লুটিয়েন্স দিল্লি’ তৈরি করেছিল। ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ শাসকদের তরফ থেকে ওই ইসলামিক স্থাপত্যগুলি সুন্নি মজলিশ ওয়াকফের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই সুন্নি মজলিশ ওয়াকফ-ই এখনকার দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের পূর্বসূরি। স্বাধীনতার পর থেকেই দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের ওই ইসলামিক স্থাপত্যগুলির অধিকার চাওয়া নিয়ে বিতর্ক এবং আইনি লড়াই চলছে। স্বাধীনতার পরও ‘দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ ওই সম্পত্তি ছাড়েনি অথবা তার বিনিময়ে কোনও ক্ষতিপূরণও দেয়নি।
স্বাধীনতার পর থেকে এই নিয়ে দীর্ঘ যে-টানাপোড়েন চলেছে, তা মেটাতে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দু’টি কমিটি গড়েছিলেন। সেই কমিটির সুপারিশও কার্যকর হয়নি। অবশেষে ২০১১ সালে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের সময় দিল্লি হাই কোর্ট ওই ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি দিল্লি ওয়াকফ বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেও ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ তার বিরুদ্ধে আদালতে যায়। নরেন্দ্র মোদির সরকার এখনও সেই বিতর্কের মীমাংসা না-করে, বরং সেটাকেই খুঁচিয়ে তুলে, বর্তমানের ওয়াকফ সংশোধনী বিল এনেছে।
নিউজিল্যান্ড থেকে ভারত– তাহলে জমির অধিকার হরণের চেষ্টা হলে– সেসব দেশের সংখ্যালঘুরা তো প্রতিবাদ করবেই। নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে মাওরিদের জমির অধিকার হরণের চেষ্টাকে নতুন রূপে ‘অ্যাপারথেইড’ বা ‘জাতিবিদ্বেষ’ বলা হচ্ছে। ভারতে এই সংশোধিত ওয়াকফ বিলের মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ কি দেখব না?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ,
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
tanveer.nasreen@gmail.com
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.