ছবি: প্রতীকী
বিজেপি মনে করে, হিজাব বিতর্ক দাবানল হওয়ার অর্থ হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটা। সরকার তাই
দায় ঝেড়ে দিব্যি বলছে, সিদ্ধান্ত শিক্ষালয়ের। এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশমন্ত্রক জানিয়েছে, হিজাব ইসলাম ধর্মাচরণে আবশ্যিক কি না সেই বিতর্কের মীমাংসা যাই হোক, মুসলিম দুনিয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মনে করা হচ্ছে, ভারতের মুসলমানদের কোণঠাসা করতে এটা সুচিন্তিত ছক। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারত সরকারের এমন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠার হ্যাটট্রিক, এত অল্প সময়ে, শেষ কবে হয়েছে মনে করতে পারছি না। পর পর তিনটি ঘটনাই বোঝাল, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ায় সরকার কতটা খেপেছে।
প্রথমটি দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্ডাই মোটরের অবদান। পাকিস্তানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যারা দেখে, সম্প্রতি তারা এক টুইটে কাশ্মীরি ভাইদের ‘আত্মত্যাগ’-এর কথা লিখে তাদের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিল। টুইটটি তারা করেছিল ‘কাশ্মীর সংহতি দিবস’ উপলক্ষে, যে-দিনটি পাকিস্তান ওইভাবে পালন করে। কাশ্মীর যতই ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় হোক, সংশয়াতীতভাবে তা ‘আন্তর্জাতিক’ মাথাব্যথারও কারণ। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল-পরবর্তী ঘটনাবলি সেই মাথাব্যথা আরও বাড়িয়েছে। কালক্ষেপ না করে ভারতের বিদেশমন্ত্রক পরদিন ডেকে পাঠায় দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতকে। প্রতিবাদ জানায়। সে দেশের বিদেশমন্ত্রীও ফোনে দুঃখপ্রকাশ করেন। সামাজিক মাধ্যমে ‘বয়কট হুন্ডাই’ ডাক তাদের চিন্তায় ফেলেছিল।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনা একেবারে পিঠোপিঠি। কুশীলব সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং এবং ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। লি সিয়েন লুং বছর কয়েক আগে ভারতে এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গদগদ হয়েছিলেন। এখন বেজায় খাপ্পা। কারণ, তাঁর দেশের পার্লামেন্টে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে শ্রদ্ধাবনত স্মরণ করে লি সিয়েন লুং যা বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা মোটেই শ্রুতিমধুর ঠেকেনি। নরেন্দ্র মোদি উঠতে-বসতে এখনও নেহরুকে অসম্মান করেন। ‘যত নষ্টের গোড়া’ মনে করেন। তাঁর চোখে যিনি ‘ভিলেন নাম্বার ওয়ান’, সেই মানুষটার ভূয়সী প্রশংসা মোদিকে যদি বিচলিত করে থাকে, তা হলে ভারতীয় সংসদীয় চরিত্র ও মূল্যবোধের হাল-হকিকত নিয়ে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর টিপ্পনী ছিল প্রতিবাদী হওয়ার তাগিদ। সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ভারত তাই জানিয়ে দেয়, ভারত সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান সীমিত এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ‘অযাচিত ও অনভিপ্রেত’।
তৃতীয় ঘটনার রাজনৈতিক অভিঘাত প্রবল। কারণ, সমালোচকের নাম মনমোহন সিং এবং পাঞ্জাবের ভোট তখন দরজা ঠকঠকাচ্ছে। মনমোহন সিং কত দক্ষ রাজনীতিক কিংবা প্রশাসক তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর অবদান কতখানি, রাজনৈতিক কচকচানি হতে পারে তা নিয়েও। কিন্তু মনমোহন সিং যে সুভদ্র, সৎ, অল্প কথার মানুষ, অর্থনীতির দিগ্গজ এবং প্রাজ্ঞ, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। গোটা বিশ্ব তাঁকে ‘আধুনিক’ ভারতীয় অর্থনীতির রূপকার বলে মানে। আজ বিশ্বে ভারতের অর্থনীতির যে অবস্থান, নিঃসন্দেহে তা তাঁর অবদান। আজকের শাসককুল যাঁকে ‘মৌনমোহন’ আখ্যা দিয়েছিল, সেই তিনি মোদিকে ফালাফালা করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সেই মর্যাদা আমি কখনও নষ্ট হতে দিইনি। রাজনৈতিক লাভের জন্য কখনও সত্যের উপর পর্দা টানিনি।’ কী সেই সত্য? মনমোহনের ব্যাখ্যায়, ‘মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব-সহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশবাসীর সমস্যার সুরাহায় ব্যর্থ সরকার তাদের ভুল নীতি সংশোধন না করে এখনও দোষ দিয়ে যাচ্ছে জওহরলাল নেহরুকে।’
সত্যি বলতে কী, মোদির এমন কঠোর সমালোচনা মনমোহনের মতো স্বল্পবাক মানুষ আগে করেননি। অর্থনীতি তো বটেই, বিদেশনীতি নিয়েও তিনি তোপ দেগেছেন। তীব্র কটাক্ষে বলেছেন, ‘এক বছর ধরে সীমান্তে চিন গেড়ে বসে রয়েছে অথচ সরকার তা ধামাচাপা দিতে চাইছে। ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি! ভারতের সব পুরনো বন্ধু ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কহানি ঘটছে। প্রধানমন্ত্রীর বোঝা উচিত, রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে কোলাকুলি করলে, দোলনায় দুললে অথবা বিনা আমন্ত্রণে বিরিয়ানি খেতে গেলে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হয় না।’
যে সমালোচনায় মোদি সরকার দেশে-বিদেশে সমভাবে বিদ্ধ, তর্কাতীতভাবে তার উৎসে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দলের আদর্শগত বিচার, যার মুখ্য উদ্দেশ্য: হিন্দুত্ববাদের সম্প্রসারণ। হিন্দুত্ববাদ ও ভারতীয়ত্বকে একাকার করে দিতে সাড়ে সাত বছর ধরে মোদির প্রশ্রয়ে যা যা ঘটে চলেছে তা আন্তর্জাতিক ভ্রুকুঞ্চনের কারণ। এই কারণে গণতান্ত্রিকতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভারত ক্রমশ পিছিয়েছে। সমাজ ‘মুক্ত’ থেকে হয়েছে ‘আংশিক মুক্ত’। বারবার প্রশ্ন উঠছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের। জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের। লক্ষ্যণীয়, যে যে কারণে ভারত বহির্বিশ্বে সমালোচিত ও নিন্দিত, প্রতিটির উৎসে রয়েছে এই উগ্র হিন্দুয়ানার ছায়া। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কহানির কারণও তা। বহমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, যা সহনশীল ও গণতান্ত্রিক দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, সবার মূলে রয়েছে হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের তৎপরতা। কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।
বিস্ময় এটাই, প্রতিটি বিতর্কে ‘প্রধান সেবক’ নির্লিপ্ত ও নির্বাক! গোরক্ষকদের তাণ্ডব ও গণপিটুনি থেকে শুরু করে ‘লাভ জিহাদ’, ‘রোমিও পুলিশ’, অগুন্তি হিন্দুত্ববাদী ‘হেট স্পিচ’ কিংবা এই হালের ‘হিজাব বিতর্ক’- আজ পর্যন্ত একটি বিষয়েও নিন্দাজনক কোনও মন্তব্য করতে তাঁকে দেখা যায়নি! মৌনের অর্থ তাই অনুমোদন। অনুমোদন না থাকলে, হিজাব প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা অন্তত চোখে পড়ত। কিন্তু ঘটনাক্রম যেভাবে এগোচ্ছে, রাজ্য সরকার যেভাবে বিষয়টির মোকাবিলা করতে চাইছে, প্রশাসনিক স্তরে এবং কর্নাটক হাই কোর্টে, তাতে পরিষ্কার- দায়টা শিক্ষালয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে তারা হাত ধুয়ে ফেলতে চায়। কর্ণাটকের অ্যাডভোকেট জেনারেল হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে বলেছেন, রাজ্য সরকার সব শিক্ষালয়কে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ করতে চায়। লেখাপড়ার সঙ্গে কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গের যোগ থাকবে না। কী এর অর্থ কেউ জানে না। হিন্দু বিবাহিতা শিক্ষার্থীর সিঁথিতে সিঁদুর অথবা হাতে শাঁখা-পলা ধর্মীয় অনুষঙ্গ বলে মানা হবে? কিংবা টিপ পরা? ঘোমটা দেওয়া? প্রশ্ন উঠেছে। আদালত কী রায় দেবে কেউ জানে না। শুধু এটুকু জানা, অনর্থক এই বিতর্ক সমাজকে এক ইঞ্চিও এগতে সাহায্য করছে না। বরং পিছনে টানছে।
বিজেপি মনে করছে, হিজাব বিতর্ক দাবানল হওয়ার অর্থ হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটা। সরকার দায় ঝেড়ে দিব্যি বলছে, তারা নয়, সিদ্ধান্ত শিক্ষালয়ের। এই মনোভাবে বহির্বিশ্বে মোদির ভারতের ছবি মলিনতর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশমন্ত্রক জানিয়েছে, হিজাব ইসলাম ধর্মাচরণে আবশ্যিক কি না সেই বিতর্কের মীমাংসা যাই হোক, মুসলিম দুনিয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মনে করা হচ্ছে, ভারতের মুসলমানদের কোণঠাসা করতে এটা এক সুচিন্তিত ছক।
অনাবশ্যক হিজাব বিতর্কে বিজেপির কতটা লাভ হবে সে জল্পনা আপাতত থাক। কর্ণাটকের ভোট এখনও এক বছর পর। রাজ্যস্তরে মোদি ম্যাজিকের আকর্ষণও কমেছে। দাক্ষিণাত্যে তো আরওই কম। রাজনীতিতে টিকে থাকার তীব্র তাড়নায় রাজ্যে রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টায় তবু খামতি নেই। কিন্তু এসব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে প্রধানমন্ত্রী রচিত এক আবহ, যা মুসলমান নারীর মন জেতার ‘জিওনকাঠি’ বলে এতদিন মনে করা হয়েছে। সেই আবহ জন্ম দিয়েছে ‘তিন তালাক’ আইনের, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় যা মুসলমান নারীর মুক্তি ও স্বাধীনতার হাতিয়ার। সেই আবহেই রচিত তাঁর ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগান। হিজাব বিতর্ক সেই স্লোগানের পায়েও বেড়ি পরাবে।
ভারতে মুসলমান অনগ্রসরতার প্রধান কারণ শিক্ষার অসম বিস্তার। ইদানীং মুসলমান নারীদের শিক্ষায় আগ্রহ বেড়েছে। উচ্চতর শিক্ষায় যোগদানের হার ২০০০ সালে ছিল মাত্র ৫.৩ শতাংশ, দশ বছরে তা হয়েছে ১৩.৮ শতাংশ। হিন্দু নারীর তুলনায় (২৪.৩ শতাংশ) যদিও কম। ‘ইউনেসকো’-র রিপোর্ট দেখাচ্ছে, ২০১৩-’১৮র মধ্যে ভারতে উচ্চশিক্ষায় মুসলমান নারীর আনাগোনা ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তঁাদের হিজাব ও শিক্ষার মধ্যে একটি বেছে নিতে বাধ্য করলে তা স্বস্তিদায়ক হবে না। মুসলমান জনসমষ্টির কাছে তো বটেই, ভারতের পক্ষেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.