Advertisement
Advertisement

Breaking News

Imran Khan

ইমরানের শত্রু-মিত্র, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘রিভার্স সুইং’ পাক প্রধানমন্ত্রীর

গদি বাঁচাতে 'মিত্র' আমেরিকাকে দুষছেন কেন ইমরান?

Here is why Imran Khan blaming America | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:April 1, 2022 6:41 pm
  • Updated:April 1, 2022 6:41 pm  

গদি যখন টলমল করছে, তখন ইমরান খানের অভিযোগ, আমেরিকা ফেলে দিতে চায় তাঁর সরকারকে। কেননা, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সখ্য করেছেন। গত ৬০ বছরের ন্যারেটিভ, পাকিস্তানের মিত্র আমেরিকা। মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সখ্য। তাহলে সমীকরণ হঠাৎ বদলে গেল কেন? কলমে মিলন বশিষ্ঠ

বিশ্ব ক্রিকেটকে রিভার্স সুইং পাকিস্তান-ই উপহার দিয়েছে। একদা ইমরান খানের (Imran Khan) সতীর্থ এবং প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে, সরফরাজ নওয়াজ রিভার্স সুইংয়ের প্রথম প্রয়োগ করেন। এই রিভার্স সুইং পাকিস্তানকে বহু স্মরণীয় ম্যাচ জিতিয়েছে। যেমন, ১৯৮২-র ডিসেম্বরে করাচিতে ভারতের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টে ইমরানের রিভার্স সুইংয়ের স্পেল ভারতীয় ব্যাটিং দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানকে বিশ্বকাপও এনে দিয়েছিল রিভার্স সুইং। ১৯৯২-এর ফাইনালে ওয়াসিম আক্রমের সেই বিখ্যাত দু’টি ডেলিভারি, যা ইংল্যান্ডের অ্যালান ল্যাম্ব আর ক্রিস লুইসকে প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করে। চুম্বকে, ইমরান খানের ক্রিকেট-জীবনে রিভার্স সুইংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

Advertisement

তবে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো ক্রিকেট অধিনায়ক থেকে সফল রাজনীতিক রূপে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া ইমরান খান যে এতদিন পরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া এইরকম রিভার্স সুইং দেবেন, তা কে জানত! সবাই যখন ধরে নিয়েছিল, পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ইমরান পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন, তখনও দলে এবং মন্ত্রিসভায় তাঁর অনুগামীরা বারবার ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ ফাইনালের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করা-ই ‘অধিনায়ক’ হিসাবে চিরায়ত ইমরান খানের ট্র্যাক রেকর্ড। এবারেও তাই প্রাক্তন ক্রিকেটারের নেতৃত্বে দল শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে।

[আরও পড়ুন: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ কি উগ্র হিন্দুত্ববাদের পালে হাওয়া জোগাচ্ছে?]

কী সেই রিভার্স সুইং? পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সতীর্থদের, সে-দেশের তারকা টেলিভিশন অ্যাঙ্করদের ডেকে আলাদা-আলাদা বৈঠক করে বলছেন যে, আমেরিকা তাঁর সরকারের পতন ঘটাতে চায়। কারণ, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের নতুন সেতু তৈরি করছেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে পাকিস্তান বরাবরই পরিচিত ‘আমেরিকার বন্ধু’ হিসাবে। ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সখ্য ৬০ বছরেরও বেশি পুরনো। ’৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু ৫০ বছরের ব্যবধানে এমন কী হল যে, ইমরানকে এইরকম রিভার্স সুইং দিতে হল? পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে গোপন চিঠি দেখিয়ে তিনি দাবি করছেন যে, ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে জো বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল ইমরান খান সরকারের পতন ঘটাতে হবে। না হলে পাকিস্তানকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে, বিশেষত সাম্প্রতিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে কোনও রাষ্ট্রপ্রধান এইরকম রিভার্স সুইং দিয়েছেন বলে জানা নেই।

পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী জোট, অর্থাৎ একদিকে বেনজির ভুট্টোর পুত্র বিলাওয়াল ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন ‘পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টি’ আর অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ’ হাতে হাত মিলিয়ে ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। সেই নিয়ে মার্চ মাস থেকে আমাদের প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ এবং তৎপরতা- দুই-ই তুঙ্গে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সরকারের অন্যতম শরিক ‘এমকিউএম’ বা ‘মুহাজির কোয়ামি মুভমেন্ট’-ও ইমরানকে ছেড়ে বিরোধীদের পাশে। অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে, ইমরান খানের সরকার পাকিস্তানে সংখ্যালঘু। এই পরিস্থিতিতে, সবাই যখন আশা করছিল, ইমরান খান গদি ছেড়ে দেবেন, তখনই তাঁর এই মারাত্মক অভিযোগ। মস্কোর সঙ্গে বন্ধুত্বের দায় চোকাতে হচ্ছে তাঁকে। যার নেপথ্যে ওয়াশিংটন।

ইমরান খানের এই চাঞ্চল্যকর অভিযোগের পরে এখনও পর্যন্ত রুশ রাষ্ট্রনেতা ভ্লাদিমির পুতিন কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে যেদিন পুতিন ইউক্রেনের উপর হামলার সিদ্ধান্ত নেন, সেদিন পাক প্রধানমন্ত্রী মস্কোতেই ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, ইমরান খান যে-রাজনৈতিক সমীকরণটি তৈরি করতে চেয়েছেন, তার মূল কথা হল, যেহেতু আমেরিকা চায়নি রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান সখ্য তৈরি করুক, সেহেতু ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের সরকার বদলাতে তৎপর। এটা সত্যি যে, জো বাইডেন প্রশাসন বারবার পাকিস্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ইউক্রেন নিয়ে যখন ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ, তখন পাক প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফর পৃথিবীর কাছে ভুল বার্তা দেবে। ইমরান যেমন মার্কিন বিদেশ দপ্তরের সেই পরামর্শ শোনেননি, তেমনই রাষ্ট্রসংঘে বা অন্য যে কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে মস্কোর সমালোচনা করেও কথা বলেননি। অতএব ধরে নেওয়া যায়, ওয়াশিংটন এবং ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কে শৈত্য এসেছে।

কিন্তু সেই শৈত্য কি এতটা যে, ইমরান ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করবেন? পাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের আগে ইমরান যেমন নানা দ্বন্দ্বে দীর্ণ পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে সবরকম চেষ্টা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত কাপ জিতেওছিলেন, এবারও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গদি টিকিয়ে রাখতে নাকি সেরকমই পণ করেছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলে ইমরান যেভাবে আমেরিকাকে দুষেছেন, তাতে নাকি তাঁর মন্ত্রিসভার সতীর্থরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাইরে এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। আমেরিকার বিরুদ্ধে কামান দেগে ইমরান ওয়াশিংটনে পাক রাষ্ট্রদূতের পাঠানো মেসেজ কাকে না দেখিয়েছেন? সে-তালিকায় যেমন মন্ত্রিসভার সহকর্মীরা আছেন, তেমন পাকিস্তানি রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস পাক সেনাবাহিনী এবং পাক গুপ্তচর বাহিনীর প্রধানরাও রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আবেগে-চোবানো বক্তৃতায় এসেছে কীভাবে বাইডেন প্রশাসনের একজন সেক্রেটারি ওয়াশিংটনে বসে থাকা পাক রাষ্ট্রদূতকে হুমকি দিয়েছিলেন অনাস্থা প্রস্তাব এনে সরকার ফেলে দেওয়ার।

গত ৬০ বছরের ন্যারেটিভ, পাকিস্তানের মিত্র আমেরিকা। আর, মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সখ্য। সে-কারণে আমেরিকা একসময় পাকিস্তানকে ঢালাও অস্ত্র সাহায্য করেছে। ভারতকে চাপে রাখতে ইসলামাবাদকে এফ-সিক্সটিন দিয়েছে। তখন ভারতকে রাশিয়ার কাছ থেকে সুখোই-৩০ কিনে ভারসাম্য রাখতে হয়েছিল। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের সময় পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার করে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সিআইএ’ আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এতদিন পাকিস্তানকে আমেরিকার বোড়ে হিসাবেই ধরা হত। তাহলে সমীকরণ কেন বদলাল?

এ যেন ১৯৯৭ সালের হলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘ফেস/ অফ’-এর গল্প। জন ট্রাভোল্টা এবং নিকোলাস কেজ অভিনীত সেই সিনেমায় ‘নায়ক’ এবং ‘খলনায়ক’-এর মুখ বদলের এমন আখ্যান ছিল যে, বোঝার উপায় ছিল না কে-কোন চরিত্রে অভিনয় করছেন! কে হিরো আর কে ভিলেন? তেমনই ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার হামলা এবং আমেরিকার অবস্থান বাস্তবেই ‘নায়ক’ এবং ‘খলনায়ক’-এর অবস্থান পালটে দিয়েছে। আর, ক্রিকেটার ইমরান খান সেই সুযোগে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যতম সেরা রিভার্স সুইংটি রেখে গেলেন।

যিনি অক্সফোর্ডে পড়েছেন, জেমাইমা গোল্ডস্মিথের মতো লন্ডনপ্রবাসী ধনকুবের কন্যাকে বিয়ে করেছেন, তিনি কী করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এতটা মৌলবাদের আইকন হয়ে উঠতে পারেন, সেটা অবশ্য ইমরান খানকে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না! ইমরান খান সম্ভবত মহম্মদ আলি জিন্নার সার্থক রাজনৈতিক উত্তরসূরি। জিন্নার ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনৈতিক জীবন যেমন ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে দাঁড়িয়ে, ইমরান খানেরও ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনৈতিক জীবন সম্পূর্ণভাবে আলাদা। তা না হলে পশ্চিমি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত ইমরান খানের মতো কোনও রাজনীতিক তালিবানদের মহিলাদের আড়ালে রেখে দেওয়ার রাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন করতে পারেন?

আর, ২০২২-এর পৃথিবীতে মস্কো মানেই ‘প্রগতিশীল’ এবং ওয়াশিংটন মানে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, এমন কি আর বলা যায়? ইউক্রেনে রুশ মিসাইলের আছড়ে পড়া সম্ভবত প্রগতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে নতুন করে নির্ধারণ করছে। ইমরান নিশ্চিতভাবে এই নতুন পৃথিবীতে, নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডারে নিজের জায়গাটিকে চিহ্নিত করতে প্রস্তুত। তিনি রুশ ও চিনের সঙ্গে। তিনি আমেরিকার ‘বিরোধী’, কারণ আমেরিকা যেভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি সেই অ্যাকশনের সঙ্গে সহমত নন। অর্থাৎ, ইমরান খান গণতন্ত্রকে দেখতে চান পুতিন কিংবা শি জিনপিংয়ের মতো করে। আর, তালিবানদের মতো করে মহিলাদের অধিকারে বিশ্বাস করেন।

ইমরান খান যখন নিজের অবস্থান এবং নিজের শত্রু-মিত্রকে নতুন করে চিহ্নিত করছেন, তখন কম্পাসে অন্যরা কোথায়? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলো সচেতন তো? তারা বুঝতে পারছে তো ‘ফেস/ অফ’-এর এই নতুন সিক্যুয়েলে কে সঠিক আর কেই-বা বেঠিক?

[আরও পড়ুন: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ কি উগ্র হিন্দুত্ববাদের পালে হাওয়া জোগাচ্ছে?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement