ফাইল ছবি
গাজায় ইজরায়েলি হানার ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে। এবার দ্য হেগের ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা করল দক্ষিণ অাফ্রিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে হওয়া জেনোসাইড কনভেনশনের প্রস্তাব ভঙ্গ করে ইজরায়েল এই গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। হঠাৎ এই সক্রিয়তা? লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
গাজায় (Gaza) ইজরায়েলি হানার ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে। ৭ অক্টোবর অাচমকা হামাসের হামলার পর থেকে ইজরায়েলের এই পালটা অাক্রমণ শুরু। এই ১০০ দিনে গাজায় মৃতের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজারে পৌঁছেছে। এত মানুষের মৃতু্যর পরেও ইজরায়েলি (Israel) হানা বন্ধ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর একাধিক দেশে প্যালেস্তাইনের সমর্থকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। অামেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনেও ইজরায়েলি হামলা বন্ধের দাবিতে প্রবল বিক্ষাভ হয়েছে। প্যালেস্তিনীয় সমর্থকদের এই বিক্ষোভ যদিও বিগত ১০০ দিনের মধে্য এই প্রথম নয়। বিগত ১০০ দিনের মধে্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে এইরকম অসংখ্য বিক্ষাভ দেখা গিয়েছে। তবে অভিনব ঘটনাটি ঘটল এই ১০০ দিনে এসে। এবার দ্য হেগের ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা করল দক্ষিণ অাফ্রিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে হওয়া জেনোসাইড কনভেনশনের প্রস্তাব ভঙ্গ করে ইজরায়েল এই গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে দক্ষিণ অাফ্রিকা (South Africa)।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যার মুখে পড়েছিল ইহুদিরা। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হিটলার লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন। জেরুজালেমে বিদেশি অতিথি ও পর্যটকরা পৌঁছলেই তাদের প্রথম গন্তব্য ‘ইয়াদ ভাসেম’ মিউজিয়াম। যেখানে স্টিফেন স্পিলবার্গের পরিকল্পনায় জীবন্ত হয়ে অাছে নাৎসি জার্মানির সেইসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এ ৮৪ পাতার অভিযোগপত্রে দক্ষিণ অাফ্রিকা বলেছে, ‘গোটা গাজা ভূখণ্ডকেই সেইরকম একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করেছে ইজরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র সরকার।’ গাজা ভূখণ্ড উন্মুক্ত কারাগার বহুদিনই। সরু লম্বা ভূখণ্ডের একদিকে ভূমধ্যসাগর। দু’দিকে বিস্তীর্ণ ইজরায়েলের সীমানা। একদিকে মিশরের এক টুকরো রাফা সীমান্ত। ইজরায়েলের সীমানায় মরুভূমির উপর দঁাড়িয়ে জেলখানার মতো উঁচু প্রাচীর। প্যারাগ্লাইডিং করে এই লম্বা প্রাচীর টপকেই ৭ অক্টোবর হামাস জঙ্গিরা ইজরায়েলে ঢুকেছিল।
ইজরায়েলের প্রান্ত থেকে গাজাকে দেখলে বাস্তবিকই একটি জেলখানা লাগে। ওপারের যে-কারাগারে ঠাসাঠাসি করে বন্দি ২৩ লক্ষ মানুষ। গাজা নামক এই জেলখানায় একমাত্র অাকাশ কিছুটা মুক্ত ছিল। গত ১০০ দিন ধরে সেই মুক্ত অাকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গোনার সুযোগও নেই হতভাগ্য গাজাবাসীর। কারণ অাকাশ থেকে প্রতি মূহূর্তে বর্ষিত হচ্ছে কেজি কেজি বোমা। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে কীরকম নিশ্চিত মৃতু্যর মুখে দঁাড়িয়ে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছে গাজাবাসীরা। বোমা-বারুদের মুখে পালানোর কোনও পথ নেই। একদিকে সমুদ্র, একদিকে মিশরের সংকীর্ণ অান্তর্জাতিক সীমান্ত ও অন্য দুইদিকে ইজরায়েলের উঁচু প্রাচীর ঘেঁষে দঁাড়িয়ে সারি সারি ট্যাঙ্ক। ঘিরে ধরে মারা হচ্ছে অসহায় ২৩ লক্ষ মানুষকে। এটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছাড়া কী?
গাজার উলটো প্রান্তে জেরুজালেমের গা লাগোয়া ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’-এও চলছে একইরকম অত্যাচার। সেখানেও রয়েছে ইজরায়েলের প্রাচীর। যার সারা গায়ে লেগে প্যালেস্তিনীয়দের রক্ত। প্যালেস্তিনীয়রা রক্ত দিয়ে প্রাচীর-গাত্রে তাদের যন্ত্রণার কথা লিখে রেখেছে। প্রাচীরের ওপারে বেথলেহেমে যিশুর জন্মস্থান দেখতে এপারে জেরুজালেমে একটি টিলার উপর উঠতে হয়েছিল। কী অদ্ভুতভাবে নিজের মাতৃভূমিতেই বন্দি প্যালেস্তিনীয়রা! এতদিন এইসব দেখেও কেউ দেখে না। কারণ অামেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়া ইজরায়েলের পক্ষে। প্যালেস্তিনীয়দের জাহান্নমে পাঠিয়ে স্বতন্ত্র ইহুদি-ভূমি গড়তে তারা দায়বদ্ধ। বারাক ওবামার নির্বাচনী সভাতেও দেখেছি ‘অামরা ইজরায়েলিদের পাশে’ লেখা বিশাল পোস্টার। এখনও দেখা যাচ্ছে নেতানিয়াহুকে অাটকাতে অামেরিকা ও পশ্চিমি দুনিয়ার কোনও অাগ্রহ নেই। অামেরিকার তঁাবেতে থাকা অারব দেশগুলির শাসকরা কয়েকদিন কুমিরের কান্না কেঁদে চুপ করে রয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস কোর্টে দক্ষিণ অাফ্রিকার অাবেদনে এই প্রথম উঠে এল ১৯৪৮ সাল থেকে চলতে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের দুর্দশার কথা। দক্ষিণ অাফ্রিকা তাদের অভিযোগে লিখেছে, ‘৭ অক্টোবর হামাস হামলার পর থেকে প্যালেস্তিনীয়দের দুর্দশা শুরু হয়নি। তাদের এই অবস্থা চলছে ১৯৪৮ সাল থেকে।’ গোটা বিশ্ব যখন প্যালেস্তিনীয়দের নিয়ে কার্যত নিশ্চুপ, তখন হঠাৎ কেন দক্ষিণ অাফ্রিকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস কোর্টে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে তাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় উকিলদের শুনানিতে নামিয়ে দিল, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে সর্বত্র।
১৯৮৬ সালে নিকারাগুয়ার বামপন্থী সান্দিনিস্তা সরকারকে উৎখাত করতে অামেরিকা যখন বোমা বন্দুক নিয়ে সেখানকার ‘কন্ট্রা’ প্রতিবিপ্লবীদের সাহায্য করতে নেমেছিল, তখন ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’ বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। অান্তর্জাতিক অাদালত অামেরিকাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। সেই রায় বাজে কাগজ ফেলার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান। রাষ্ট্র সংঘে সেসময় অামেরিকার পাশে বড় দেশ বলতে একমাত্র ইজরায়েল ছিল। কিছুই করা যায়নি রেগান প্রশাসনকে। ১৯৯০ সালে মার্কিন হস্তক্ষেপে নির্বাচনের মধে্য দিয়ে ক্ষমতাচু্যত হয়েছিলেন সান্দিনিস্তা সরকারের প্রধান ড্যানিয়েল ওরতেগা। পরে অবশ্য তিনি ফের ক্ষমতায় ফেরেন। প্রায় চার দশক বাদে একইরকম একটি মামলায় যদি ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে রায় দেয়, তাহলে যে নেতানিয়াহু গাজা ভূখণ্ডের উপর বোমা ফেলা বন্ধ করে দেবেন, তেমন ভাবার কোনও কারণই নেই।
তবুও গোটা বিশ্ব যখন অামেরিকার দিকে তাকিয়ে এবং সেই যুক্তরাষ্ট্রই ইজরায়েল নিয়ে চুপ, তখন কেন হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠল দক্ষিণ অাফ্রিকার সরকার? সেখানেও উঠে অাসছে ভোটের তত্ত্ব। ভারতের মতোই এ-বছরে সাধারণ নির্বাচন দক্ষিণ অাফ্রিকায়। কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে প্রয়াত কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার দল অাফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। বর্ণবৈষম্যবাদের অবসানের পর ১৯৯৪ সাল থেকে টানা ৩০ বছর তারা দক্ষিণ অাফ্রিকার ক্ষমতায়। কিন্তু এবার দক্ষিণ অাফ্রিকায় প্রবল প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া। সিরিল রামাফোসা তৃতীয়বারের জন্য প্রসিডেন্ট পদে বসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন। ভোট সমীক্ষা বলছে, এই প্রথম ম্যান্ডেলার দল ৫০ শতাংশ মানুষের সমর্থন পাবে না। ভোটে বামপন্থী ও ম্যান্ডেলা ভক্তদের ভোট সুনিশ্চিত করতেই নাকি রামাফোসা প্যালেস্তিনীয়দের দুর্দশা নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন। এটা নাকি রামাফোসার ভোট কৌশল। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে-কারণে তড়িঘড়ি রামমন্দিরের উদ্বোধনে উদে্যাগী হয়েছে, ঠিক সেই কারণেই রামাফোসার ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস’-এ তৎপরতা। প্যালেস্তিনীয়দের দুর্দশা ঘুচুক না ঘুচুক, রামাফোসার কপাল এই মামলার জেরে খোলে কি না এখন দেখার সেটাই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.